পেঁয়াজের দামে ঢাকা ও চট্টগ্রামে ভিন্ন চিত্র
ক্রেতা নেই, কমে গেছে বিক্রি
রাতারাতি অস্বাভাবিকভাবে দাম বেড়ে নাগালের বাইরে চলে যাওয়ায় রাজধানী ঢাকার খুচরা বাজারে এবং চট্টগ্রামের পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে কমে গেছে পেঁয়াজের বিক্রি। ঢাকার খুচরা বাজারে কেজিতে মাত্র ১০ টাকা কমলেও খাতুনগঞ্জের পাইকারি বাজারে হু হু করে কমছে দাম। তবু ক্রেতা মিলছে না। খাতুনগঞ্জের পেঁয়াজ ব্যবসায়ীরা বড় লোকসানের আশঙ্কায় এখন রীতিমতো শঙ্কিত।
এদিকে গতকাল দুপুরে কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) নেতারা পেঁয়াজের দাম নিয়ে কারসাজির প্রতিবাদে খাতুনগঞ্জ অভিমুখে মিছিল এবং পরবর্তীতে সমাবেশ করেন। তারা অভিযোগ করেন, গুটিকয়েক ব্যবসায়ী পুরো দেশের মানুষকে জিম্মি করে পেঁয়াজ ব্যবসার নামে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা কামিয়ে নিচ্ছেন।
রাজধানীর কদমতলী, যাত্রাবাড়ী, মালিবাগসহ বিভিন্ন এলাকার খুচরা বিক্রেতাদের সঙ্গে গতকাল কথা বলে জানা গেছে, পেঁয়াজের বিক্রি অনেক কমে গেছে। বেশিরভাগ ক্রেতা যতুটুকু না হলেই নয়, ততটুকুই কিনছেন। নিম্নআয়ের ক্রেতাদের মধ্যে অনেকে কিনছেন না বললেই চলে।
গত ৮ ডিসেম্বর এক আদেশে রপ্তানি বন্ধের খবর জানায় ভারত। এ ঘোষণা আসার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই এক লাফে ২২০ টাকায় পৌঁছে যায় নিত্যপ্রয়োজনীয় এ ভোগ্যপণ্যটির দাম। বাজারের অস্থিরতা সামাল দিতে মাঠে নামে জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। এরপরও বাজার নিয়ন্ত্রণে আসেনি। দাম সেভাবে কমেনি। গত দুই দিনের ব্যবধানে দেশি পেঁয়াজের দাম কেজিতে মাত্র ১০ টাকা কমেছে। তবে বাজারে নতুন পেঁয়াজের সরবরাহ বাড়ায় ক্রেতারা সেদিকে ঝুঁকছেন। এ পেঁয়াজের দামও তুলনামূলকভাবে কম।
খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, বাজারে নতুন পেঁয়াজের সরবরাহ বাড়লেও পুরনো দেশি পেঁয়াজে তার প্রভাব পড়ছে না। পাইকারিতে এখনও এ পেঁয়াজের দাম চড়া রয়েছে। একইভাবে আমদানিকৃত পেঁয়াজের দরেও আগুন জ্বলছে। তবে বাজার ঘুরে দেখা গেছে, নতুন পেঁয়াজের সরবরাহ অনেকখানি বেড়েছে। দামও তুলনামূলক কম। বর্তমানে দেশি নতুন পেঁয়াজের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত। তাই এ পেঁয়াজের চাহিদাও বেশি।
কদমতলী এলাকার ইশানা স্টোরের খুচরা বিক্রেতা ইসমাইল হোসেন বলেন, মঙ্গলবার পুরনো দেশি পেঁয়াজের দাম কেজিতে ১০ টাকা কমে ২০০ টাকা হয়েছে। আর ভারতীয় পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে বিভিন্ন দামে। কোথাও ১৬০ টাকা কেজি তো কোথাও ১৯০ টাকা। তুরস্কের পেঁয়াজ আরেকটু কমে বিক্রি হচ্ছে, কেজি ১৩০ থেকে ১৪০ টাকা পর্যন্ত।
বেচা-বিক্রি কমে যাওয়ার প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, দাম বাড়ার পর থেকে বিক্রি অর্ধেকেরও নিচে নেমে গেছে। সাধারণত দিনে এক মণ পেঁয়াজ অনায়াসে বিক্রি হয়ে গেছে যেখানে, সেখানে এখন ১৫-২০ কেজি বিক্রি করতেই কষ্ট হচ্ছে।
মালিবাগ বাজারের খুচরা বিক্রেতা মো. সোলায়মান বলেন, নিয়মিত ক্রেতারাও পেঁয়াজ কিনছেন না। অপরদিকে আগে যেসব ক্রেতা দেশি পেঁয়াজ পাল্লা (৫ কেজি) ধরে কিনতেন, তারা এখন আমাদানিকৃত পেঁয়াজ ১ কেজি করে কিনছেন। মূলত, দাম অতিরিক্ত বাড়ায় আমদানিকৃত পেঁয়াজও বিক্রি হচ্ছে না।
আরও পড়ুন:
আকতার পারভেজ সর্বোচ্চ ভোটে সিএসই পরিচালক
পেঁয়াজের দাম আরও কমবে উল্লেখ করে শনির আখড়ার খুচরা বিক্রেতা মো. শামীম আহমেদ জানান, একটু বড় মানের নতুন পেঁয়াজ ১০০ টাকা কেজি বিক্রি করছি, ছোটটা ৯০ টাকা কেজি। মানুষ এখন নতুন পেঁয়াজটাই বেশি নিচ্ছে। দাম কম হওয়ায় সবাই আগ্রহ দেখাচ্ছে। বিক্রিও দ্রুত হয়ে যাচ্ছে। সবে তো শুরু, নতুন পেঁয়াজের সরবরাহ আরও বাড়বে। সপ্তাহখানেকের মধ্যে দাম আরও কমে আসবে।
নতুন পেঁয়াজের ক্রেতা মো. শাহ আলম বলেন, পুরনো পেঁয়াজের দাম এখনও ২০০ টাকা কেজি। এ দামে একটা মুরগি কেনা যাবে। বিদেশি পেঁয়াজের দামও সাধ্যের বাইরে। হঠাৎ দেখলাম নতুন পেঁয়াজ। ১০০ টাকা কেজিতে কিনলাম। এ দিয়েই কোনো রকমে রান্নার কাজ সেরে নিতে হবে।
পাশের আরেক ক্রেতা মো. সিরাজুল ইসলাম অবশ্য এ দামেও আক্ষেপ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, আমাদের মতো নিম্ন আয়ের মানুষের পক্ষে ১০০ টাকা দিয়েও পেঁয়াজ খাওয়া কষ্টকর। দাম বাড়ার পর থেকে এক পোঁয়া-আধা কেজি করে কিনে খাই।
কদমতলী এলাকার খুচরা বিক্রেতা মো. মিলন হোসেনও বলেন, ৫ কেজির ক্রেতা নেই বললেই চলে। এখন সবাই ১ কেজি করেই বেশি কিনছেন। তাও কম। এক পোয়া, আধা কেজির ক্রেতাই বেশি। সেটাও বিদেশি পেঁয়াজ কিনছেন। ক্রেতারা পুরনো দেশি পেঁয়াজ কেনা ছেড়েই দিয়েছেন বলতে গেলে। বরং নতুন পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে যেখানে সেখানে ক্রেতারা ভিড় করছেন বেশি।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর মুড়িকাটা পেঁয়াজ আবাদ হয় প্রায় ৫০ হাজার হেক্টর জমিতে এবং উৎপাদন হয় প্রায় ৮ লাখ টন। এছাড়া এ বছর গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ আবাদ হয়েছে প্রায় ৫০০ হে. জমিতে। এখান থেকে উৎপাদন হবে প্রায় ৫০ হাজার টন। এই মুড়িকাটা ও গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ বাজারে আসা শুরু হয়েছে এবং বাজারে থাকবে আগামী ৩ থেকে সাড়ে তিন মাস। এরপর মূল পেঁয়াজ আসা শুরু হবে।
এদিকে চট্টগ্রামের দৃশ্যপট ভিন্ন। গতকাল বন্দরনগরীর কয়েকটি খুচরা দোকানে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তারা নতুন করে খাতুনগঞ্জের পাইকারি বাজার থেকে পেঁয়াজ আনছেন না। পাঁচ দিন আগে কেনা পেঁয়াজই এখনো বিক্রি করে চলেছেন। নগরীর মোমিন রোডের গ্রোসারি দোকান শরীফ স্টোরের মালিক মোহাম্মদ শরীফ জানান, দাম আরও বাড়তে পারে ভেবে তিনি বেশ কিছু বস্তা ভারতীয় পেঁয়াজ বেশি দামে খাতুনগঞ্জ থেকে কেনেন। কিন্তু নানা গুজবের কারণে দাম বাড়া সত্ত্বেও ক্রেতারা পেঁয়াজ কেনেননি। ফলে দোকানের গুদামে যেমন পেঁয়াজ স্তূপ হয়ে আছে, তেমনি দিন দিন লোকসানও বেড়েছে। এখন লোকসানে তড়িঘড়ি করে বিক্রি করতে চান। কিন্তু মানুষ পেঁয়াজ কিনছে না।
চাক্তাই খাতুনগঞ্জ আড়তদার ও সাধারণ ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সভাপতি মো. জাহাঙ্গীর আলম আমাদের সময়কে বলেন, গত সোমবার চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক আমাদের ডেকে বললেন, ১২৫ টাকার বেশি দরে যেন কোনোভাবেই পেঁয়াজ বিক্রি না হয়। আজ (গতকাল বুধবার) তো ১০০ টাকায়ও ক্রেতা মিলছে না খাতুনগঞ্জে। যেভাবে দরপতন হচ্ছে তাতে আগামী দুই দিনে আরও ২০ থেকে ৩০ টাকা দাম কমে যেতে পারে। অথচ পেঁয়াজ আড়তে আনার পর ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই ছেড়ে দিতে হয়। এটি একটি পচনশীল পণ্য।
আরও পড়ুন:
বৃহত্তম হিমশৈল
ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দিলেও গুদাম ও আড়তে এখনো ভারতীয় পেঁয়াজের মজুদ আছে। চীনের পেঁয়াজ আসছে জাহাজে করে। দাম বাড়ার কথা শুনে দেশি চাষিরা তাড়াহুড়ো করে পেঁয়াজ তুলছেন খেত থেকে। সে পেঁয়াজের সরবরাহও পর্যাপ্ত। বিপরীতে গত কয়েক দিন ধরে ক্রেতারা পেঁয়াজ কিনছেন না। যারা কিনছেন তারাও খুচরা বাজার থেকে এক কেজির বদলে ২৫০ গ্রাম কিনছেন। এতে পেঁয়াজের বাজারে বড় ধাক্কা লাগে।
বাজারের অবস্থা দেখে কয়েকজন ব্যবসায়ী বলেন, আগামী কয়েক মাসের মধ্যে আর পেঁয়াজের দাম বাড়ার কোনো সম্ভাবনাই নেই। এ অবস্থায় আমদানি সীমিত করে দেশীয় কৃষকদের পেঁয়াজ বিক্রির সুযোগ করে দেওয়া উচিত। ব্যবসায়ী নেতা মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, সরকারের উচিত এখনই চাষিদের সঙ্গে বসা। প্রতিকেজি পেঁয়াজের উৎপাদন ব্যয় জেনে পেঁয়াজের বাজারমূল্য নির্ধারণ করে দেওয়া। সেক্ষেত্রে বাজারে যদি প্রতিকেজি পেঁয়াজ ১০০ টাকা করে বিক্রির ব্যবস্থা করা হয় এবং আমদানি সীমিত থাকে, তাহলে আগামী কয়েক মাসজুড়ে দেশীয় কৃষকরা লাভবান হবেন। তা না হলে পেঁয়াজের দরপতন অব্যাহত থাকবে।
ক্যাবের মিছিল
‘সিন্ডিকেট থামাও জীবন বাঁচাও’ ব্যানার নিয়ে গতকাল দুপুরে খাতুনগঞ্জ অভিমুখে পদযাত্রা করেছেন ক্যাবের নেতারা। ব্যবসায়ীদের পেঁয়াজসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য নিয়ে কারসাজি, মজুতদারি ও অতি মুনাফার প্রতিবাদে ক্যাব এ কর্মসূচি পালন করে।
ক্যাব নেতারা অভিযোগ করেন, প্রশাসনের যারা এসব দেখার দায়িত্বে আছেন, তারা খবর নেননি। উল্টো পাশ কাটিয়ে যাওয়ার কারণে ব্যবসায়ীরা একেক সময় একেক পণ্য নিয়ে জনগণকে জিম্মি করে রেখেছেন।
ক্যাব যুব গ্রুপ চট্টগ্রাম মহানগরের সভাপতি আবু হানিফ নোমানের সঞ্চালনায় পদযাত্রায় সংহতি জানান ক্যাব কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট এসএম নাজের হোসাইন, ন্যাপ কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মিটুল দাস গুপ্ত, প্রশিকার গীতা রাণী দত্ত ও ক্যাবের বিভিন্ন থানার নেতারা। ক্যাব নেতারা বলেন, মানুষের জনদুর্ভোগ লাঘবে ভ্রাম্যমাণ আদালত ও সমন্বিত বাজার তদারকি কার্যক্রম একটি উদ্ভাবনী মডেল চলমান ছিল। এসব কার্যক্রম সক্রিয় না থাকায় তৃণমূল মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
‘ব্যবসায়ীরা সহযোগিতা করেননি উল্টো হাত বদলে দাম বাড়িয়েছেন’
আরও পড়ুন:
কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম
পেঁয়াজের বাজার স্থিতিশীল রাখতে ব্যবসায়ীরা সরকারকে সহযোগিতা করেনি। উল্টো তারা হাতবদলের মধ্য দিয়ে অস্বাভাবিকভাবে দাম বাড়িয়ে বাজার আরও অস্থিতিশীল করে তুলেছেন। এর দায় ব্যবসায়ীদের নিতে হবে। গতকাল এমন মন্তব্য করেন জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান।
গতকাল রাজধানীতে ভোক্তা অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়ে পেঁয়াজের ব্যবসায়ী ও বাজার সংশ্লিষ্টদের নিয়ে অনুষ্ঠিত এক মতবিনিময় সভায় তিনি এ কথা বলেন। সম্প্রতি পেঁয়াজের বাজারে অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিতে এ সভার আয়োজন করা হয়। সভায় সফিকুজ্জামান বলেন, সরকার পেঁয়াজের বাজার পরিস্থিতির পর্যালোচনা করছে। অভিযোগের প্রমাণ পেলে পেঁয়াজের দাম বাড়ানোর সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বাজার স্থিতিশীল রাখতে ব্যবসায়ীরা সরকারকে সহযোগিতা করেননি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সরকার তথ্য পায়নি। ভারত পেঁয়াজ রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পর আমাদের কাছে তথ্য আসতে দেরি হয়েছে। কিন্তু ব্যবসায়ীরা ঠিকই জেনে গেছেন। শুক্রবার ছুটির দিন, তারপরও সবাই দাম বাড়ানোর মহোৎসবে মেতে ওঠে। গুদাম পেঁয়াজে ভরা। কিন্তু বলা হয়েছে পেঁয়াজ নেই। শুধু আইন করে এটা বন্ধ করা সম্ভব না। কিছু নৈতিক অনুশাসন যদি মেনে না চলা হয়, তা হলে এ অবস্থার উন্নতি হবে না বলে মন্তব্য করেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, খুদে বার্তার মধ্যে পেঁয়াজের বাজার নিয়ন্ত্রণ করার অভিযোগ নিয়ে আমরা কাজ করছি। তবে এখন পর্যন্ত যেটা দেখা যাচ্ছে, তা হলো হাতবদলের খেলায় পেঁয়াজের দাম বেড়েছে। ত্রুটিযুক্ত বিপণনব্যবস্থা ও হাতবদলের খেলা বন্ধ করা না গেলে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়।