ভোটের রাজনীতিতে ফের ফ্যাক্টর জাপা

মুহম্মদ আকবর
০৭ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০
শেয়ার :
ভোটের রাজনীতিতে ফের ফ্যাক্টর জাপা


জাতীয় পার্টিতে (জাপা) যখন দেবর-ভাবির দ্বন্দ্বের প্রভাব ভোটের মাঠে পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে, তখন ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে নির্বাচনী ও নির্বাচনোত্তর হিসাব-নিকাশে বড় নির্ণায়ক (ফ্যাক্টর) হয়ে উঠেছে বর্তমান সংসদে বিরোধী দলের আসনে থাকা দলটি। ফলে ভোটের মাঠে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন সমঝোতা নিয়ে দেনদরবারে ‘সুবিধাজনক অবস্থা’ আছে তারা। এমনকি, ১৪ দলীয় জোটের শরিকদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের আসন বণ্টনও ঝুলে আছে জাতীয় পার্টির সঙ্গে সমঝোতার অপেক্ষায়। সুবিধানজনক অবস্থাটি কাজে লাগিয়ে জাপা নেতারা একদিকে ক্ষমতাসীনদের কাছ থেকে আরও বেশি আসন পেতে চাইছেন, আবার সমঝোতা হওয়া আসনগুলোতে আওয়ামী লীগের দলীয় ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদেরও সরিয়ে দেওয়ার দাবি করছেন। অন্যদিকে, দলটিকে গুরুত্ব দেওয়া এবং তাদের দাবির বহর দেখে ভেতরে ভেতরে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন কিছু শরিক দলের নেতা। এ অবস্থায় আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন দলীয় ও স্বতন্ত্র প্রার্থী পড়ে গেছেন অনিশ্চয়তায়।

গত দুদিনে আওয়ামী লীগ, ১৪ দলের অন্যান্য শরিক ও জাতীয় পার্টির কয়েকজন নেতার সঙ্গে আলাপ করে এমন তথ্যই পাওয়া গেছে। নেতারা বলছেন, ভোটের সমীকরণ নির্ধারণে আসন

সমঝোতার আগ্রহী দলগুলো শেষ মুহূর্তের হিসাব-নিকাশে ব্যস্ত সময় পার করছে। চলতি সপ্তাহে আসন ভাগাভাগি নিয়ে বিভিন্ন দলের সঙ্গে লাগাতার বৈঠক করছে আওয়ামী লীগ। সোমবার সন্ধ্যায় গণভবনে ১৪ দলের সঙ্গে বৈঠক করেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। পরদিন মঙ্গলবার বিকালে জোটের সমন্বয়ক আমির হোসেন আমুর সঙ্গে ফের বৈঠক করেন জোটের বেশ কয়টি শরিক দলের নেতা। পরে রাতে গণভবনে আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে জিএম কাদেরের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টির নেতারা বৈঠকে বসেন বলেও জানা যায়, যদিও কোনো দলের পক্ষ থেকেই বৈঠকটির কথা জানানো হয়নি।

সবশেষ গতকাল বুধবার রাতে আওয়ামী লীগের সঙ্গে বৈঠক করেছেন জাতীয় পার্টির নেতারা। রাজধানীর গুলশানে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। আওয়ামী লীগের পক্ষে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সভাপতিম-লীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ, আ ফ ম বাহাউদ্দীন নাছিম, সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম বৈঠকে অংশ নেন। আর জাতীয় পার্টির পক্ষে জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু ও কো-চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদ উপস্থিত ছিলেন। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বৈঠকের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

বৈঠক সম্পর্কে জানতে চাইলে বাহাউদ্দিন নাছিম আমাদের সময়কে বলেন, অত্যন্ত সৌহার্দপূর্ণ পরিবেশে জাতীয় পার্টির সঙ্গে আমাদের বৈঠক হয়েছে। জাপার নেতারা দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। তারা বলেছেন, নির্বাচনে জাতীয় পার্টি সর্বশক্তি দিয়ে অংশ নেবে। এই নির্বাচনের মাধ্যমে দেশের গণতন্ত্র আরও শক্তিশালী হবে। বৈঠকে জনগণের মেন্ডেট নিয়ে জাতীয় সংসদে নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন দলটির নেতারা।

জাতির পার্টির মহাসচিব মজিবুল হক চুন্নুর কাছে জানতে চাইলে তিনি সাংবাদিকদের জানান, এ বিষয়ে তিনি বৃহস্পতিবার (আজ) দুপুরে পার্টির চেয়ারম্যানের কার্যালয়ে ব্রিফ করবেন।

বৈঠক সূত্র জানায়, বৈঠকে জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে একটি চিঠি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের হাতে তুলে দেন। চিঠিতে আসন্ন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের কাছে ৩৫-৪০টি আসন চেয়েছে জাপা। আর বাদ বাকি আসনে যে যার মতো করে দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করবে। বৈঠক শেষে জাপার দাবিসংবলিত চিঠি নিয়ে গণভবনে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার কাছে যান ওবায়দুল কাদের। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত কোনো বৈঠক থেকেই আসেনি। উভয় দলের নেতারা আশাবাদী, বৃহস্পতিবারের বৈঠকের মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছে যাবে জাপা।

ভোটের রাজনীতিতে জাতীয় পার্টির গুরুত্বের বিষয়টি ১৪ দলের সমন্বয়ক আমির হোসেন আমুর বক্তব্যেই প্রথম উঠে আসে। গত মঙ্গলবার ১৪ দলের নেতাদের সঙ্গে আসন বণ্টন সম্পর্কিত একটি বৈঠক শেষে আমু জানান, জাতীয় পার্টির সঙ্গে আলোচনার পর ১৪ দলের শরিকদের সঙ্গে আসন বণ্টন হবে।

মূলত বিএনপিসহ বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল নির্বাচনে না আসায় জাতীয় পার্টির শীর্ষ দুই নেতা জিএম কাদের ও মজিবুল হক চুন্নু আছেন নির্ভার। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের (২০১৪ সালে) মতোই বিএনপিবিহীন নির্বাচনে ভোটের মাঠে ‘ফ্যাক্টর’ হয়ে আছেন তারা। সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগসহ ২৯টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশ নিলেও বিরোধী দল হওয়ার মতো শক্তি এবং অভিজ্ঞতা আছে জাতীয় পার্টির। যে কারণে জাপাকে হাতছাড়া করতে চায় না আওয়ামী লীগ। আবার এমনটা বুঝে জাতীয় পার্টিও নিজেদের চাওয়া-পাওয়ার হিসাব বুঝে নিতে ভুল করছে না। প্রথমে আওয়ামী লীগের কাছ থেকে ১০০টি আসন আদায় করে নেওয়ার টার্গেট নিয়ে মাঠে নামলেও ৩০০ আসনের মধ্যে ২৮৮টিতে প্রার্থী দেয় জাপা। সর্বশেষ ৫০টি আসনের টার্গেট নিয়ে আছে জাপা। অন্যদিকে সমঝোতা না করে ২৯৮টি আসনে একক প্রার্থী দেয় আওয়ামী লীগ। একই সঙ্গে প্রতিটি আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় দলটি। এ ছাড়াও ১৪ দলের শরিকসহ অন্যসব নির্বাচনমুখী দলের প্রার্থীও মাঠে রয়েছেন।

জানা গেছে, ১৪ দলের শরিকরা পাঁচ-ছয়টি আসন পেতে পারে। অন্যদিকে জাতীয় পার্টিকে ২৫ থেকে ৩০টি আসনে সমঝোতা করতে পারে আওয়ামী লীগ। এ ক্ষেত্রে জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে ওই সব আসনে আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থী ও স্বতন্ত্র প্রার্থীকে সরিয়ে নেওয়ার দাবি করবে। সংশ্লিষ্টরা জানান, বিরোধী দল হতে হলে একটি দলকে ৩০০ আসনের মধ্যে ন্যূনতম ২৫টি আসন পেতে হয়। সেদিক বিবেচনায়, অর্থাৎ নির্বানোত্তর হিসাব-নিকাশে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির মধ্যে সমঝোতা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। তবে ভোটের আগে শরিকদের কম গুরুত্ব দিয়ে জাপাকে বেশি প্রাধান্য দেওয়ায় জোটের মধ্যে এক ধরনের চাপা ক্ষোভ রয়েছে।

এর আগে ২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি নির্বাচন বর্জন করে। নানা সমীকরণ তৈরির প্রেক্ষাপটে প্রয়াত জাপা চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ নির্বাচন বর্জন করেন। অন্যদিকে রওশন এরশাদের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টির একটি অংশ নির্বাচনে অংশ নেয়। এবং জাপা থেকে ৩৪ জন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ওই সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা হন রওশন এরশাদ। ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়। কিন্তু বেশি আসন পাওয়ায় জাতীয় পার্টিই বিরোধী দলের আসনে বসে। এক সময়ের মহাজোটের শরিক জাতীয় পার্টি বিরোধী দলে থাকায় সংসদেও স্বস্তিতে থাকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।

জানা গেছে, চলমান বাস্তবতা থেকেই জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ জাতীয় পার্টির সভাপতি সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা সাম্প্রতিক বেশকিছু বক্তৃতায় বলেছেন, ‘জাতীয় পার্টি আগামী নির্বাচনের ট্রাম্প কার্ড।’ দলটির আরেক নেতার ভাষ্য, আওয়ামী লীগকে গত দুই যুগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি চাপ (দেশি ও বিদেশি) মোকাবিলা করতে হচ্ছে। ফলে জাতীয় পার্টি হিসাব আদায় করে নিতে ভুল করবে না। তার ভাষ্য, ১৯৯৬ সালে সরকার গঠনে জাপার ভূমিকা ছিল। পরবর্তী একটি বাদ দিয়ে সব নির্বাচনেই আওয়ামী লীগে স ভাগাভাগির কোনো প্রস্তাব না এলেও জাতীয় পার্টির সঙ্গে আলাপ করতে চেয়েছে আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ যেহেতু বড় দল, আমরা তাদের সঙ্গে কথা বলব।’