সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হাসপাতালে সর্বস্বান্ত
খুলনার কয়রার বাসিন্দা মনিরুজ্জামান শাহীন (৩১)। গত ২১ জুলাই ইজিবাইক দুর্ঘটনায় তার এক পায়ের হাড়-মাংস আলাদাপ্রায় হয়ে যায়। শুরুতে তাকে বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করেন স্বজনরা। কিন্তু চিকিৎসা ব্যয়ের সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে না পারায় অনেক দৌড়ঝাঁপের পর ভর্তি করা হয় রাজধানীর জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (নিটোর)। সেই দুর্ঘটনার পর পেরিয়ে গেছে পাঁচ মাসেরও বেশি সময়। এখনো পুরোপুরি সুস্থ হননি তিনি। কিন্তু ইতোমধ্যেই চিকিৎসার পেছনে খরচ হয়ে গেছে ৭ লক্ষাধিক টাকা; বিক্রি করতে হয়েছে শেষ সম্বল একমাত্র ফসলি জমিটি।
শাহীনের স্ত্রী সেলিনা পারভিন আমাদের সময়কে বলেন, আমার স্বামীর পায়ে প্লাস্টিক সার্জারি করার কথা জানান চিকিৎসক। একদিকে চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে পারছিলাম না, অন্যদিকে সরকারি হাসপাতালে শয্যা পাচ্ছিলাম না। অনেক চেষ্টার পর পেয়েছি। হাসপাতাল থেকে বিনামূল্যে বেড, ভিজিট-ফ্রি ডাক্তার ও সাধারণ কিছু ওষুধ মিললেও বাইরে থেকে ইনজেকশন, অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ ও পায়ে যুক্ত করার রডসহ অনেক কিছু কিনতে হয়েছে, কিনতে হচ্ছে। এ পর্যন্ত ৭ লাখ টাকা খরচ হয়ে গেছে। খুলনা থেকে রাজধানীর হাসপাতালে আসা-যাওয়া, থাকা-খাওয়ার খরচ তো আছেই। অগত্যা শেষ সম্বল চার কাঠা জমিও বিক্রি করে দিতে হয়েছে। এখন আমরা নিঃস্ব বলা চলে।
ফেনীর বাসিন্দা আব্দুল খালেকের (৪১) অবস্থা আরও খারাপ। সড়ক দুর্ঘটনায় দুই পা হারিয়ে পেটের দায়ে এখন তিনি রাজধানীর ফার্মগেটে ভিক্ষা করেন। কথা হয় তার সঙ্গে। খালেক বলেন, ২০১৮ সালের কথা। ঢাকা থেকে বাড়ি ফেরার সময় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে দুর্ঘটনায় দুই পা হারাই। বসতভিটা ছাড়া আমার আর কোনো কিছু ছিল না। চিকিৎসা করাতে গিয়ে সেটুকুও বেচে দিতে হয়েছে। এখন ভিক্ষা করে পরিবার চালাই।
শুধু মনিরুজ্জামান শাহীন ও আব্দুল খালেকই নন। তাদের মতো অসংখ্য মানুষ প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয়ে, অঙ্গ হারিয়ে জীবিকাহারা হচ্ছেন। তদুপরি হাসপাতালের চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন।
সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত, পঙ্গুত্ববরন করে জীবিকাহারা ব্যক্তিদের সহায়তায় সরকার বিধিমালা করলেও ভুক্তভোগীদের স্থায়ী পুনর্বাসনের কোনো উদ্যোগ এ পর্যন্ত নেওয়া হয়নি। শুধু তাই নয়। এককালীন যে আর্থিক অনুদান দেওয়ার কথা, সেটি পেতে গিয়েও অন্তহীন ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। কারও কারও ক্ষেত্রে অনেক দেন-দরবারের পর অর্থ মিলছে, অনেকের ক্ষেত্রে সেটিও মিলছে না। তদুপরি এই আর্থিক সহায়তা জীবনযাপনের জন্য যথেষ্ট তো নয়ই।
আরও পড়ুন:
আকতার পারভেজ সর্বোচ্চ ভোটে সিএসই পরিচালক
সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারালে নিহতের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে পাঁচ লাখ টাকা; আর কোনো অঙ্গ হারিয়ে কর্মসক্ষমতা হারিয়ে ফেলা ব্যক্তিকে তিন লাখ টাকা আর্থিক সহায়তার কথা বলা হয়েছে সরকারের তরফে। এ ছাড়া দুর্ঘটনায় মারাত্মক আহত কেউ চিকিৎসার পর সুস্থ হলে তাকে এক লাখ টাকা দেওয়ার কথা। এমন সব বিধান রেখে সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ জারি করা হয়েছে, যা গত বছরের ডিসেম্বরে গেজেট আকারে প্রকাশ করেছে সরকার। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, চিকিৎসাব্যয়ের তুলনায় আর্থিক এ সহায়তা খুবই অপ্রতুল। উপরন্তু এই সহায়তা পেতেও ভোগান্তির শেষ নেই। তারা বলছেন, অর্থসহায়তা প্রাপ্তির প্রক্রিয়া আরও সহজ করা উচিত।
ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশের এপিডেমিওলজি অ্যান্ড রিসার্চ বিভাগের অধ্যাপক ডা. সোহেল রেজা চৌধুরীও এমনটাই মনে করেন। আমাদের সময়কে তিনি বলেন, বর্তমানে সড়ক দুর্ঘটনায় কেউ মারা গেলে আর্থিক অনুদান পেলেও আহতদের পুনর্বাসনে কার্যকরভাবে সরকারি কিংবা বেসরকারিভাবে কোনো কর্মসূচি নেই। আহতদের যতটুকু দেওয়া হয় তা প্রয়োজনের তুলনায় একেবারে অপ্রতুল। এই সহায়তার পরিমাণ বাড়ানো দরকার। আবার তা পেতে নানা জটিলতা ও ভোগান্তি পোহাতে হয়। এমনিতেই সে সময়ে একটি পরিবার আর্থিক ও মানসিকভাবে ভীষণ বিপর্যস্ত অবস্থায় থাকে। এমন ক্রান্তিকালে আর্থিক সহায়তা পেতে গিয়ে যারপরনাই ভোগান্তি খুবই অসমীচীন, অমানবিক।
বাংলাদেশে সড়কে দুর্ঘটনা কতটা ভয়াবহ রূপ নিয়েছে তার ধারণা মেলে বেসরকারি সংগঠন বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্যে। সংগঠনটি বলছে, বাংলাদেশে প্রতিবছর সড়ক দুর্ঘটনায় পঙ্গুত্ববরণ করতে হচ্ছে প্রায় ১৫ হাজার মানুষকে। তাদের দেওয়া তথ্যমতে, ২০২২ সালে ৬ হাজার ৭৪৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৯ হাজার ৯৫১ জন প্রাণ হারিয়েছেন; আহত হয়েছেন ১২ হাজার ৩৫৬ জন।
দুর্ঘটনাগ্রস্ত এসব রোগীর চিকিৎসায় দেশে একমাত্র বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান নিটোর। এ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে সড়ক দুর্ঘটনায় ২০২০ সালে ৫০ হাজার জন এবং ২০২১ সালে ৭০ হাজার জন চিকিৎসা নিয়েছেন। বছরের ব্যবধানে জরুরি বিভাগে রোগী বেড়েছে ৩৬ শতাংশ। হাসপাতালটিতে গত বছর ভর্তি হয়েছেন মোট দুই লাখ ৬৪ হাজার জন।
আরও পড়ুন:
বৃহত্তম হিমশৈল
এদিকে দেশে দিন দিন বাড়ছে সড়ক দুর্ঘটনা। ফলে বাড়ছে রোগী। এ কারণে বাড়ছে চিকিৎসা সরঞ্জামাদির দামও। সড়ক দুর্ঘটনায় আহতদের চিকিৎসা-সরঞ্জাম ও ওষুধপত্রের দাম গড়ে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে বলে জানিয়েছেন এ ওষুধ ও সরঞ্জাম ব্যবসায়ীরা।
২১০ টাকার হাঁটুর টুপির (নি-ক্যাপ) দাম বেড়ে বর্তমানে ৩৫০ টাকায় ঠেকেছে, হাঁটুর বন্ধনীর দাম ১৮শ টাকা থেকে বেড়ে ২৫শ হয়েছে; পায়ের পাতার ব্যথা রোধে ব্যবহৃত ফুটড্রপ ৭শ টাকা থেকে বেড়ে হাজারে দাঁড়িয়েছে। বেড়েছে ক্রাচের দামও। মাস ছয়েক আগেও ৩৫০ টাকায় যে ক্রাচ বিক্রি হতো সেটি এখন ৬শ ছাড়িয়ে গেছে।
সড়ক দুর্ঘটনাসহ পক্ষাঘাতগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা বাড়লেও পুনর্বাসন ব্যবস্থা এখনো সেভাবে গড়ে ওঠেনি বলে জানান বাংলাদেশ অর্থোপেডিক সোসাইটির মহাসচিব ও নিটোরের অধ্যাপক ডা. জাহাঙ্গীর আলম। আমাদের সময়কে তিনি বলেন, দুর্ঘটনায় মারা গেলে কিংবা আহত হলে সম্প্রতি এককালীন কিছু সহায়তা দেওয়া হয়। এ ছাড়া সমাজসেবা অধিদপ্তরের মাধ্যমে কিছু সহায়তা মেলে। তবে সবাই পাচ্ছে না, পেলেও দীর্ঘসূত্রতা রয়েছে। তিনি আরও বলেন, কৃত্রিম পা প্রতিটির দাম ৭০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা, যা একসময় বিনামূল্যে দেওয়া হতো। বেশ কয়েক বছর ধরে সেটি বন্ধ। কোভিডের আগে সোসাইটির পক্ষ থেকে প্রতিবছর ৫০০-১০০০ হাজার পা বিনামূল্যে দেওয়া হতো। গত বছর আবার তারা এটি চালুর উদ্যোগ নিলেও সরকারের পক্ষ থেকে কর আরোপ করার কথা বলায় সেই উদ্যোগও ভেস্তে গেছে।
আঘাতপ্রাপ্ত রোগীদের বিশ্বের অন্যতম বড় হাসপাতাল এটি। কাজেই সরকারিভাবে বিনামূল্যে কিংবা ন্যূনতম টাকায় এসব উপকরণ কেনার সুযোগ দেওয়া উচিত বলেও মত দেন এই চিকিৎসক।
আরও পড়ুন:
কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম
জানতে চাইলে বিআরটিএ চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার আমাদের সময়কে বলেন, ‘আমাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা নেই। তবে সড়ক দুর্ঘটনায় আহতদের ক্ষতিপূরণ চালু হয়েছে। আগে এসব কিছুই ছিল না। এখন পর্যন্ত ১৬২ জনকে দেওয়া হয়েছে। যদিও যে পরিমাণ মানুষ ভুক্তভোগী হচ্ছে, তার তুলনায় এটি যথেষ্ট নয়। আবেদন করলে তদন্ত শেষে সহযোগিতা দেওয়া হচ্ছে। আমাদের যতটুকু করার আমরা করছি। তবে সবার আগে সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে হবে। কারণ, দুর্ঘটনায় একজন ক্ষতিগ্রস্ত হলে তার পরিবারের পাশাপাশি দেশের জন্যও বড় বোঝা।’