দুষ্টচক্রের কবলে ব্যাংক খাত

ইআরএফের সঙ্গে মতবিনিময়ে ড. মোস্তাফিজুর রহমান ।। অব্যবস্থাপনা অনিয়মে খেলাপি ঋণ বাড়ছে ।। আমেরিকা নিজেদের সুবিধার জন্য স্যাংশন দেয়

নিজস্ব প্রতিবেদক
২৭ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০
শেয়ার :
দুষ্টচক্রের কবলে ব্যাংক খাত

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থীদের হলফনামায় সম্পদ বৃদ্ধির হার দেখে বিস্মিত হয়েছি। যেখানে এক কাঠা জমির দাম এক কোটি টাকা; সেখানে এক লাখ টাকা দেখানো হয়েছে। এর পরও যদি সম্পদ শতগুণ বেড়ে থাকে, তা হলে বাস্তব চিত্র কী?- এমন মন্তব্য করেছেন অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান।

ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর পল্টনে দেশের সমসাময়িক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে মতবিনিময়সভার আয়োজন করে। এতে আলোচক ছিলেন বেসরকারি সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান। আলোচনাকালে তিনি বলেন, হলফনামায় প্রাপ্ত তথ্যে দেখা গেছে অনেক প্রার্থীর সম্পত্তি কয়েকশ গুণ বেড়েছে। কীভাবে এত কম সময়ে বিপুল পরিমাণ সম্পত্তি বাড়ল তা দেখার বিষয়। যেসব নেতার সম্পত্তি এত বেড়েছে, সরকার ও সেই দলের উচিত এসবের উৎস জানতে চাওয়া। একই সঙ্গে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) কাজ হবে তাদের সম্পত্তির উৎস বের করা। তাদের সম্পত্তি দুর্নীতির মাধ্যমে হয়েছে কি না- তা জানা এবং সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া।

এ ছাড়া দেশের ব্যাংক খাত ‘একটি দুষ্টচক্রের’ কবলে পড়েছে বলে মনে করেন তিনি। বলেন, ব্যাং?ক খাতে অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম, দুর্নীতি, অর্থপাচার- এসব কিছু এ চক্রই সৃষ্টি করছে।

ইআরএফ সভাপতি মোহাম্মদ রেফায়েতউল্লাহ মৃধার সভাপতিত্বে এবং সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেমের সঞ্চালনায় আয়োজিত অনুষ্ঠানে ড. মোস্তাফিজুর রহমান আরও বলেন, ব্যাংক খাতে অব্যবস্থাপনা অনিয়ম চলছে, খেলাপি ঋণ বাড়ছে, কিছু ব্যাংক বিপর্যয়ের মধ্যেও পড়েছে। আর্থিকভাবে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে একীভূত করার বিষয় আগে অনেকবারই বলা হয়েছে। এজন্য আইনি দুর্বলতা ও নিয়মনীতিগুলো ঠিক করতে হবে।

তিনি বলেন, ঋণখেলাপের বিপরীতে একটি বড় অংকের অর্থ ব্যাংকের প্রভিশনিং করতে হচ্ছে। এর অর্থ হচ্ছে টাকাটা অর্থনীতিতে অংশগ্রহণ করতে পারছে না। ব্যাংকে পড়ে থাকছে। এর ফলে একদিকে ব্যাংকের ঋণ দেওয়ার সক্ষমতা কমে যাচ্ছে। অন্যদিকে আয়ও কমে যাচ্ছে।

মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ব্যাংক খাত নিয়ন্ত্রণের মূল দায়িত্ব কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। তাদের স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে। এখানে হস্তক্ষেপ করা যাবে না। তিনি বলেন, ২০০৮ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ১৫ বছরে বিভিন্ন আর্থিক অনিয়মের মাধ্যমে ব্যাংক খাত থেকে ৯২ হাজার ২৬১ কোটি টাকা লোপাট সংক্রান্ত সিপিডি যে তথ্য প্রকাশ করেছে, সেটা বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যম প্রকাশিত তথ্য থেকে নেওয়া হয়েছে। আমরা নিজেরা কোনো গবেষণা করিনি। ২০০৮ সালে যখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে, তখন দেশে খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার কোটি টাকা। বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ নেওয়ার পরও বর্তমানে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে হয়েছে এক লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা।

সিপিডির এই সম্মানীয় ফেলো বলেন, আমরা যে ব্যাংক খাতে লোপাটের কথা বলেছি, তা কোন সূত্র থেকে বলেছি, সে তালিকাও আমাদের কাছে আছে। সেখানে কোন ব্যাংক থেকে কত টাকা লোপাট হয়েছে সেসব তথ্য দেওয়া আছে।

যুক্তরাষ্ট্রের স্যাংশনের বিষয়ে তিনি বলেন, আমেরিকা তাদের নিজেদের সুবিধার জন্য বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা (স্যাংশন) দেয়। আবার প্রয়োজনে ভেনিজুয়েলার মতো দেশের সঙ্গে চুক্তিও করে। তাই তারা স্যাংশন দেবে কি দেবে না, সেদিকে নজর না দিয়ে যেন স্যাংশন দেওয়ার সুযোগ না পায়, তার ওপর জোর দিতে হবে। আমাদের শ্রমিকদের মজুরি ও অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।

আলোচনায় ড. মোস্তাফিজুর আরও বলেন, সরকার নানা সুযোগ-সুবিধা দিয়ে তৈরি পোশাকশিল্পকে এ পর্যায়ে এনেছে। পোশাকের বিশ্বের বাজার ৭০০ বিলিয়ন ডলার। আমাদের রপ্তানির সম্ভাবনা রয়েছে এমন বড় খাত আর নেই। রপ্তানি বহুমুখীকরণ করতে হবে, নতুন বাজারে যেতে হবে। তবে এ খাত বাদ দিয়ে নয়। কারণ এখনো এ বাজারের অনেক বড় অংশ দখল করার সুযোগ রয়েছে। এজন্য আমাদের আরও আধুনিকায়ন প্রয়োজন। এ ছাড়া আমাদের চামড়া ও ফার্মাসিউটিক্যালস খাতের রপ্তানিতে জোর দিতে হবে। বিশ্বে ফার্মাসিউটিক্যালসে এক ট্রিলিয়ন ডলারের বাজার রয়েছে।