ডাক্তার, কোচিংমালিক চেয়ারম্যানের চক্র
মেডিক্যালের প্রশ্নপত্র ফাঁস
২০১০ সালের মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষায় হাজার হাজার মেধাবী শিক্ষার্থীকে পেছনে ফেলে জাতীয় মেধা তালিকায় ১১তম হয়েছিলেন দিনাজপুরের ফয়সাল আহমেদ রাসেল। তার এমন অভাবনীয় সাফল্যে সে সময় ওই এলাকায় হইচই পড়ে যায়। এরপর তিনি ভর্তি হন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে। সেখান থেকে পাস করে চাকরিও শুরু করেন দিনাজপুর সিভিল সার্জন কার্যালয়ে। এক যুগেরও বেশি সময় পর বেরিয়ে এসেছে ফয়সাল ৬ লাখ টাকায় কেনা প্রশ্নে স্থান করে নিয়েছিলেন মেধা তালিকায়!
শুধু ফয়সালই নন, মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁসের অভিযোগে ৪৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ২৩ জনই চিকিৎসক। এ ছাড়াও এ চক্রে রয়েছেন কোচিংসেন্টারের মালিক ও রাজনৈতিক নেতা। মেডিক্যালের প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলার ৩ নং সিংড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাজ্জাদ হোসেন ও পাঁচ চিকিৎসকসহ ৯ জনকে সম্প্রতি গ্রেপ্তার করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। সিআইডি জানিয়েছে, ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করে ২০১০-১১ সেশনে বিভিন্ন সরকারি মেডিক্যাল কলেজে চান্স পাওয়া ২০ জনের খোঁজ পেয়েছে সিআইডি। তাদের অধিকাংশই ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে পড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন।
সিআইডিপ্রধান মোহাম্মদ আলী মিয়া বলছেন, মেডিক্যালে ভর্তির প্রশ্নফাঁস একটি কলঙ্কজনক কাণ্ড। ২০০১ সাল থেকে এমন ঘটনা ঘটছে। আমরা চক্রের প্রতিটি সদস্যকে আইনের আওতায় আনতে কাজ করছি। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে প্রশ্নফাঁস বন্ধের বিষয়ে কঠোর নির্দেশনা রয়েছে।
মেডিক্যাল প্রশ্নফাঁস মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০১০ সালে ঠাকুরগাঁওয়ের মোহাতার হোসেন নামের এক তরুণের মাধ্যমে প্রশ্নফাঁসের জগতে প্রবেশ করেন সাজ্জাদ হোসেন। এরপর পরিচয় হয় রওশন আলী হিমু এবং শহীদুল ইসলাম সুজনের সঙ্গে। মোতাহার, হিমু ও সুজনÑ এ তিনজনই মেডিক্যালে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস করা চক্রের মাস্টারমাইন্ড জসীম উদ্দিন ভূঁইয়ার ঘনিষ্ঠজন। এরপর ক্রমে সাজ্জাদও জসীমের ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। জসীমের বাসা থেকে উদ্ধারকৃত গোপন ডায়েরিতেও সাজ্জাদের নাম পাওয়া গেছে। উত্তরবঙ্গের অসংখ্য শিক্ষার্থীকে অনৈতিক উপায়ে মেডিক্যালে ভর্তি করিয়ে কোটি টাকা আয় করেছেন তিনি। একাধিক আসামির স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে তার নাম রয়েছে। ২০১৭ সালে মেডিক্যাল প্রশ্নফাঁসের একটি মামলায় তিনি এজাহারনামীয় আসামি।
আমাদের সময় খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছে, কেবল ২০১০ সালেই ৬ জন মেডিক্যাল পরীক্ষার্থীর কাছে প্রশ্ন বিক্রি করে ৩৬ লাখ টাকা আয় করেছেন সাজ্জাদ। ওই ৬ শিক্ষার্থীর সবাই ঢাকা মেডিক্যালে ভর্তির সুযোগ পান। তাদেরই একজন মেধা তালিকায় ১১তম হওয়া ফয়সাল আহমেদ রাসেল। সাজ্জাদের সঙ্গে রাসেলকেও গ্রেপ্তার করেছে সিআইডি।
আরও পড়ুন:
আকতার পারভেজ সর্বোচ্চ ভোটে সিএসই পরিচালক
গ্রেপ্তার অন্য আসামিরা হলেনÑ পার্বতীপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জরুরি চিকিৎসা কর্মকর্তা সোহানুর রহমান, সৈয়দপুরের বিট’স কোচিং সেন্টারের পরিচালক আবদুল হাফিজ হাপ্পু, রংপুর মেডিক্যাল থেকে পাস করা ডা. তৌফিকুল ইসলাম রকি ও ইবরার আলম, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ থেকে পাস করা ডা. সাইফুল আলম বাদশা, চিরিরবন্দরের ব্যবসায়ী রায়হানুল ইসলাম এবং ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী বকুল রায় শ্রাবণ।
জানা গেছে, বিট’স কোচিংয়ের মালিক হাপ্পু ফাঁসকৃত প্রশ্ন মোটা টাকায় তার কোচিংয়ের মেডিক্যালে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের মাঝে বিক্রি করেছেন। তাকে প্রশ্ন সরবরাহ করতেন ডা. জিল্লুর হাসান রনি। রনিকে আগেই গ্রেপ্তার করেছে সিআইডি। রনি প্রশ্ন পেতেন চক্রটির মাস্টারমাইন্ড জসীমের বড় ভাই জহিরুল হক ভূঁইয়া মুক্তারের কাছ থেকে। ২০১০, ২০১৩ এবং ২০১৫ সালে বেশ কিছু শিক্ষার্থীর কাছে প্রশ্ন বিক্রি করে বিপুল অর্থ আয় করেছেন হাপ্পু। মালিক বনে যান সিটি কমিউনিটি হাসপাতাল নামের একটি ক্লিনিকের। ২০১৫ সালে এই ক্লিনিকেই বিট’স কোচিংয়ের শিক্ষার্থীদের ফাঁসকৃত প্রশ্ন পড়িয়েছিলেন তিনি।
সিআইডি জানিয়েছে, রংপুর ও নীলফামারীতে ডা. জিল্লুর হাসান রনির দুই গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী ছিলেন ডা. ইবরার আলম এবং ডা. তৌফিকুল ইসলাম রকি। তিনজনই রংপুর মেডিক্যাল কলেজের সাবেক শিক্ষার্থী। ফলে তাদের মধ্যে ভালো বোঝাপড়া ছিল। ডা. রনি প্রশ্নফাঁস করতেন আর সেই প্রশ্ন লাখ লাখ টাকায় বিক্রি করতেন রকি ও ইবরার। বিট’স কোচিংয়ে ক্লাস নেওয়ার পাশাপাশি ডা. রনির হয়ে হাপ্পুর প্রশ্নফাঁস কার্যক্রম তদারকিও করতেন রকি।
অন্যদিকে রায়হানুল ইসলাম সোহান এবং বকুল রায় শ্রাবণ দুজনই চিরিরবন্দরের বাসিন্দা। একই স্কুলে পড়ার সুবাদে তারা ঘনিষ্ঠ ছিলেন। ২০১৫ সালে রায়হানুল তার মামার মাধ্যমে মেডিক্যালের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন পান। পরে তা বকুলকেও সরবরাহ করেন। বকুল তার স্কুলের ভর্তিচ্ছু চার ছোট ভাইয়ের কাছে ১০ লাখ টাকা করে চুক্তিতে প্রশ্ন বিক্রি করেন। তাদের একজন রংপুর মেডিক্যালে, একজন চট্টগ্রাম মেডিক্যালে, একজন রাজশাহী মেডিক্যালে এবং একজন ঢাকা ডেন্টাল কলেজে চান্স পান।
আরও পড়ুন:
বৃহত্তম হিমশৈল
মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার জুয়েল চাকমা বলেন, ২০১০ সালে সাজ্জাদের মাধ্যমে যে ৬ শিক্ষার্থী প্রশ্ন পেয়েছেন, তাদের মধ্যে সাইফুল আলম বাদশা একজন। প্রশ্ন পেয়ে মেধা তালিকায় ৭৭তম স্থান দখল করেন তিনি। পরে ২০১৩ এবং ২০১৫ সালে প্রশ্নফাঁস ব্যবসায় জড়িয়ে একাধিক শিক্ষার্থীকে ভর্তিও করান।
আদালত সূত্র জানায়, বাদশা তার জবানবন্দিতে বলেছেন, সাজ্জাদের নির্দেশনায় ২০১০ সালের মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষার আগের রাতে একটি মাইক্রোতে করে দিনাজপুর থেকে তারা ৬ জন রংপুর শহরে যান। সেখানে প্রাইম মেডিক্যাল কলেজের কাছে একটি বাসায় প্রায় ৩০ জন শিক্ষার্থীকে প্রশ্ন পড়ানো হয়। যাদের প্রায় সবাই ঢাকা মেডিক্যালে চান্স পেয়েছেন। মেধা তালিকায় স্থান পাওয়া ভাস্কর, নিশাত, সৌরভ, শারমিন ও জ্যোতিসহ অন্তত ২০ শিক্ষার্থীর নাম-পরিচয় আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিতে জানিয়েছেন বাদশা।
আরও পড়ুন:
কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম