৫ খনিতে কয়লার বিপুল মজুদ
সরকারের আগ্রহ আমদানিতে
গত এক দশকে দেশে বড় বড় বেশ কয়েকটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। তবে দেশের পাঁচটি খনিতে মজুদ থাকা প্রায় ৭৮২৩ মিলিয়ন মেট্রিক টন কয়লা উত্তোলনে নতুন কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। আমদানি করা কয়লা দিয়ে চলছে বিদ্যুৎ উৎপাদন। ভঙ্গুর অর্থনৈতিক অবস্থায়ও কয়লা আমদানির বিল পরিশোধ করতে চাপ তৈরি হচ্ছে। জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কেবল কয়লা নয়, সব ধরনের জ্বালানি আমদানিতে আগ্রহ দেখিয়েছে সরকার। আর জ্বালানি বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, কয়লা উত্তোলনের মতো স্পর্শকাতর বিষয়ের জন্য রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের প্রয়োজন পড়ে।
দেশের বেশ কয়েকটি বড় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র জাপান, চীন ও ভারতের মতো বিদেশিদের সঙ্গে যৌথমালিকানায় স্থাপন করা হয়েছে। আর্থিক সংকটের কারণে এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের পাওনা জমে জমে ঋণের পাহাড় জমছে। এমন সংকটের মধ্যেও দেশীয় কয়লা নিয়ে সরকারের তেমন কোনো ভাবনা নেই।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. শামসুল আলম আমাদের সময়কে বলেন, দেশীয় খনির কয়লা বৈজ্ঞানিক উপায়ে উত্তোলন করে বিদ্যুৎ উৎপাদনে কাজে লাগাতে পারত সরকার। কিন্তু সেটা না করে আমদানির দিকেই বেশি ঝুঁকেছে। পরিবেশ ও মানুষের অধিকার রক্ষা করে কয়লা উত্তোলন করে কাজে লাগালে আমদানির চাপ কমত। তিনি বলেন, তবে শুধু কয়লা নয়, সব ধরনের জ্বালানি বিদেশ থেকে আমদানিতে সরকারের আগ্রহ বেশি। নিজেদের তেল-গ্যাস অনুসন্ধান-উত্তোলনে আগ্রহ কম। গত এক দশকেও বিশাল সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনে সফলতা দেখাতে পারেনি। ড. শামসুল আলম বলেন, শুরু থেকেই সরকারের ভুল নীতি ও দুর্নীতির কারণে পরিকল্পিত পথে এগোয়নি বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত।
জ্বালানি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, দেশে এ পর্যন্ত ৫টি কয়লাক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছে। এসব খনিতে সম্ভাব্য মজুদের পরিমাণ প্রায় ৭ হাজার ৮২৩ মিলিয়ন মেট্রিক টন। এই বিপুল কয়লা দিয়ে কয়েক যুগ পর্যন্ত দেশের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো চালানো সম্ভব।
আরও পড়ুন:
একে আবদুল মোমেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী
অথচ এ পর্যন্ত বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি ছাড়া অন্য কোনো খনি থেকে কয়লা উত্তোলন করেনি সরকার। ২০০৫ সালের সেপ্টেম্বর থেকে বড়পুকুরিয়া থেকে কয়লা উত্তোলন করা হচ্ছে। তবে সেই কয়লা দিয়ে খনির পাশেই স্থাপিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের চাহিদা পূরণ করা যাচ্ছে না। জ্বালানি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, বড়পুকুরিয়া কয়লাখনির সেন্ট্রাল বেসিন থেকে প্রতিবছর গড়ে শূন্য দশমিক ৮ লাখ মেট্রিক টন কয়লা উত্তোলন হচ্ছে। যা বড়পুকুরিয়ার ৬২৫ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের চাহিদার তুলনায় খুব কম।
দিনাজপুরের পার্বতীপুরে বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি ১৯৮৫ সালের আবিষ্কার হয়। খনিতে মোট ৪১০ মিলিয়ন মেট্রিক টন কয়লা মজুদ রয়েছে। তবে সেখান থেকে উত্তোলন করা যাবে ১৭০ মিলিয়ন টন। সবশেষ ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান এক্সএমসি-সিএমসি কনসোর্টিয়ামের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী ২০২৭ সাল নাগাদ চার মিলিয়ন টন কয়লা উত্তোলন করা হবে। আগামী ৩০ বছরে খনি থেকে অন্তত ১৭০ মিলিয়ন টন কয়লা উত্তোলন সম্ভব বলে মনে করছে কর্তৃপক্ষ।
দিনাজপুরের নবাবগঞ্জে ১৯৯৫ সালে দীঘিপাড়া কয়লাখনি আবিষ্কৃৃত হয়। সেই খনিতে প্রায় ৭০৬ মিলিয়ন মেট্রিক টন কয়লা মজুদ রয়েছে। ১৯৯৭ সালের দিনাজপুরের ফুলবাড়িতে কয়লাখনি আবিষ্কার হয়। এই কয়লাখনিতে ৫৭২ মিলিয়ন মেট্রিক টন কয়লা মজুদ রয়েছে। পেট্রোবাংলা যাচাই করে দেখেছে যে আগামী ৩০ বছরে এই খনি থেকে তিন মিলিয়ন টন কয়লা প্রতিবছর হিসাব করে ৯০ মিলিয়ন টন কয়লা উত্তোলন করা যাবে।
এ ছাড়া রংপুরের পীরগঞ্জের খালাসপীর এলাকায় ১৯৮৯ সালে আরেকটি কয়লাখনি আবিষ্কার হয়। এই খনিতে ২৫৭ থেকে ৪৮৮ মিটার গভীরতায় গিয়ে প্রায় ৬৮৫ মিলিয়ন মেট্রিক টন কয়লার সম্ভাব্য মজুদ রয়েছে। এ ছাড়া জামালগঞ্জ কয়লাখনিতে একটি বিদেশি কোম্পানির মাধ্যমে সম্ভাব্যতা যাচাই করে দেখা গেছে, প্রায় ১২ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ৬৪০ থেকে ১১শ মিটার গভীরতায় ৫৪৫০ মিলিয়ন মেট্রিক টন কয়লার মজুদ রয়েছে। এ খনি থেকে কয়লা উত্তোলনে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের চিন্তা চলছে। জয়পুরহাটে ১৯৬২ সালে জামালগঞ্জ খনি আবিষ্কার করা হয়। এই খনি থেকে প্রায় ৫ হাজার ৪৫০ মিলিয়ন টন কয়লা উত্তোলন সম্ভব।
পেট্রোবাংলার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে জ্বালানির সংস্থান করতে না পারায় সরকার ক্রমান্বয়ে আমদানিনির্ভর হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় দেশের অভ্যন্তরে যে বিশাল কয়লার মজুদ আছে, সেটাকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত।
জ্বালানি বিভাগের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, দেশের খনিজসম্পদ উত্তোলন, খনি থেকে কয়লা উত্তোলনের মতো স্পর্শকাতর বিষয়গুলোতে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত খুব জরুরি। রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত না এলে কয়লা উত্তোলন করা কঠিন কাজ। তিনি বলেন, দেশের জ্বালানি চাহিদা পূরণ করতে আমদানি করতেই হবে। দেশীয় খনিজসম্পদ উত্তোলন করা যাচ্ছে না বলে আমদানি করা বন্ধ রাখলে দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ফলে ক্রমবর্ধমান জ্বালানির চাহিদা পূরণ করতে সরকারের হাতে আমদানির কোনো বিকল্প নেই। তবে এখন দেশীয় খনিজসম্পদ অনুসন্ধান ও উত্তোলনে সরকার আগ্রাসী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে যাচ্ছে। কারণ সামনের দিনগুলোতে মারাত্মক জ্বালানি সংকটের আশঙ্কা রয়েছে।
আরও পড়ুন:
পাল্টে যেতে পারে আন্দোলনের ধরন