ভোটে অংশ নিতে ছিল না চাপ-প্রলোভন

চল্লিশ মিনিটের আন্দোলনে সরকার পতনে কতটা সফল হব, জানি না ।। জনগণ ভোট দিতে পারছে জানমালের নিরাপত্তা আছে- বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দেখতে চাই ।। দলে বিভেদ সৃষ্টি কাম্য নয়

নজরুল ইসলাম
১২ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০
শেয়ার :
ভোটে অংশ নিতে ছিল না চাপ-প্রলোভন

সরকারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলন ছেড়ে সপ্তাহ দুয়েক আগে ভোটের মাঠে নাম লেখান বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীরপ্রতীক। এ নিয়ে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েন তিনি। লোভে পড়ে ক্ষমতাসীনদের চাপে তিনি ভোট করছেন- এমন কথাও আছে রাজনীতির মাঠে। ভোটে যাওয়া না যাওয়া নিয়ে ভাঙনও ধরেছে দলে। এসব বিষয়ের পাশাপাশি বর্তমান রাজনীতির হালচাল নিয়ে গতকাল সোমবার দৈনিক আমাদের সময়ের সঙ্গে কথা বলেন সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম।

নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রসঙ্গে মুহাম্মদ ইবরাহিম বলেন, ‘কোনো চাপ বা প্রলোভন ছিল না, আমি নিজে চিন্তা করতে পারি।’ তিনি বলেন, ‘২০১৪ সালের নির্বাচনে যাওয়ার দাওয়াত পেয়েছিলাম; যাইনি। ওই আমলের ২০-দলীয় জোটও জানে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে দাওয়াত পেয়েছিলাম, ২০-দলীয় জোট নির্বাচনে গেলেও আমি যেন জোট ছেড়ে সরকারি জোটে যাই। তা-ও যাইনি, এটিও ২০-দলীয় জোট জানে।’

এক সময়ের ২০-দলীয় জোটের এ গুরুত্বপূর্ণ নেতা বলেন, ‘২০১৯ সাল থেকে চার বছর ২০-দলীয় জোট না জীবিত না মৃত। এ কথা গণমাধ্যমেও বহুবার বলেছি, সমাধান হয়নি। ২০২২ সালের ৯ ডিসেম্বর এক মিনিটের নোটিশে জোট ভেঙে দেওয়া হয়। যে জোটটি করা হয়েছিল ৬ মাসের প্রস্তুতি নিয়ে লিখিত সমঝোতা স্বাক্ষর করে, সেই জোট এক মিনিটের নোটিশে ভেঙে দিলেন! কাজটা সুখকর ছিল না।’

বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান বলেন, ‘২০১৪ সালে জোটের সঙ্গে ছিলাম; নির্বাচন বন্ধ করা যায়নি, নির্বাচন ঠিকই হয়েছে, সরকার পাঁচ বছর দেশ পরিচালনা করেছে। ২০১৮ সালে বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্ট নেতৃত্বে ছিল, আমরা দ্বিতীয় সারিতে ছিলাম এবং নির্বাচনে গিয়েছি। বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্ট সরকারের সঙ্গে কথা বলেছে, বিদেশিদের সঙ্গে কথা বলেছে। আমরা বলিনি। আমরা তাদের অনুসরণ করেছি। ফল শুভকর নয়।’

২০১৮ সালের নির্বাচনের ফল প্রত্যাখ্যান করলেও বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ছাড়া বাকিরা সংসদে শপথ নেন। এ প্রসঙ্গে সৈয়দ ইবরাহিম বলেন, ‘সাতজন পার্লামেন্টে গিয়েছিলেন। তারা দারুণ কাজ করেছেন, তাদের ধন্যবাদ। তারা দেশের মানুষের কথা পার্লামেন্টে বলতে পেরেছেন।’

সরকার পতনের চলমান একদফা আন্দোলন সম্পর্কে সৈয়দ ইবরাহিমের মূল্যায়ন হলো, ‘২০২৩ সালের সাড়ে ১১ মাস- এই সময়ের মধ্যে ১০ ডিসেম্বর সমাবেশ বড় ছিল, রেজাল্ট জিরো। ২৮ জুলাই সমাবেশ বড় ছিল, ২৯ জুলাইয়ের অবরোধ দুর্বল ছিল- রেজাল্ট জিরো। সরকারকে দোষ দেব কেন তারা প- করল? আমাদেরও তো সমালোচনা করতে হবে- কেন আমরা সফল হতে পারিনি। এই সময়ে আমরা যারা ছোট ছোট দল কী করেছি ?’

আন্দোলনের চিত্র তুলে ধরে সৈয়দ ইবরাহিম বলেন, ‘গত আট সপ্তাহ- এই সময়ে সপ্তাহে চার দিন ৪০ মিনিটের আন্দোলন করি। একশ থেকে পাঁচশ মিটার বা এক কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে মিছিল করি, উত্তপ্ত বক্তব্য দিই। তার পর আমরা নিজের বাড়িতে চলে যাই। তা হলে সপ্তাহে চার দিন ৩০-৪৫ জন লোকের চল্লিশ মিনিটের আন্দোলনে সরকার পতনে কতটা সফল হব, জানি না। সেই জন্য আমি চিন্তা করেছি, গত ১৫ বছরে জনগণের পক্ষে যা আমি টেলিভিশনে বলেছি, কলাম লিখেছি, গত এক-দেড় বছর রাজনৈতিক ময়দানে, বিজয়নগর পানির ট্যাংকির নিচে আমি বলেই যাচ্ছি। সেই কথাগুলো যদি পার্লামেন্টে বলতে পারি, তা হলে দেশের জন্য মঙ্গলজনক হবে। সেটা থেকেই ওখানে (নির্বাচনে) যাওয়া।’

বিরোধী দলের চলমান আন্দোলন সফলতার মুখ দেখবে কিনা জানতে চাইলে কক্সবাজার-১ আসনের প্রার্থী ইবরাহিম বলেন, ‘এটা দেশের জনগণ বিচার করবে। আমার মন্তব্য করা শোভনীয় হবে না।’ সরকারবিরোধীদের জন্য কোনো পরামর্শ আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি কোনো পরামর্শ দিতে পারি না; শুভেচ্ছা জানাতে পারি, দোয়া জানাতে পারি, মহব্বত জানাতে পারি।’

নির্বাচন ইস্যুতে বিদেশিদের চাপ ও নানা গুঞ্জন বিষয়ে সৈয়দ ইবরাহিম বলেন, ‘নো ব্রেকফাস্ট ইজ ফ্রি, নো লান্স ইজ ফ্রি, নো কাবাব টি ইজ ফ্রি। হোস্ট যিনিই হোক, ইট ইজ নেভার ফ্রি। তা হলে আমাদের জানতে হবে- আমার ফ্রির মধ্যে কোনটা তুলনামূলক কম দাম।’ তবে এসব মন্তব্যের কোনো ব্যাখ্যা দেননি সৈয়দ ইবরাহিম।

দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে সৈয়দ ইবরাহিম বলেন, ‘দেশের রাজনীতিতে সবাই ব্যস্ত; বিভিন্ন সমীকরণে উদগ্রীব। রাজনৈতিক দলগুলো কেউ নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে, তা নিয়ে ব্যস্ত; কেউ আবার নির্বাচন করছেন না, এর বিরোধিতা করছেন। ফলে সবাই ব্যস্ত।’

নিজের দল সম্পর্কে সৈয়দ ইবরাহিম বলেন, ‘বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত, কারণ আমরা নির্বাচনে যাচ্ছি। আমাদের দলের ১৭ জন ব্যক্তি মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছে। এর মধ্যে ১৪ জন বৈধতা পেয়েছে। বাকি তিনজনের প্রার্থিতা আপিলে নিষ্পত্তি হবে।’

প্রত্যাশার কথা শুনতে চাইলে সৈয়দ ইবরাহিম বলেন, ‘একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দেশটাকে সুন্দর দেখতে চাই, জনগণ ভোট দিতে পারছে- সেটি দেখতে চাই। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে থাকুক- সেটি দেখতে চাই। গরিবের টাকা যেন ধনী মেরে খেতে না পারে- সেটি দেখতে চাই। জানমালের নিরাপত্তা দেখতে চাই, আরও মানসম্মত শিক্ষা দেখতে চাই।’

১৯৭১ ও ২০২৩ সালের লড়াই প্রসঙ্গে সৈয়দ ইবরাহিম বলেন, ‘১৯৭১ সালে যখন লড়াই করেছি, তখন আমি ছিলাম তরুণ, এখন তরুণরা লড়াই করছে। তরুণদের কাজই হচ্ছে দেশের উন্নতির জন্য লড়াই করা। আমি তাদের মোবারকবাদ জানাই।’

দলের ভাঙন সম্পর্কে সৈয়দ ইবরাহিম বলেন, ‘কিছু বিভ্রান্ত ব্যক্তি, কারও কারও উসকানিতে পার্টির মধ্যে একটা বিভেদ এনেছেন। তাদের প্রতি দোয়া ও শুভেচ্ছা থাকল। তাদের প্রতি আহ্বান- বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির গঠনতন্ত্র পড়তে এবং তা অনুসরণ করে চলতে। যদি কল্যাণ পার্টির সঙ্গে তাদের দ্বিমত থাকে, তারা কল্যাণ পার্টি ত্যাগ করে সম্মানের সঙ্গে চলে যেতে পারেন। পার্টির মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করা কাম্য নয়। যারা উসকানি দেন তাদের প্রতি আহ্বান- কাজটা ভালো না; বিরত থাকুন।’

২০০৭ সালে সেনাসমর্থিত সরকারের আমলে ‘বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি’ প্রতিষ্ঠা করেন সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম। নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত দলটির বর্তমান মহাসচিব চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রশিবিরের সাবেক সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল আউয়াল মামুন।