আওয়ামী লীগের ইশতেহার ও প্রাসঙ্গিক কথা

আবুল মোমেন
২৮ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০
শেয়ার :
আওয়ামী লীগের ইশতেহার ও প্রাসঙ্গিক কথা

নির্বাচন যেমনই হোক আওয়ামী লীগ ইশতেহার প্রণয়ন ও নির্বাচনী লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণে যেমন সিরিয়াসনেসের তেমনি পরিপক্বতার পরিচয়ও দিয়ে যাচ্ছে। যদিও গতবার অর্থাৎ ২০১৮-র নির্বাচনের সময়ও মানুষের প্রত্যাশা ছিল উন্নয়নের পাশাপাশি সুশাসন নিশ্চিত করার ঘোষণা থাকবে। এবারে তারা আর্থিক ক্ষেত্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। সেই সাথে দুর্নীতি রোধের কথাও বলেছে। তবে সার্বিক সুশাসন প্রতিষ্ঠিত না হলে দুর্নীতি দূর হবে না, এবং দুর্নীতি দূর করা না গেলে আর্থিক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা দুরূহ হবে। কারণ এ খাতের বেহাল দশার পেছনে কিছু ব্যবসায়ী, ব্যবসায়ী-কাম-রাজনীতিক এবং আমলা ও ব্যাংক কর্মকর্তার যোগসাজশ কাজ করেছে। এঁরা নানা সূত্রে দেশের ক্ষমতাশালী এবং তাই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। এঁদের দাপুটে কর্তৃত্বের কাছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দুর্বল ব্যবস্থাপনা ও নজরদারি এঁটে উঠতে পারে না। দুর্নীতির শিকড় অনেক গভীরে, এবং তা এতটাই ছড়ানো-জড়ানো যে এ খাতে সুশাসন

প্রতিষ্ঠায় সরকারপ্রধানের সদিচ্ছার দৃঢ়তা ও নৈতিক অবস্থানের সমর্থন লাগবে। কাজটা কঠিন হলেও আওয়ামী লীগ যে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে তাতে আশায় বুক বাঁধতে হয়, কেননা এক্ষেত্রে আর গাফিলতি হলে অর্থনীতির চরম বিপর্যয় ঠেকানো যাবে না।

গতবার আওয়ামী লীগের স্লোগান ছিল ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা। এবারে বলা হচ্ছে স্মার্ট বাংলাদেশ। বাংলাদেশ এক্ষেত্রে নানা পদক্ষেপ নিয়েছে, কাজও হয়েছে অনেক, তবে এতে অগ্রগতি সব ক্ষেত্রে সমানভাবে হয়নি। এটি আদতে শাসনব্যবস্থার একটি গুণগত রূপান্তরের কাজ, কিন্তু আমাদের জানা মতে দলের নানা স্তরের নেতাকর্মীদের মধ্যে এখনো বিপুল সংখ্যক আছেন যারা একে স্লোগানের বেশি কাজকর্মে ধারণ করতে পারেন না। এ হলো নতুন প্রজন্মের কাজ, যাতে বয়স্কদের ভূমিকা নীতিনির্ধারণ পর্যায়ে থাকাই শ্রেয়। কিন্তু আজকাল রাজনীতিতে নীতি-আদর্শের দাম নেই, সবার আকর্ষণ নানা উন্নয়ন পরিকল্পনার দিকে, কেনাকাটা ও নির্মাণের দিকে। প্রযুক্তি হস্তান্তরের বা প্রযুক্তিবান্ধব ও প্রযুক্তি-দক্ষ প্রশাসন গড়ে তুলে তাকে সর্বোচ্চ দক্ষতায় কাজ করার পরিবেশ দিতে হলে তামাদি রাজনীতিবিদদের বিষয়ে সচেতন হতে হবে। সত্যিই যদি ডিজিটালাইজেশন ঠিকভাবে হয় ও সে অনুযায়ী কাজকর্ম চলে তা হলে ব্যবস্থার কারণেই দুর্নীতির আশঙ্কা কমবে। কিন্তু এখনো আমরা প্রশাসনের নানা ক্ষেত্রে দুর্নীতির রামরাজ্য দেখতে পাই। এ থেকে আওয়ামী লীগ এবং দেশকে বের হতে হবে।

এবারের ইশতেহারে যুবসমাজের দিকে বিশেষ নজর দেওয়া হয়েছে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের উপযোগী জনবল গড়ে তোলা, যুবাদের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি, কৃষি ও শিল্প খাতের বিস্তার এবং অবশ্যই ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে এগিয়ে চলাই হবে নতুন সরকারের লক্ষ্য। আগামী সরকার যে আওয়ামী লীগই গঠন করবে তা এক রকম পরিষ্কার। প্রচারের আবহ দেখে মনে হচ্ছে না বিএনপি ও তার মিত্ররা আন্দোলনে শক্ত অবস্থান নিতে পারছে। আমরা অবশ্য আগেও বলেছি যে, আওয়ামী লীগ সরকারের সমালোচনার অনেক দিক থাকলেও বর্তমানে দেশে এমন পরিস্থিতি বিরাজ করছে না যে, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান বা নব্বইয়ের গণআন্দোলনের মতো কিছু একটা ঘটে যাবে। তাদের প্রচার ও কার্যক্রম সত্ত্বেও ঘটনা হবে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে যাবে। এখন দেখার বিষয় হলো আওয়ামী লীগের কৌশলে ভোটাররা নির্বাচনমুখী হচ্ছেন কিনা, হলে কত শতাংশ ভোটার হচ্ছেন। তবে এবার যেহেতু প্রকৃত প্রতিপক্ষ নেই, সব প্রার্থীই নিজেদের লোক, তাই নির্বাচন অনেকাংশেই সুষ্ঠু হবে- অংশগ্রহণমূলক না হলেও। ফলে নির্বাচন ঘিরে পরবর্তী আন্দোলন দানা বাঁধানোও কঠিন হবে।

তবে শেষ কথা হলো, অবকাঠামোর উন্নয়ন, বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি, দরিদ্রবান্ধব নানা কর্মসূচি, বিভিন্ন সংকট মোকাবিলায় সাফল্য সত্ত্বেও বিএনপির অংশগ্রহণে নির্বাচনে বিজয়ের ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী নয় আওয়ামী লীগ। দ্রব্যমূল্য নিয়ে সাধারণ মানুষের ক্ষোভ আছে, কিন্তু তার চেয়ে অনেক বেশি ক্ষোভ ও ভয় হলো আওয়ামী লীগ ও তার বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের অনেক নেতাকর্মীর দাপুটে কর্তৃত্ববাদী ভূমিকা নিয়ে। তাদের কাজকর্মই সাধারণ মানুষকে আওয়ামী লীগের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে, মাঠপর্যায়ে ভীতি ও এড়িয়ে চলার মনোভাব সৃষ্টি করেছে। সাধারণত কোনো দল দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকলে এ পরিস্থিতি তৈরি হয়। পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট এরই খেসারত দিয়েছে, ভবিষ্যতে সর্বভারতে বিজেপিও দেবে। বিএনপিকে দূরে রেখে বা ঠেলে সুষ্ঠু নির্বাচনের কৌশল ভবিষ্যতেও কাজ দেবে, এমনটা ভাবার কারণ নেই। ক্ষমতার বাইরে থেকে বিএনপি বিপুপ্ত হবে বা ভেঙে যাবে অর্থাৎ মুসলিম লীগে পরিণত হবে সেই সুখস্বপ্নেরও ভিত্তি নেই। আওয়ামী লীগ বিরোধী রাজনীতি কোন নামে হবে সেটা ভিন্ন বিষয়, কিন্তু এদেশে যে মুসলিম জাতীয়তা ও ভারতবিরোধী মনোভাব যথেষ্ট আছে এবং তা ইদানীং আরও বেড়েছে সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আলোকে সমাজ গঠনে মনোযোগ না দিলে ব্যাপক উন্নয়ন সত্ত্বেও রাজনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতি হবে না।