চট্টগ্রামের ১১টি আসনেই স্বতন্ত্র ঝড়ে টলছে নৌকা
চট্টগ্রাম জেলা ও মহানগর মিলে মোট ১৬টি সংসদীয় আসন। একাদশ সংসদ নির্বাচনে ১৬টির মধ্যে ১৪টিতেই নৌকার প্রার্থীরা বিজয়ী হয়েছিলেন; ২টিতে জোটের প্রার্থী। কিন্তু এবার আওয়ামী লীগ নেতারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ায় চিত্র ভিন্ন দেখা যাচ্ছে। ভোটের মাঠের সমীকরণ বলছে, এবার চট্টগ্রামের ১৬টি আসনের মধ্যে ১১টিতেই স্বতন্ত্র প্রার্থীর ঝড়ে টলছে নৌকা। এই ১১টিতেই নৌকা ও জোট প্রার্থীর সঙ্গে স্বতন্ত্র প্রার্থীর হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের আভাস মিলছে।
এদিকে ভোটের লড়াইয়ে নামা দুই প্রভাবশালী মন্ত্রী এবং এক প্রতিমন্ত্রীর জয়ের পথ অনেকটাই নির্ভার, বলছে মাঠের চিত্র। চট্টগ্রাম-৭ (রাঙ্গুনিয়া) আসনে নৌকা প্রার্থী তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, চট্টগ্রাম-১৩ (আনোয়ারা-কর্ণফুলী) আসনে ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ এবং চট্টগ্রাম-৯ (কোতোয়ালি) আসনে শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। তাদের আসনে শক্ত কোনো প্রতিপক্ষ নেই। জয়ের পথে বড় কোনো বাধা নেই রাউজানের সংসদ সদস্য এবিএম ফজলে করিম চৌধুরীরও। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে আওয়ামী লীগের কোনো নেতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে না তাদের। বিএনপিবিহীন নির্বাচনে শক্ত কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায় এই তিন মন্ত্রী ও এক এমপির নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়া ‘অনেকটাই সহজ’ হয়ে গেছে বলে মনে করছেন স্থানীয় ভোটাররা।
ইসি সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রাম জেলার ১৬ আসনে এবার জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মোট ভোটার ৬৫ লাখ ৭৬ হাজার ৯২৫। তাদের মধ্যে ৩৪ লাখ ৬৩ হাজার ৫৮৩ জন পুরুষ, ৩১ লাখ ১৩ হাজার ২৮১ জন নারী এবং ৬১ জন তৃতীয় লিঙ্গ।
চট্টগ্রাম-১ (মিরসরাই) আসনে বাবার বদান্যতায় নৌকার প্রার্থী হয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের ছেলে মাহবুব রহমান রুহেল।
তবে দলীয় নেতাকর্মীদের একটি বড় অংশের সমর্থন পেয়েছেন স্বতন্ত্র ঈগল প্রতীকের প্রার্থী মোহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন। তিনি মিরসরাই উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান, চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক। ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে রাজনৈতিক শক্তি খুইয়েছেন। তবে এবার শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখা দিয়েছেন মাঠে।
চট্টগ্রাম-২ ফটিকছড়ি আসনে নৌকার প্রার্থী খাদিজাতুল আনোয়ার সনির সঙ্গে আওয়ামী লীগের দুই নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। এ ছাড়া তরিকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারি ও বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টির সৈয়দ সাইফুদ্দিন আহমেদ মাইজভাণ্ডারি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। নৌকা মার্কা ছাড়াও এখানে হোসাইন মো. আবু তৈয়ব এবং মোহাম্মদ শাহজাহান আওয়ামী লীগ নেতা এবং স্বতন্ত্র প্রার্র্থী। তাই নৌকার ভোট হয়ে যাচ্ছে তিন ভাগ। এ অবস্থায় প্রতিদ্বন্দ্বিতার আসনে চলে আসতে পারেন সুপ্রিম পার্টির প্রার্থী। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রধান ৫ প্রার্থীর বাড়ি দক্ষিণ ফটিকছড়িতে। এখানে উত্তর ফটিকছড়ির ভোট নির্ধারণ করতে পারে জয়-পরাজয়।
আরও পড়ুন:
একে আবদুল মোমেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী
চট্টগ্রাম-৩ সন্দ্বীপ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বর্তমান এমপি মাহফুজুর রহমান মিতার সঙ্গে লড়ছেন আওয়ামী লীগ নেতা ও বাংলাদেশ স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের সভাপতি মো. জামাল উদ্দিন চৌধুরী। নৌকার প্রার্থীর তুলনায় ডা. জামাল শক্ত অবস্থানে আছেন। মিতার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগকে বিভাজনের অভিযোগ আছে। সেদিক দিয়ে জামাল উদ্দিন মাঠে পরিচিতি পাচ্ছেন ক্লিন ইমেজের মানুষ হিসেবে।
চট্টগ্রাম-৪ (সীতাকুণ্ড) আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী এসএম আল মামুন। প্রাথমিক বাছাইয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী মোহাম্মদ ইমরানের মনোনয়ন বাতিল হলেও শেষ পর্যন্ত ফিরে পেয়ে ঈগল প্রতীকে লড়ছেন। এখানে নৌকার প্রার্থী অনেকটা সুবিধাজনক অবস্থানে আছেন বলে জানা গেছে।
চতুর্থবারের মতো চট্টগ্রাম-৫ (হাটহাজারী) আসনটি লাঙলের ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদকে ছেড়ে দিয়েছে আওয়ামী লীগ। তবে বিগত সময়ের মতো এবার লড়াই ছাড়া জয় পাবেন না তিনি। আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী মোহাম্মদ শাহজাহান চৌধুরীকে সমর্থন দিয়েছে উপজেলা আওয়ামী লীগ।
চট্টগ্রাম-৮ (চান্দগাঁও-বোয়ালখালী) আসনে এবার জটিল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। লাঙলকে আসনটি ছেড়ে দিয়েছে আওয়ামী লীগ। তবে প্রার্থী সোলায়মান আলম শেঠ ওই এলাকার বাসিন্দা না হওয়ায় আওয়ামী লীগের দুই স্বতন্ত্র প্রার্থীকে ঘিরেই ভোটারদের ভাবনা। আসনটিতে আওয়ামী লীগ বিভক্ত হওয়ায় সহিংসতার আশঙ্কা করা হচ্ছে। নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীন ও বর্তমান এমপি নোমান আল মাহমুদ স্বতন্ত্র প্রার্থী বিজয় কিষাণের পক্ষ নিয়েছেন। এই দুই নেতা ছাড়া নগর আওয়ামী লীগের বেশির ভাগ নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী কেটলি প্রতীকের আবদুচ ছালামের পক্ষ নিয়েছেন। কেবল তা-ই নয়, তারা দলবেঁধে এলাকায় ছালামের পক্ষে গণসংযোগও করেছেন। ফলে নগর আওয়ামী লীগের নাছিরপন্থিরা ছাড়া অন্য সব অংশই নেমেছেন ছালামকে জয়ী করতে। বোয়ালখালী অংশে রেল ও সড়ক সেতু ছালামই নির্মাণ করতে পারবেন এমন ধারণা থেকে এলাকায় নতুন করে তার পক্ষে সমর্থন বাড়ছে।
চট্টগ্রাম-১০ (ডবলমুরিং) আসনে নৌকার প্রার্থী মহিউদ্দিন বাচ্চুর সঙ্গে লড়ছেন চট্টগ্রামের সাবেক মেয়র মোহাম্মদ মনজুর আলম। আছেন সাবেক যুবলীগ নেতা ফরিদ মাহমুদও। বর্তমান সংসদ সদস্য জয়ী হতে আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। এখানে ত্রিমুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতার আভাস মিলছে। গত ৩০ জুন অনুষ্ঠিত উপনির্বাচনে সব মিলিয়ে ১১ শতাংশ ভোটগ্রহণ দেখা যায়। ভোটারদের কেন্দ্র আনতে না পারার বদনাম ঘোচাতে পারলে মহিউদ্দিন বাচ্চুর ফল ভালো হবে বলে স্থানীয়দের মত। আবার বেশি ভোটার এলে নিজেদের ভালো হবে বলে ভাবছেন অন্য দুই প্রার্থী মনজুর আলম ও ফরিদ মাহমুদ।
চট্টগ্রাম-১১ (বন্দর) আসনে তিনবারের সংসদ সদস্য এমএ লতিফের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন আওয়ামী লীগ নেতা ও ওয়ার্ড কাউন্সিলর জিয়াউল হক সুমন। নগর আওয়ামী লীগের বিবদমান সব পক্ষের সমর্থন পেয়ে শক্ত অবস্থানে আছেন সুমন।
চট্টগ্রাম-১২ (পটিয়া) আসনে টানা তিনবারের সংসদ সদস্য ও জাতীয় সংসদের হুইপ সামশুল হক চৌধুরী এবার দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে ঈগল মার্কা নিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। নৌকা পেয়েছেন সদ্য বিদায়ী উপজেলা চেয়ারম্যান মোতাহেরুল ইসলাম চৌধুরী। একসময়ের দুই রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি এখন দুই মেরুতেই কেবল নয়, নির্বাচনের মাঠও উত্তপ্ত করেছেন। একজন কৌশলী রাজনীতিবিদ হিসেবে পরিচিতি আছে সামশুল হক চৌধুরীর। ফলে মোতাহেরুল ইসলাম চৌধুরী কীভাবে তাকে নির্বাচনে মোকাবিলা করবেন তা দেখার অপেক্ষায় আছেন এখানকার ভোটাররা।
চট্টগ্রাম-১৪ (চন্দনাইশ-সাতকানিয়া আংশিক) আসনে গত দুই নির্বাচনে জিতেছিলেন আওয়ামী লীগের নজরুল ইসলাম চৌধুরী। ২০১৮ সালে নৌকার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন এলডিপির চেয়ারম্যান কর্নেল (অব) অলি আহমদ। কিন্তু এবার নজরুল ইসলাম চৌধুরীর জয়ের পথে কাঁটা হয়ে আছেন ট্রাক মার্কার প্রার্থী, সদ্য বিদায়ী চন্দনাইশ উপজেলা চেয়ারম্যান আবদুল জব্বার চৌধুরী।
চট্টগ্রাম-১৫ (সাতকানিয়া আংশিক-লোহাগাড়া) আগের দুবারের সংসদ সদস্য ড. আবু রেজা মুহম্মদ নেজামুদ্দিন নদভীর সঙ্গে এবার লড়ছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী আবদুল মোতালেব। তিনি সাতকানিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান। জানা গেছে, এ আসনে জয়ের মূল নিয়ামক হলো জামায়াতে ইসলামের ভোট। তারা ভোটকেন্দ্রে গিয়ে কাকে বেশি ভোট দেবেন তার ওপর ভোটের সমীকরণ নির্ভর করছে।
দক্ষিণ চট্টগ্রামের সবচেয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ আসন হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে চট্টগ্রাম-১৬ (বাঁশখালী)। সেখানে ত্রিমুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে। নৌকার প্রার্থী মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরীর প্রতিদ্বন্দ্বী হয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতা মুজিবুর রহমান ও আবদুল্লাহ কবির লিটন।
আরও পড়ুন:
পাল্টে যেতে পারে আন্দোলনের ধরন