রোগীদের দুর্ভোগে নজর নেই ঔষধ প্রশাসনের
প্রায় দুই সপ্তাহ হলেও হৃদরোগের চিকিৎসায় অত্যাবশ্যকীয় ডিভাইস হার্টের রিঙের (স্টেন্ট) নতুন মূল্য নির্ধারণ নিয়ে সৃষ্ট জটিলতার অবসান হয়নি। ফলে আমদানি বন্ধ রেখেছে ২৭টির মধ্যে ২৪ প্রতিষ্ঠান। চিকিৎসকরা বলছেন, আগে যেখানে সারাদেশে দৈনিক ৮০টির মতো রিং পরানো হতো, এখন ৫০টিতে নেমেছে। বিশেষ করে দরিদ্র ও নিম্নআয়ের মানুষের চিকিৎসার ভরসা সরকারি হাসপাতালের অবস্থা খুবই শোচনীয়। রিঙের পাশাপাশি আমদানি বন্ধ রয়েছে রিং পরানোর ক্ষেত্রে অবশ্য প্রয়োজনীয় বেলুন ও তার। যার ৮০ শতাংশই আসে ইউরোপীয় দেশগুলো থেকে। কিন্তু ১২ দিন ধরে রিং আমদানি বন্ধ থাকায় এসব উপকরণও আসছে না। এতে করে চরম সংকটে আছেন অসংখ্য হৃদরোগী। কিন্তু তাদের এ ভোগান্তি হৃদয়ঙ্গম হচ্ছে না সরকারের নিয়ন্ত্রক
সংস্থা ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের (ডিজিডিএ)। টেকনিক্যাল কমিটির ওপর দায় চাপিয়েই নীরব এ সংস্থা। উপরন্তু সংস্থাটির প্রধান জানান, এ সংকট তাদের চোখে পড়েনি।
গত ১২ ডিসেম্বর হার্টের রিঙের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য নির্ধারণের পর ১৬ ডিসেম্বর থেকে তা কার্যকর করেছে ডিজিডিএ। এতে উৎপাদনকারী ২৭টি প্রতিষ্ঠানের ৪৪ ধরনের হার্টের রিঙের দাম ৩ থেকে ৪৬ শতাংশ পর্যন্ত কমানো হয়েছে। কিন্তু কতিপয় চিকিৎসকের অনৈতিকতার মাধ্যমে এ মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে বলে অভিযোগ তুলেছে ২৭টির মধ্যে ২৪ কোম্পানি। এর মাধ্যমে তিনটি কোম্পানিকে সুবিধা দেওয়ার অভিযোগও তুলেছে ওই ২৪ কোম্পানি। ১৭ ডিসেম্বর ওশান লাইফ লিমিটেডসহ ১১ আমদানিকারী প্রতিষ্ঠান হাইকোর্টে এর বিরুদ্ধে রিট করেছে। শুধু তাই নয়, এ মূল্য নির্ধারণের পর থেকে আমদানি বন্ধ রেখেছে ২৩ কোম্পানি। এরপর ১১ দিন পেরিয়ে গেলেও কোনো ধরনের সুরাহা হয়নি। মোট চাহিদার অর্ধেক রিং আমদানি করে থাকে এসব কোম্পানি। অন্যদিকে ডিজিডিএ কর্তৃক নির্ধারণকৃত মূল্যকে স্বাগত জানিয়েছে আমেরিকার উৎপাদনকারী কোম্পানি থেকে আমদানিকারী তিন প্রতিষ্ঠান কার্ডিয়াক কেয়ার লিমিটেড, মেডট্রোনিক বাংলাদেশ প্রাইভেট লিমিটেড এবং মেডি গ্রাফিক ট্রেডিং লিমিটেড। এ তিন কোম্পানির সরবরাহ প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। তাই যারপরনাই বিপাকে পড়েছেন হৃদরোগীরা। কম দামে ভালো মানের হার্টের রিং পাওয়া যাচ্ছে না বলে যারা কিনতে পারছেন না, তারা অপেক্ষায় রয়েছেন এ জটিলতা অবসানের।
আমদানিকারকরা জানিয়েছেন, লোকসান দিয়ে রিং আমদানি করা সম্ভব নয়। দাম সমন্বয় না করা পর্যন্ত আমদানি বন্ধ থাকবে। অচলাবস্থা নিরসনে যাদের পদক্ষেপ নেওয়ার কথা সেই মূল্য নির্ধারণ কমিটি ও ডিজিডিএর কোনো উদ্যোগ নেই। একে-অপরের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছে।
আরও পড়ুন:
একে আবদুল মোমেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী
এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রিঙের মূল্য নির্ধারণে গত ৫ মার্চ ডিজিডিএ মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ ইউসুফকে প্রধান করে ১৩ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির বাকি সদস্যদের মধ্যে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ^বিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) কার্ডিওলজি বিভাগের প্রধান এবং হার্ট ফাউন্ডেশনের চিফ কনসালট্যান্টসহ সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালের খ্যাতনামা কার্ডিওলজিস্টরা।
সব সদস্যের মতামতের ভিত্তিতে দাম নির্ধারণ হওয়ার কথা থাকলেও তা হয়নি। মাত্র ৫ সদস্যের নেওয়া মতামতের ভিত্তিতে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বলে জানিয়েছেন কমিটির একাধিক সদস্য। অর্থাৎ অধিকাংশ সদস্যের মতামত নেওয়া হয়নি। অভিযুক্ত তিন কোম্পানিকে সুবিধা দিতেই ডিজিডিএ অধিকাংশের মত নেওয়ার প্রয়োজন মনে করেনি বলে অভিযোগ করেছেন তারা।
এ কমিটির সদস্য হার্ট ফাউন্ডেশনের চিফ কনসালট্যান্ট অধ্যাপক ডা. ফজিলা-তুন-নেছা। মূল্য নির্ধারণের বৈঠকে তিনি ডাক পাননি বলে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন। তাই কীভাবে রিঙের নতুন দাম নির্ধারণ হয়েছে তা তার জানা নেই বলে জানান এ চিকিৎসক।
চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশে সরকারি-বেসরকারি মিলে প্রতি বছর ৩০ হাজারের বেশি হার্টের রিঙের প্রয়োজন হয়। এর অর্ধেক আসে ইউরোপ থেকে, অর্ধেক যুক্তরাষ্ট্র থেকে।
জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের (এনআইসিভিডি) কার্ডিওলজি বিভাগের এক অধ্যাপক বলেন, ‘অনেক রোগীর লম্বা রিঙের প্রয়োজন হয়। ৪৮ মিলিমিটারের এই রিং আসে ইউরোপের দেশগুলো থেকে। এসব রিঙের দাম ছিল ৭০ হাজার টাকা। এখন না থাকায় একমাত্র ভরসা আমেরিকার তিন কোম্পানির রিং। কিন্তু সঠিক আকারের পর্যাপ্ত রিং না পাওয়ায় একটির জায়গায় দুটি রিং লাগছে। একেকটির দাম ৯৩ হাজার থেকে ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা। ফলে বাধ্য হয়ে রোগীদের জীবন বাঁচাতে গিয়ে দুই থেকে তিনগুণ খরচ হচ্ছে শুধু রিঙের পেছনেই। ফলে অনেক রোগী এখন ফেরত যাচ্ছেন।
তিনি আরও বলেন, ‘সরবরাহ কমে যাওয়ায় ৩০ শতাংশের মতো রিং লাগানো কমে গেছে। শুধু তাই নয়, মারাত্মক প্রভাব পড়েছে রিং পরাতে অবশ্য প্রয়োজনীয় বেলুন ও তারেরও। জীবন রক্ষাকারী এসব চিকিৎসা উপকরণের ৮০ শতাংশই আসে ইউরোপীয় রিং আমদানিকারক কোম্পানিগুলোর মাধ্যমে। বাকি ২০ শতাংশ আমেরিকা থেকে আসে।
সংকটের কথা স্বীকার করেন প্রতিষ্ঠানটির এনআইসিভিডির পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীর জামাল উদ্দিন। আমাদের সময়কে তিনি বলেন, শীতকালে এমনিতেই রিং পরানো হয় কম। এর মধ্যেই আবার আমদানি বন্ধ থাকায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। স্বাভাবিক সময়ে আগে যেখানে দৈনিক ১৫টির মতো রিং পরানো হতো, এখন ৭ থেকে ১০টিতে নেমেছে। সংকটের মুখে বেলুন ও তার। এভাবে বন্ধ থাকলে আরও ভুগতে হবে। ডিজিডিএ উদ্যোগ নিলে আমরা বসব, জানান তিনি।
মূল্য সমন্বয়ের বিষয়ে গতকাল মঙ্গলবার ডিজিডিএতে গিয়েছিল ইউরোপ থেকে রিং আমদানিকারী একাধিক কোম্পানি। তাদের একজন কার্ডিয়াক সল্যুশন লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী জিল্লুর রহমান। তিনি বলেন, ‘আমরা চাই মার্ক-আপ অনুযায়ী সরকার সব ধরনের রিং সরবরাহের সিদ্ধান্ত নিক। কিন্তু কাউকে অতিরিক্ত সুবিধা দিয়ে আবার কাউকে ক্ষতিগ্রস্ত করে সিদ্ধান্ত নেওয়া কোনোভাবেই কাম্য নয়। সরকারি হাসপাতালগুলোতে কোনো ধরনের সার্ভিস চার্জ দিতে না হলেও বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে আলাদা সাড়ে ৭ শতাংশ পর্যন্ত দিতে হচ্ছে। রিং নিয়ে এমন জটিলতার জন্য চিকিৎসকদের একটি অংশ দায়ী। তাদের ব্যবসায়িক চিন্তা ও কমিশনের কারণে সাধারণ মানুষকে কম টাকার রিংও বেশি দাম দিয়ে কিনতে হচ্ছে। সরকার প্রকৃতপক্ষে দাম নির্ধারণ করলে সব ধরনের তো অবশ্যই, সবচেয়ে ভালো রিংও ৭০ হাজার টাকার মধ্যে কিনতে পারবে সাধারণ মানুষ।
মেডিক্যাল ডিভাইস ইম্পোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ওয়াসিম আহমদ বলেন, টেকনিক্যাল কমিটির সঙ্গে ডিজিডিএ বসে হার্টের রিঙের দাম সমন্বয় করুক। এ জন্য আমরা তাদের কাছে গিয়েছিলাম। তারা আমাদের আশ^স্ত করেছে। রোগীদের জিম্মি করে আমরা ব্যবসা করতে চাই না। কিন্তু একশ টাকার জিনিস কিনে তো ৮০ টাকায় বেচতে পারি না। সমন্বয় না হওয়া পর্যন্ত আমদানি বন্ধ থাকবে। দাম সমন্বয়ের দায়িত্ব ডিজিডিএর। তারা চাইলে টেকনিক্যাল কমিটির সঙ্গে যে কোনো মুহূর্তে বসতে পারে।
ডিজিডিএ মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ ইউসুফ আমাদের সময়কে বলেন, আমি একা কোনো সিদ্ধান্ত নিইনি। কমিটি যেভাবে বলেছে, সেভাবেই মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে। বৈঠকে দাম ঠিক করার সময় কমিটির সদস্যরা বলেছেন, কোনো অসুবিধা হবে না। তারা চালাতে পারবেন। এ ক্ষেত্রে আমার কিছু করার নেই। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তারা যদি পুনর্মূল্যায়ন করেন, সেভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
আরও পড়ুন:
পাল্টে যেতে পারে আন্দোলনের ধরন
চলমান পরিস্থিতিতে রোগীদের দুর্ভোগ হচ্ছে না বলে দাবি করেন মহাপরিচালক। বলেন, কার্ডিওলজিস্টরা বলেছেন দুর্ভোগ হচ্্ভোগ হচ্ছে না, হলে জানাবেন। ভারতের সঙ্গে দামের পার্থক্যের ব্যাপারে তার কিছু বলার নেই বলেও জানান তিনি।