সৈয়দ শামসুল হক: অন্তরঙ্গ পাঠ
প্রত্যেক মানুষের জীবনে এমন এক বয়স আসে, যখন নিষিদ্ধ সব বিষয়ের প্রতি তীব্র কৌতূহল সৃষ্টি হয়। নৈতিক ও সামাজিক বিধিনিষেধের সাঁকো পার না হতে পারায় তার অনেকগুলো অনেক সময় অধরাই থেকে যায়। তবে নিষিদ্ধ দ্রব্যটি যদি হয় বই, তা হলে হয়তো বিধিনিষেধের বেড়াগুলো টপকালে খুব একটা পাপ হয় না। আমার ঠিক সেই ওড়াউড়ির সময়, যখন ডিএইচ লরেন্স, আলবার্ত মোরাভিয়া, গী দ্য মোপাঁসা, বালজাক, প্রজাপতির সমরেশ, অতসী মামির মানিক, রাতভর বৃষ্টির বুদ্ধদেবে বুঁদ হয়ে আছি, তখন হাতে এলো সৈয়দ শামসুল হকের ‘খেলারাম খেলে যা’।
সৈয়দ শামসুল হক বহুমাত্রিক। কবিতা ও কাব্যনাটক, চলচ্চিত্র, চলচ্চিত্রের কাহিনি-সংলাপ-চিত্রনাট্য-গীতরচনা, গল্প ও উপন্যাস, অনুবাদ, প্রবন্ধ ও নিবন্ধ, ভাষণে ও শাসনে, রাজপথ ও মঞ্চ সর্বত্রই ছিলেন তিনি। ছিলেনই বা বলছি কেন, এখনো আছেন, ভবিষ্যতেও থাকবেন; কতদিন কতকাল তা এ মুহূর্তে মহাকালের মর্জিতে বলিদান করি। ‘খেলারাম খেলে যা’ পড়া শেষ হলো। ডিএইচ লরেন্সের মধ্যে যেমন সামন্ত সমাজের কদর্য চেহারার বাইরে কোনো অশ্লীলতা খুঁজে পাইনি, তেমনি আমার চারপাশের বাবর আলীদের চিনতে সৈয়দ শামসুল হকের ভূমিকা একজন ট্রাফিকের মতোই ছিল সে সময়। সৈয়দ হক বাংলাদেশের চোখ দিয়ে গ্রামের প্রকৃতি ও মানুষকে দেখতে চেয়েছেন। এ দেশের সোনালি রৌদ্রের কড়া তেজে তেতে নিয়েছেন নিজেকে; মুক্তিযুদ্ধ এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদকে করেছেন আজীবনের সঙ্গী। সর্বদাই থাকতে চেয়েছেন প্রধানের ভূমিকায় সাধারণে অনন্যতা নিয়ে। এ মুহূর্তে আমার লিখতে ইচ্ছে হচ্ছে : নিষিদ্ধ শিল্পিত হলেও তার মাদকতা বেশি, সৈয়দ হক আপনি নিষিদ্ধ নন কখনো তবু কেন আপনি আমাকে এমন টানেন তীব্র!
দুই. ইতোমধ্যে বের হওয়া সৈয়দ শামসুল হক রচনাবলির পুরোটা থেকে এ মুহূর্তে আমার দ্রুত পাঠে তালিকাবদ্ধ করছি তার ৪টি উপন্যাস, ৪০টির মতো গল্প, ৩টি কাব্য এবং ৪টির মতো কাব্যনাটক। ‘খেলারাম খেলে যা’ পড়েছিলাম সেই ওড়াউড়ি বয়সে। পরে আরও একবার। সীমানা ছাড়িয়ে, এক যুবকের ছায়াপথ, কয়েকটি মানুষের সোনালি যৌবন পড়েছি। ‘বৈশাখে রচিত পঙ্ক্তিমালা’ ও ‘পরানের গহীন ভিতর’ এ দুটি কবিতার বই আমার প্রিয় বইগুলোর তালিকায় ওপরের দিকে সব সময় রয়েছে। ‘তিন পয়সার জোছনা’, ‘প্রণীত জীবন’ পড়েছি। তবে কিছুটা বিস্ময়ে, ভয়ে, বিহ্বলতায় পড়েছি তার কাব্যনাটকগুলো।
‘লেখা আমার কাছে প্রেমে পড়বার চেয়েও অনেক বেশি উত্তেজক ও ব্যক্তিগত দূরাভিলাষী ও উড্ডয়নশীলা’ এ কথা আমার নয়, যাকে নিয়ে এই নিবন্ধ, তারই। কেন এই উত্তেজনা, কেন মনে হলো তিনি পাখির মতো মুক্ত স্বাধীন? কারণ সৈয়দ শামসুল হক বিশ্বাস করতেন, তারাই ছিলেন সেই অগ্রপথিক, যারা অরণ্য কেটে, মাটি কুপিয়ে জমি প্রস্তুত করেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের। প্রবল পাকিস্তানিদের কুৎসিত রোমশ হাত থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে বাঁচিয়ে রাখার যে যুদ্ধ, তা তো ছিল প্রকৃতই মুক্তিযুদ্ধ এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। রাজনীতিবিদদের অনেক আগেই তো সেই যুদ্ধ শুরু করেছিলেন সৈয়দ শামসুল হক ও অন্যরা তার সহযোগীরা।
আরও পড়ুন:
আমার ভেতরে কেউ কাঁদছে
‘মার্জিনে মন্তব্য’ সৈয়দ শামসুল হকের এমন এক প্রবন্ধের বই, যা পড়তে পারাটাই পরম সৌভাগ্যের অন্তত তাদের কাছে, যারা কিছু লিখতে চান। ভাবনা বা বক্তব্য প্রকাশের সবচেয়ে স্বচ্ছ মাধ্যম হচ্ছে রাজনৈতিক মঞ্চ। আপনি কথা বলতে পারেন, সাধারণ মানুষকে পরামর্শ দিতে পারেন, শোনাতে পারেন নির্ভরতার বাণী, ডাক দিতে পারেন, গন্তব্য না জেনেও বেরিয়ে আসবে কেউ কেউ, আসমুদ্র হিমাচল প্রতিশ্রুতি দিতে পারেন একটিও পূরণ করবেন না জেনেও, এর জন্য বিশেষ কোনো কলা বা কৌশলের প্রয়োজন নেই। শ্রোতারা সবকিছু এরই মধ্যে অনেকটাই বুঝে ফেলেছেন। কিন্তু লেখা? যদি প্রকৃতই লেখা হয়, তা হলে যিনি লিখবেন, তাকে জানতে হবে এবং অবশ্যই জানতে হবে লেখার কিছু কলাকৌশল। সৈয়দ শামসুল হক ‘মার্জিনে মন্তব্য’-এ আমাদের শিখিয়েছেন এমনই কিছু কলাকৌশল। কী আছে বইটিতে? এক কথায় বলতে হয়, বাংলা সাহিত্যের হীরে-মানিক বোঝাই কনভয় থেকে প্রয়োজনমতো তুলে এনেছেন কখনো চিহ্ন, কখনো উদাহরণ। আর এতে প্রয়োজনমতো ঠেসে দিয়েছেন নিজস্ব ভাবনার বুদবুদ। মার্জিনে মন্তব্য, গল্পের কলকব্জা এবং কবিতার কিমিয়া এ তিন ভাগে বিভক্ত এই বই। সৈয়দ হক ক্রিয়াপদের কালচেতনা ও কালরূপ সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা দিয়েছেন। গল্পের মধ্যে তার নিপুণ প্রয়োগে কীভাবে ঐন্দ্রজালিক ভুবনের সৃষ্টি হতে পারে, তাও দেখিয়েছেন তার ক্রিয়াপদবিষয়ক ভাবনায়। একবার ভাবুন তো ছোটবেলায় ব্যাকরণে পড়া ক্রিয়াপদ নিয়ে এমন ভাবনা কেউ ভেবেছে কিনা? এ মুহূর্তে যা বলা অনিবার্য ভাবছি : আপনিই বলেছেন, ‘গুরু সব সময় প্রত্যক্ষ কেউ নাও থাকতে পারেন।’ সৈয়দ শামসুল হক আপনাকে আমি আমার অন্যতম গুরু মানি।
তিন. কাব্যনাটক সম্পূর্ণ আধুনিক সাহিত্য-দর্শনের অবদান। কবিতার অমিত শক্তি ও সম্ভাবনা নাট্য সাহিত্যে সুচিন্তিত প্রাকরণিক কৌশল প্রয়োগে নতুন আঙ্গিকে উপস্থাপনযোগ্য করে তোলার মাধ্যমে টি. এস. এলিয়টই প্রথম কাব্যনাটকের সূচনা করেন। মূলত বিবর্তনের ধারাবাহিকতায় ইতিহাস-ঐতিহ্য-নৃতত্ত্ব-মিথের সমন্বয়ে সৃষ্ট ভাষা ও চিন্তার দুর্বোধ্যতার কারণে কবিতাবিমুখ কবিতার পাঠককে কবিতামুখী করতে কাব্যনাটকের জন্ম ছিল এক ভীষণ অভিঘাত। বাংলা সাহিত্যে এই অভিঘাতের প্রথম পূর্ণাঙ্গ প্রধান সৈয়দ শামসুল হক। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তিনি শুধু ধারণই করেননি, তাকে সাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়ে নিজেই হয়েছেন নন্দিত। প্রগতিশীল চিন্তা এবং মুক্তবুদ্ধিচর্চায় অনুপ্রাণিত মানুষ তাকেই শেষ পর্যন্ত সাংস্কৃতিক নেতা মেনেছেন। আর এসবই তার প্রতিটি সৃষ্টির অক্ষরে অক্ষরে প্রবলভাবে জড়িত।
সাহিত্যের সব শাখায় তিনি বিচরণ করেছেন নায়কের মতো। তবে অনেক বোদ্ধা মানুষের সঙ্গে আমিও একমত যে, প্রধানত কাব্যনাটকই তার সৃষ্টির মধ্যে শ্রেষ্ঠতম। কবি-প্রাবন্ধিক, আত্মকথার লেখক, অনন্য বোহেমিয়ান বেলাল চৌধুরী যথার্থই বলেছেন, ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ কিংবা ‘নূরলদীনের সারাজীবন’-এর মতো কাব্যনাটক যিনি লিখতে পারেন, তিনি যে কত বড় মাপের লেখক ও নাট্যকার, তার বিশদ করাটা বাহুল্যেরই নামান্তর।’
আরও পড়ুন:
দ্য স্প্যারোস নেস্ট
‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে লিখিত। সতেরো গ্রামের মাতব্বর, পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক মিথ্যা বিয়ে ও ধর্ষণের শিকার মাতব্বর কন্যা, পাইক, রহস্যময় পীর সাহেব, একদল তরুণের মনোবিশ্লেষণই এই কাব্যনাটকটির প্রাণ। ক্ষমতালোভী স্বাধীনতাবিরোধী পাকিস্তান এবং ধর্মরক্ষার নামে আত্মজাকে পাকিস্তানি পশুদের হাতে তুলে দেওয়ার অপরাধে গ্রামবাসীর হাতে মাতব্বরের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে নাটকটি শেষ হয়। নাটকটিতে মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে এ দেশের সমাজ, সংস্কৃতি ও জীবনবোধকে উপস্থাপিত করতে গিয়ে সৈয়দ হক যথার্থই মাতব্বর কন্যার মৃত্যু ঘটিয়েছেন এবং এরই প্রতিক্রিয়ায় সব ভীরুতা ও জড়ত্বকে জয় করে সাধারণ মানুষকে প্রতিরোধের সাহসী সৈনিকে রূপান্তর করেছেন। তাই গ্রামবাসীর কণ্ঠে ধ্বনিত হতে শুনি : ‘আছে দরকার। আছে জরুরি কারণ/ যতটা না তুমি মন্দ বইলা দিবা তোমার জীবন/ তার চেয়ে, তোমারে যে মন্দ হইতে দিচ্ছি সর্বজন/ তারই জন্যে চাই আইজ তোমার মরণ।’ (পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়)
কবিতার সত্যকে বিশ্বস্ততার সঙ্গে নাট্যাঙ্গিকে অনুভবের নৈবেদ্যে পরিবেশন কাব্যনাটকের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য। এই উদ্দেশ্যে সফল ও সার্থক সৈয়দ হকের কাব্যনাটক ‘নূরলদীনের সারাজীবন’-এ। ‘নূরলদীনের সারাজীবন’ নাটকে সৈয়দ হক কয়েকটি কাল্পনিক চরিত্রকে স্থান ও নাট্য ঘটনার সত্যতায় ইতিহাসের সাবলটার্নিক বয়ান করেছেন। নাটকটি অ্যাবসার্ডধর্মী। নূরলদীন একজন কৃষক নেতা। আপদ বিপ্লবী হলেও তিনি নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনে বিশ্বাসী। ইংরেজ বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতিজনিত উত্তেজনা নাটকের মূল আখ্যান। নূরলদীন তার জীবনকথা বর্ণনা করেন এবং এই বর্ণনার সূত্রে তুলে আনেন এ দেশীয় দালাল ও শাসকশ্রেণির অত্যাচারের নির্মম কাহিনি। নাটকটিতে যেমন ইংরেজ শোষণের কথা রয়েছে, তেমনি রয়েছে বেতনভুক্ত ইংরেজ কর্মচারী ‘গুডল্যাড’র সন্তোষজনক পারিশ্রমিক না পাওয়ায় ক্ষোভের কথা। সাম্রাজ্যবাদীদের কাছে লাভক্ষতিটাই মুখ্য, দেশ-জাতি-জাতীয়তাবাদভেদে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন প্রত্যাশিত নয় সেই সত্যটিই তুলে ধরা হয়েছে নিপুণভাবে। তবে সৈয়দ হকের আলোচ্য দুটি নাটকের মধ্যে যে ঐক্য দেখি তা হচ্ছে, উভয় ক্ষেত্রে (প্রথমটিতে মাতব্বরের কন্যা এবং এ ক্ষেত্রে নূরলদীনের) একটি বিশেষ চরিত্রের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে জেগে ওঠে আমজনতা। সাধারণ প্রজার নিঃস্ব হওয়া এবং ভয়াবহ মন্বন্তরের বিশ্বস্ত বিবরণ : ‘ধান বেচিয়া খাজনা দিলাম, সন্তানে কি খায়/ ঋণ করিতে চাষী আবার সানকি ধরি যায়,/ সানকি ধরি যায় রে চাষী মহাজনের ঘরে/ সানকি ধরি যায় রে চাষী জমিদারের ঘরে/ সানকি ধরি যায় রে চাষী কুটিয়ালের ঘরে/ দুগনা দামে স্বীকার হয়া ধান কর্জ করে।/ কর্জ কিসে শোধ করিবেন? কর্জ আবার হয়;/ গরু দিলেন, জমি দিলেন, দিলেন সমুদয়’ (নূরলদীনের সারাজীবন)।
সব্যসাচী একটা জ্যাকেট তার গায়ে সেঁটে ছিল বরাবর। জ্যাকেটের ভেতরের মানুষটি একজন কবি। মোটা জিন্সের শার্ট প্রায় একই রকমের প্যান্ট আলাদা চলন আলাদা ভঙ্গি বলার তার কবিতার মতোই চিহ্নিত চিত্রিত হয়ে আছে আমাদের চোখে, হৃদয়েও। সাহিত্যে চিরজীবী হয়ে থাকবেন সৈয়দ শামসুল হক।