বছর না পেরোতেই সুদ পরিশোধ বেড়ে দ্বিগুণ

জিয়াদুল ইসলাম
০৭ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০
শেয়ার :
বছর না পেরোতেই সুদ পরিশোধ বেড়ে দ্বিগুণ

বেসরকারি খাতে নেওয়া স্বল্পমেয়াদি বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপে পড়েছে বাংলাদেশ। এই চাপ আরও বাড়িয়েছে আন্তর্জাতিক সুদহার বৃদ্ধি ও ডলারের উচ্চমূল্য। এর ফলে ঋণের আসলের সঙ্গে সুদ পরিশোধেও ব্যবসায়ীদের খরচ বেড়েছে। এতে আসল ও সুদ পরিশোধের পরিমাণ বাড়ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি বছর শেষ না হতেই গত বছরের তুলনায় সুদ পরিশোধ বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সুদহার বৃদ্ধির কারণে বেসরকারি খাতের ঋণের সুদ পরিশোধ আগের তুলনায় বাড়তে পারে। এছাড়া আগের অনেক সুদ সময়মতো পরিশোধ করতে পারেনি ব্যবসায়ীরা। ওই সুদ পরিশোধের জন্য সময় নেওয়া হয়। সেই সময় পূর্ণ হওয়ার কারণে সুদ পরিশোধ করতে বাধ্য হচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। এছাড়া ডলারের উচ্চ মূল্যের কারণে আসল পরিশোধেও আগের চেয়ে বেশি ব্যয় হচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম ১০ মাসে (জানুয়ারি-অক্টোবর) বেসরকারি খাতের স্বল্পমেয়াদি ঋণ পরিশোধ হয়েছে ৫২৫ মিলিয়ন ডলার। গত বছরের (২০২২) পুরো সময়ে যা ছিল ২৪৬ মিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ গত বছরের পুরো সময়ের তুলনায় চলতি বছরের প্রথম ১০ মাসে সুদ পরিশোধ বেড়েছে ২৭৯ মিলিয়ন ডলার বা ১১৩ দশমিক ৪১ শতাংশ। এটা আগের বছরের চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি। ২০১৯ সালে সুদ পরিশোধের পরিমাণ ছিল ২১০ দশমিক ৫১ মিলিয়ন, ২০২০ সালে ১৬৭ দশমিক ৪৫ মিলিয়ন এবং ২০২১ সালে ১৩৮ দশমিক ৫৫ মিলিয়ন ডলার। তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম আট মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সুদ পরিশোধ হয় এপ্রিল মাসে। এর পরিমাণ ছিল ১৩৭ মিলিয়ন ডলার। বাকি মাসগুলোতে এর পরিমাণ ছিল ৩৫ থেকে ৪৯ মিলিয়ন ডলারে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কয়েক বছর আগেও ২ থেকে ৩ শতাংশে বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধ করতে হতো। বর্তমানে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সুদহার বৃদ্ধির কারণে তা প্রায় ৯ শতাংশের কাছাকাছি হয়েছে। যার কারণে ব্যবসায়ীরা দ্রুত ঋণ পরিশোধ করে দিচ্ছেন। ঋণ পরিশোধের কারণেও বেশি সুদ পরিশোধ হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী, বৈদেশিক ঋণের জন্য সর্বোচ্চ সিকিউরড ওভারনাইট ফাইন্যান্সিং রেটসহ (এসওএফআর) ৩ শতাংশ সুদ প্রদান করতে হবে। বর্তমানে এসওএফআর ৫ দশমিক ৩০ শতাংশ, যা এক সময়ে ছিল ১ শতাংশেরও কম। তাই আন্তর্জাতিক বাজারে সুদের হার উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় ঋণের সুদ পরিশোধের পরিমাণও বেড়ে গেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ঋণের প্রিন্সিপাল (মূল) ও সুদ দুই-ই পরিমাণে বেড়েছে। আমাদের নেওয়া ঋণের উল্লেখযোগ্য অংশই দ্বিপক্ষীয় (বাইলেটারেল) ও হার্ড লোন, সফট লোন নয়। যেমন- এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি), বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের দেওয়া লোন কিন্তু সফট লোন, যাদের সুদের হার অনেক কম। সফট লোনে সুদহার ১ শতাংশ থেকে ১ দশমিক ২৫ শতাংশের মতো থাকে। সফট লোনের গ্রেস পিরিয়ড এবং রিপেমেন্ট পিরিয়ড বেশি (কখনো কখনো তা ২০-২৫ বছর)। কিন্তু আমরা বিভিন্ন দেশ ও বাণিজ্যিক উৎস থেকে অনেক ঋণ নিয়েছি, যা বাইলেটারেল বা দ্বিপক্ষীয় ঋণ। বিভিন্ন উৎস থেকে নেওয়া সরকারি ও বেসরকারি ঋণের সুদও কিন্তু বেশি। এগুলোর বেশির ভাগই স্বল্প ও মধ্যমেয়াদি। এখন আমাদের কাছে ইমিডিয়েট চ্যালেঞ্জটি হলোÑ স্বল্পমেয়াদি ঋণগুলো পরিশোধ করতে হবে।

এদিকে সংকটের কারণে বিদেশি ঋণসহ নানা উপায়ে ডলারের সরবরাহ বাড়াতে চাইছে সরকার। তবে রেমিট্যান্স ও রপ্তানি প্রবৃদ্ধি আশানুরূপ বাড়ছে না। এর মধ্যেই বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপে পড়েছে বেসরকারি খাত। প্রাপ্ত তথ্য বলছে, চলতি বছরের প্রথম ১০ মাসে বেসরকারি খাত যে পরিমাণ বিদেশি ঋণ নিয়েছে, পরিশোধ করতে হয়েছে তার চেয়ে ৪ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলার বেশি। গত দশ মাসে ২১ দশমিক ৬০ বিলিয়ন ডলারের বিদেশি ঋণ পেয়েছে বেসরকারি খাত। একই সময়ে সুদ ও মূল ঋণ পরিশোধ হয়েছে ২৬ দশমিক ৪০ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ বেসরকারি খাতের বিদেশি ঋণ নেওয়ার চেয়ে পরিশোধ হচ্ছে বেশি।

বেসরকারি খাতের ঋণ দ্রুত পরিশোধের কারণে রিজার্ভের ওপর চাপ পড়েছে। তথ্য অনুযায়ী, বিপিএম-৬ অনুযায়ী, নভেম্বর শেষে গ্রস রিজার্ভ (জিআইআর) কমে হয়েছে ১৯ দশমিক ৪০ বিলিয়ন ডলার। গত জুন শেষে রিজার্ভ ছিল ২৪ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন ডলার। বর্তমানে যে রিজার্ভ রয়েছে তা দিয়ে চার মাসের কিছু কম সময়ের আমদানি দায় মিটবে।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালের ডিসেম্বর শেষে দেশের বেসরকারি খাতের বিদেশি বিভিন্ন ব্যাংক ও প্রতিষ্ঠান থেকে নেওয়া স্বল্পমেয়াদি বৈদেশিক ঋণের স্থিতি ছিল ১৬ দশমিক ৪২ বিলিয়ন ডলার। চলতি বছরের ডিসেম্বরে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১২ দশমিক ১৩ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ ১০ মাসে ঋণ পরিশোধ হয়েছে ৪ দশমিক ২৯ বিলিয়ন ডলার। ব্যাংকাররা জানান, করোনা শুরুর পর বিশ্ববাজারে সুদহার তলানিতে নামে। তখন বেসরকারি খাতে বিদেশি ঋণ বেশ বেড়ে যায়। এখন এসব ঋণ পরিশোধের চাপ তৈরি হয়েছে। করোনার আগের বছর ২০১৯ সাল শেষে বেসরকারি খাতে বিদেশি ঋণস্থিতি ছিল মাত্র ৮ দশমিক ২১ বিলিয়ন ডলার। গত বছরের শেষে তা বেড়ে ১৬ দশমিক ৪১ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়ায়। মাত্র দুই বছরেই ঋণ বাড়ে ৮ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার। আর চলতি বছরের অক্টোবরে তা কমে ১২ দশমিক ১৩ বিলিয়ন ডলারে নেমেছে। এর মানে ঋণ যত দ্রুত বেড়েছিল, কমছেও সেভাবে।