বিদেশি ঋণে ভাটার টান
চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) বৈদেশিক উৎস থেকে বাংলাদেশের ঋণ নেওয়ার পরিমাণ কিছুটা কমেছে। এ সময়ে বৈদেশিক ঋণ কমেছে প্রায় ১৫৬ কোটি ডলার। সব মিলিয়ে গত সেপ্টেম্বর শেষে বৈদেশিক ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে প্রায় ৯ হাজার ৬৫৪ কোটি
ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ প্রায় ১০ লাখ ৬২ হাজার কোটি টাকা। যদিও গত এক বছরে বিদেশি ঋণ বেড়েছে সাড়ে তিনশ কোটি ডলার বা প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হওয়ায় দেশে দীর্ঘদিন ধরেই ডলারের সংকট চলছে। এই সংকট সামাল দিতে আমদানি নিয়ন্ত্রণসহ নানা পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। তারপরও পতন থামানো যাচ্ছে না দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে। এ কারণে বৈদেশিক উৎস থেকে ঋণ বাড়াতে চাইছে সরকার। কিন্তু চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে ঋণতো বাড়েনি, উল্টো কমে গেছে। তবে অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরÑ এই তিন মাসে বৈদেশিক উৎসে ঋণ বাড়ার আশা করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে আইএমএফ ঋণের দ্বিতীয় কিস্তির প্রায় ৬৮ কোটি ৯৮ লাখ ডলার ছাড় করেছে। এর বাইরে এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) থেকে ৪০ কোটি ডলার ঋণ পাওয়া গেছে। এই ঋণ ডিসেম্বরের প্রতিবেদনে প্রতিফলিত হবে।
গত তিন মাসে সরকারি ও বেসরকারি সব খাতেই বিদেশি ঋণের পরিমাণ কমেছে। কমেছে স্বল্পমেয়াদি বিদেশি ঋণ নেওয়ার পরিমাণও। তবে আগে নেওয়া স্বল্পমেয়াদি বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপ বেড়েছে। আবার কিছু ঋণের মেয়াদ বাড়িয়ে নেওয়ার ঘটনাও ঘটছে।
আরও পড়ুন:
আকতার পারভেজ সর্বোচ্চ ভোটে সিএসই পরিচালক
বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, গত কয়েক বছরে বেসরকারি খাতের বিদেশি ঋণ তুলনামূলক বেশি বেড়েছে। তা ছাড়া করোনার কারণে এসব ঋণ পরিশোধ না করে সময় বাড়িয়ে নেওয়া হয়। সে কারণে এখন চাপ বেড়েছে ঋণ পরিশোধের। তবে নতুন করে বেসরকারি খাতে স্বল্পমেয়াদি বিদেশি ঋণ বৃদ্ধি না পাওয়ার বিষয়টি ইতিবাচক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, গত সেপ্টেম্বর শেষে বিদেশি ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৯ হাজার ৬৫৪ কোটি ৯৪ লাখ ডলার। তিন মাস আগেও যা ছিল ৯ হাজার ৮১০ কোটি ৭৭ লাখ ডলার। ফলে গত তিন মাসের ব্যবধানে বিদেশি ঋণ কমেছে ১৫৬ কোটি ডলার। অথচ আগের তিন মাসে বিদেশি ঋণ প্রায় ৩২২ কোটি ৩০ লাখ ডলার বা সাড়ে ৩৫ হাজার কোটি টাকা বেড়েছিল। এদিকে গত
বছরের সেপ্টেম্বরে বিদেশি ঋণের স্থিতি ছিল ৯ হাজার ২৯১ কোটি ২৪ লাখ ডলার। অর্থাৎ গত এক বছরে বিদেশি ঋণ বেড়েছে প্রায় ৩৬৩ কোটি ডলার বা ৩৯ হাজার ৯৩০ কোটি টাকা।
আরও পড়ুন:
বৃহত্তম হিমশৈল
প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিপুল অঙ্কের এই বিদেশি ঋণের মধ্যে প্রায় ৭৮ শতাংশই সরকারি খাতের। বাকি ২২ শতাংশ ঋণ নিয়েছে দেশের বেসরকারি খাত। অর্থাৎ মোট বিদেশি ঋণের মধ্যে সরকারের নেওয়া ঋণের পরিমাণ ৭ হাজার ৫২৬ কোটি ৮৭ লাখ ডলার। বাকি ২ হাজার ১২৮ কোটি ডলার ঋণ নিয়েছে বেসরকারি খাত। গত জুন পর্যন্ত সরকারি খাতে বিদেশি ঋণের পরিমাণ ছিল ৭ হাজার ৫৮৫ কোটি ডলার। এই হিসাবে গত তিন মাসে সরকারি খাতে বিদেশি ঋণ কমেছে ৫৯ কোটি ডলার। অন্যদিকে গত জুনে বেসরকারি খাতে বিদেশি ঋণের পরিমাণ ছিল ২ হাজার ২২৫ কোটি ৭০ লাখ ডলার। ফলে গত তিন মাসে বেসরকারি খাতে বিদেশি ঋণ কমেছে ৯৭ কোটি ডলার।
প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, গত তিন মাসে বেসরকারি খাতে স্বল্পমেয়াদি ঋণ প্রায় ১২৩ কোটি ডলার কমে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১ হাজার ২৪২ কোটি ৯৬ লাখ ডলার। এসব ঋণের মধ্যে বাণিজ্যিক ঋণের পরিমাণ ৮৫৫ কোটি ২৩ লাখ ডলার। এসব বাণিজ্যিক ঋণের বেশির ভাগই বায়ার্স ক্রেডিট, যার পরিমাণ প্রায় ৬৯২ কোটি ২৯ লাখ ডলার। বায়ার্স ক্রেডিটের এ ঋণ সাধারণত এক বছরের মধ্যে শোধ করতে হয়। বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা এসব ঋণ নিয়ে থাকেন। এ ছাড়া বিদেশি ‘ব্যাক টু ব্যাক’ এলসির ঋণ রয়েছে প্রায় ৭৬ কোটি ৪২ লাখ ডলার। আর ডেফার্ড পেমেন্টের ঋণ আছে ৮৬ কোটি ৫২ লাখ ডলার।
এদিকে গত তিন মাসে বেসরকারি খাতে মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ বেড়েছে প্রায় ২৫১ কোটি ডলার। সব মিলে গত সেপ্টেম্বর শেষে বেসরকারি খাতে মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৮৮৫ কোটি ১২ লাখ ডলার।
আরও পড়ুন:
কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম
সম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশের বিদেশি ঋণ গ্রহণ ব্যাপক হারে বেড়েছে। সরকারি ও বেসরকারি উভয় খাতেই বেড়েছে ঋণ। যদিও দেশের জিডিপির অনুপাতে বিদেশি ঋণ গ্রহণে বাংলাদেশ এখনো নিরাপদ অবস্থানেই রয়েছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও বিশ্বব্যাংকের মানদণ্ডে জিডিপির ৪০ শতাংশ পর্যন্ত বৈদেশিক ঋণের স্থিতি যে কোনো দেশের জন্য নিরাপদ। বাংলাদেশের বিদেশি ঋণ এখন জিডিপির প্রায় ২১ শতাংশেরও কম।