বিভীষিকার সূত্রপাত ‘চ’ বগি থেকে

বেনাপোল এক্সপ্রেসে আগুন

নিজস্ব প্রতিবেদক
০৭ জানুয়ারী ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
বিভীষিকার সূত্রপাত ‘চ’ বগি থেকে

বেনাপোল এক্সপ্রেসে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত ‘চ’ বগি থেকে হয়েছে বলে ধারণা করছে পুলিশ। যাত্রীদের বরাত দিয়ে পুলিশ বলছে, ওই বগির বাঁ পাশের মাঝামাঝি কোনো আসনে প্রথমে ধোঁয়া দেখা যায়। ধোঁয়া দেখে চেন টেনে ট্রেন থামান এক পুলিশ সদস্য। কিন্তু ট্রেন থামানোর পর আগুন নেভানোর আগেই নিভে যায় চার প্রাণ। দগ্ধ হন অন্তত ১০ জন, যাদের কেউই আশঙ্কামুক্ত নন।

এদিকে গত শুক্রবারের ভয়াবহ এ অগ্নিকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এদের মধ্যে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক মোহাম্মদ নবী উল্লাহও রয়েছেন। গতকাল চার আসামিকে তিন দিনের রিমান্ডে নেওয়ার অনুমতি দিয়েছেন ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট ফারজানা শাকিলা সুমু।

নবীর রিমান্ড আবেদনে পুলিশ বলেছে, নবী উল্লাহ নবী গত ৫ নভেম্বর যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তা থেকে দোলাইরপাড়গামী সড়কে বিজিবি মার্কেটের সামনে দলবল নিয়ে সশস্ত্র অবস্থান নেন। তারা সরকারবিরোধী স্লোগান দিতে থাকেন। সড়কে যান চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করলে চরম জনভোগান্তি তৈরি হয়। নবীসহ অন্য আসামিরা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটিয়ে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার উদ্দেশে এবং সরকারকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলতে পুলিশের ওপর ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। ঘটনাস্থলের পাশে দুটি বাসে আগুন দেয় এবং ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়ে দাঙ্গা-হাঙ্গামা বাধায়।

রিমান্ড আবেদনে আরও বলা হয়, ‘নবী উল্লাহ নবীর নির্দেশ ও হুকুমে বিএনপির দুষ্কৃতকারীরা সংঘবদ্ধ হয়ে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের পাশাপাশি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটায়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে গোপন তথ্যের ভিত্তিতে ও তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার করে উত্তরা পশ্চিম থানা এলাকা থেকে আসামিদের গ্রেপ্তার করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে নবী ট্রেনে আগুন দেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন।’

যশোরের বেনাপোল থেকে ঢাকায় আসছিল বেনাপোল এক্সপ্রেস। কমলাপুর রেলস্টেশনে পৌঁছানোর কিছুক্ষণ আগে রাত ৯টার দিকে গোপীবাগ কাঁচাবাজারের সামনে ট্রেনে আগুন দেওয়া হয়।

গতকাল সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে র?্যাব মহাপরিচালক (ডিজি) অতিরিক্ত আইজিপি এম খুরশীদ হোসেন বলেন, ‘আমাদের কাছে গোয়েন্দা তথ্য ছিল। কিন্তু কোথায় হবে এটা বলা কঠিন। তবে আমাদের নজরদারি অব্যাহত ছিল। নজরদারি ছিল বলেই তৎক্ষণাৎ কয়েকজনকে ধরেছি। তদন্ত চলছে, দেখি কী পাওয়া যায়।’

র?্যাব মহাপরিচালক বলেন, ‘আমরা তিনজনকে আটক করেছি। তাদের কাছে পেট্রোল বোমা পাওয়া গেছে ২৮টি, ককটেল পাওয়া গেছে ৩০টি। তাদের আমরা জিজ্ঞাসাবাদ করছি।’

ঢাকা রেলওয়ে জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) আনোয়ার হোসেন বলেন, “বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেনের নিরাপত্তায় সাতজন কাজ করছিলেন। তাদের মধ্যে পাঁচজন পুলিশ, বাকিরা আনসার সদস্য। শুক্রবার রাত ৯টার দিকে ট্রেনটির ‘চ’ বগির বাঁ পাশের মাঝামাঝি কোনো আসনে প্রথমে ধোঁয়া দেখতে পান যাত্রীরা। সঙ্গে সঙ্গে ওই ট্রেনে দায়িত্বে থাকা পুলিশ কনস্টেবল মোহাম্মদ আলী চিৎকার করে আগুনের সংবাদ দিতে থাকেন এবং চলন্ত ট্রেনটি থামানোর জন্য চেন টান দেন। আগুনে আলীও আহত হয়েছেন।”

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের মর্গে নিহত চারজনের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয় গতকাল বিকালে। তাদের ডিএনএ পরীক্ষা করার জন্য নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে।

ঢাকা রেলওয়ে থানার এসআই মো. সেতাফুর রহমান বলেন, ‘নিহত চারজনেরই দাবিদার এসেছেন। এদের মধ্যে তিনজনের জন্য লিখিত আবেদন পেয়েছি। কিন্তু লাশ হস্তান্তর হবে ডিএনএ পরীক্ষার পর।’

বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেনে আগুনের ঘটনায় দগ্ধ ১০ রোগী শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন। তাদের প্রত্যেকের শ্বাসনালি পুড়ে গেছে। কেউই ঝুঁকিমুক্ত নন বলে জানিয়েছেন ইনস্টিটিউটের সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেন।

চিকিৎসাধীন ১০ জন হলেন- ওয়াহিদা আক্তার, হালিমা বেগম, আসিফ মো. খান, ডা. কৌশিক বিশ্বাস, নাফিস আলম, মাসুদ রানা, ডেইজি আক্তার রত্না, রিহান, মো. ইকবাল ও দিহান।

শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে আবাসিক সার্জন ডা. তরিকুল ইসলাম বলেন, ‘আহতদের মধ্যে হালিমাকে আইসিইউতে পাঠানো হয়েছে। ওয়াহিদাকে রাখা হয়েছে পোস্ট অপারেটিভে।

বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেনে অগ্নিসংযোগ করে নারী-শিশুসহ সাধারণ মানুষকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় ক্ষোভ ও নিন্দা জানিয়েছে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ। গতকাল এক বিবৃতিতে তারা এ ঘটনায় জড়িতদের অবিলম্বে বিচারের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছে।

অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় উদ্বেগ ও শঙ্কা জানিয়েছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনও। গতকাল এক বিবৃতিতে কমিশনের চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘এটি নিছক দুর্ঘটনা নয়, বরং বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এটি একটি ইচ্ছাকৃতভাবে ঘটানো নাশকতামূলক ঘটনা বলেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ধারণা করছেন।’

আমাদের সময়ের রাজবাড়ী প্রতিনিধি জানান, বেনাপোল এক্সপ্রেসে অগ্লিকাণ্ডে রাজবাড়ীর তিনজন নিখোঁজ রয়েছেন। তারা হলেনÑ এলিনা ইয়াসমিন, আবু তালহা ও চন্দ্রিমা চৌধুরী সৌমি। এলিনা রাজবাড়ী শহরের নূরপুর গ্রামের সাইদুর রহমান বাবুর মেয়ে, আবু তালহা কালুখালী উপজেলার মৃগী ইউনিয়নের বড়ইচারা গ্রামের আবদুল হক মণ্ডলের ছেলে এবং চন্দ্রিমা চৌধুরী রাজবাড়ী সদর উপজেলার খানগঞ্জ ইউনিয়নের রঘুনাথপুর গ্রামের চিত্তরঞ্জন প্রামাণিকের মেয়ে।