ট্রেনে কেন এত নাশকতা

তাওহীদুল ইসলাম
২০ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০
শেয়ার :
ট্রেনে কেন এত নাশকতা

তুলনামূলকভাবে নিরাপদ হিসেবে বিবেচিত রেলযাত্রা এখন আর নিরাপদ নেই। বাস-ট্রাকের পাশাপাশি রেলেও নাশকতা চালানো হচ্ছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, রেলই এখন নাশকতাকারীদের বড় টার্গেট। গতকাল মঙ্গলবার ভোরে রাজধানীর তেজগাঁওয়ে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসের তিনটি কোচ পুরোপুরি পুড়িয়ে দেওয়া হয়। আগুনে দগ্ধ হয়ে মা ও তিন বছর বয়সী শিশুসন্তানসহ চার যাত্রীর মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। এর আগে গত ১৩ নভেম্বর এই মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসই ভয়ানক দুর্ঘটনার মুখে পড়েছিল। গাজীপুরে রেললাইনের ফিশপ্লেট খুলে ফেলায় লাইনচ্যুত হয়ে যায় ট্রেনটি। সেদিনের দুর্ঘটনায়ও একজন নিহত হন, আহত হন চালকসহ আরও অনেক যাত্রী।

রেলে এমন ভয়াবহ ও প্রাণঘাতী নাশকতা দেশবাসীকে ভাবিয়ে তুলেছে। প্রশ্ন জেগেছে, ট্রেনে কেন একের পর এক এত নাশকতার ঘটনা ঘটছে? বাস্তবতা বলছে, ট্রেনে নাশকতা চালালে তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতির শিকার হতে হয়। এ কারণেই কি রেলকে বড় টার্গেট করা হচ্ছে?

এমন বাস্তবতায় নাশকতারোধে বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ নিয়েছে রেল কর্তৃপক্ষ। জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সরকারের তরফে শুরু হয়েছে জোর তৎপরতা। ট্রেনের বগিতে অগ্নিকা-ের পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, রেলে আগুন দিয়ে যারা চারটি প্রাণ খুন করেছে তাদের ক্ষমা নেই। একই দিন রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন বলেছেন, নাশকতা ও সন্ত্রাসী কর্মকা-ের মধ্য

দিয়ে নিরাপদ রেলযাত্রাকে অস্থিতিশীল করা হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে যোগাযোগব্যবস্থায় যে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়েছিল, সেখানে একমাত্র রেল চলাচলই স্বাভাবিক ছিল। এখন রেল যোগাযোগব্যবস্থায় পরিকল্পিতভাবে সন্ত্রাসী কর্মকা- চালানো হচ্ছে। রাজনৈতিক সন্ত্রাস ও নাশকতা নিরাপদ রেল চলাচলের জন্য হুমকি, বলেন রেলমন্ত্রী।

বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক কামরুল আহসান বলেন, নাশকতা এড়াতে অনেকগুলো পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। আনসার মোতায়েন থেকে শুরু করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা বেড়েছে। পাশাপাশি রাতে ধীরে ট্রেন চলাচল, এক সঙ্গে অনেকগুলো ট্রেন চলাচলের নির্দেশনাও রয়েছে। এ ছাড়া সিসি ক্যামেরা স্থাপন ও স্বয়ংক্রিয় ট্রেন নিরাপত্তা ব্যবস্থাসহ অনেক বিষয়ের বিশ্লেষণ চলছে। মোট কথা, যেভাবেই হোক রেলপথ নিরাপদ ও নির্বিঘœ করতে সব ধরনের ব্যবস্থা নিচ্ছে সরকার। অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা রয়েছে সব ট্রেনে। এ ব্যাপারেও অধিকতর সতর্ক রেল।

রেল মন্ত্রণালয় থেকে সরবরাহ করা তথ্যে দেখা গেছে, ২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশ-পরবর্তী সময়ে রেলে ১৯টি অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া ৮টি ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা এবং রেললাইনের ফিটিংস খুলে ফেলার মতো কা-ও ঘটিয়েছে দুষ্কৃতকারীরা। এর মধ্যে পূর্বাঞ্চলে ৫টি বড় নাশকতার ঘটনা ঘটে।

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ রেলওয়ের দুটি ভাগÑ পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চল। এর মধ্যে পূর্বাঞ্চলে ৫২টি এবং পশ্চিমাঞ্চলে ৫৬টি আন্তঃনগর ট্রেন চলাচল করে। বাংলাদেশ-ভারত রুটে চলাচলরত আন্তঃদেশীয় ৬টি ট্রেন চলে। এ ছাড়া লোকাল, মেইল, কমিউটার ট্রেন পশ্চিমাঞ্চলে চলে ৭০টি, পূর্বাঞ্চলে ৬৮টি। া পূর্বাঞ্চলের আওতায় ৮টি কনটেইনার ট্রেন চলে। আরও ২৫টি ট্রেন চলাচল করছে তেল ও পণ্যবাহী হিসেবে। হরতাল-অবরোধসহ যে কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচিতে সরকারি এই গণপরিবহন সচল থাকে। এ কারণে রেলকেই টার্গেট করা হলো কিনা, সেই আলোচনা সামনে চলে আসছে। অবশ্য নাশকতার কারণে রেল চলাচল বন্ধ হবে না জানিয়ে রেলমন্ত্রী বলেন, রাজনৈতিক কর্মসূচি দিতেই পারে। কিন্তু সহিংসতা করতে পারে না। সহিংসতা করে রেল চলাচল বন্ধ করা যাবে না। নাশকতার বিষয়ে সবাইকে সজাগ থাকা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সহযোগিতা করার আহ্বান জানান তিনি।

রেলওয়েতে নাশকতার মধ্যে ১৬ নভেম্বর টাঙ্গাইল স্টেশনে কমিউটার ট্রেনের ২টি কোচ আগুনে পুড়ে যায়। এরপর ১৯ নভেম্বর জামালপুরের সরিষাবাড়ীতে দুটি কোচ পুড়ে যায়। একটি কোচের কিছু অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ২২ নভেম্বর আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয় সিলেটের একটি ট্রেনে। এরপর ১৩ ডিসেম্বর রাজেন্দ্রপুরে ২০ ফুট রেলপথ কেটে সৃষ্ট নাশকতায় একটি লোকোমোটিভ ও ৬টি কোচ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ওইদিনের ঘটনায় নিহত হন এক যাত্রী। এলএম, এএলএমসহ কয়েকজন যাত্রী আহত হন। আর গতকাল ট্রেনের তিনটি কোচ পুড়িয়ে ফেলার ঘটনায় অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যান ৪ জন। এগুলো নতুন কোচ। ২০১৯-২০ সালে ইন্দোনেশিয়ার পিটি ইনকার মাধ্যমে আনা হয়েছে কোচগুলো।

রেলে সাম্প্রতিক নাশকতার বিষয়ে জানাতে আগেই গতকাল সংবাদ সম্মেলন ডেকেছিল রেল মন্ত্রণালয়। সংবাদ সম্মেলনে রেলমন্ত্রী বলেন, যাত্রী হয়ে ট্রেনে উঠে নাশকতা ঘটানো হচ্ছে। বাসের বদলে ট্রেনকে এখন নাশকতার প্রধান হাতিয়ার করা হচ্ছে। পরিকল্পিত দুর্ঘটনা ঘটাতে ফিশপ্লেট খুলে নেওয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, রেলের নিরাপত্তা বাহিনী, পুলিশের সঙ্গে কথা হয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গেও কথা হয়েছে। সন্ত্রাসীরা এসব কর্মকা- করে যেন রেল চলাচলে বিঘœ ঘটাতে না পারে, সে বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।

এদিকে ট্রেনকে সিসি ক্যামেরার আওতায় আনা এবং স্বয়ংক্রিয় ট্রেন নিরাপত্তা ব্যবস্থা (এটিপিএস) চালুর বিষয়টি সক্রিয় বিবেচনায় রয়েছে। ট্রেনের সংঘর্ষ ও ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে এ উদ্যোগ নেওয়ার কথা রয়েছে। এটিপিএস হলো ট্রেনের এক ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা, যার বেশকিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে। তার মধ্যে রয়েছে ট্রেনের নির্দিষ্ট গতিসীমার ওপর লক্ষ্য রাখা এবং বিপদ সংকেত না মেনে এগিয়ে যেতে থাকলে দুর্ঘটনা এড়াতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ট্রেন থামিয়ে দেওয়া। এখন এ নিয়ে সমীক্ষার কাজ চলমান। আমেরিকা, জাপান এবং ইউরোপের দেশগুলো ইতোমধ্যে এটিপিএস চালু করেছে। সম্প্রতি প্রতিবেশী দেশ ভারতও এই পদ্ধতি চালু করেছে। এই পদ্ধতি চালু হওয়ার পর কোনো ট্রেন যদি কর্মীদের ব্যর্থতার কারণে বিপদ বা লাল সংকেত পার হয়ে যায়, তাহলে ট্রেনটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে থেমে যাবে এবং এতে করে সংঘর্ষে এড়ানো সম্ভব হবে।

ট্রেন দুর্ঘটনা রোধে ক্লোজ সার্কিট (সিসি) ক্যামেরা স্থাপনের প্রস্তাব রয়েছে রেল মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির। রোলিং স্টক অপারেশন উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ৪০টি ব্রডগেজ ডিজেল ইলেকট্রিক লোকোমোটিভের (ইঞ্জিন) ক্যাবে সিসি ক্যামেরা স্থাপনের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত। এর বাইরে কোচেও সিসি ক্যামেরা স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে রেল কর্তৃপক্ষ। বিশেষ করে নতুন আসা সব কোচে সিসি ক্যামেরা বসানো হচ্ছে। বিদ্যমান লোকোমোটিভ ও কোচে ক্যামেরা বসানোর বিষয়টি গুরুত্ব পাচ্ছে। তবে এর আগে ক্যামেরা বসানো হয়েছিল এবং তা চুরির ঘটনা ঘটে। আর ট্রেনে যেন অগ্নিকা-ের পর তাৎক্ষণিক অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্রগুলো কাজ করে, সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের ইতোমধ্যে নির্দেশ দিয়েছে রেলওয়ে।