বাজতে শুরু করে পাকবাহিনীর বিদায়ঘণ্টা

সৈয়দ রিফাত
০২ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০
শেয়ার :
বাজতে শুরু করে পাকবাহিনীর বিদায়ঘণ্টা

১৯৭১ সালের ২ ডিসেম্বর বিদায়ঘণ্টা বাজতে শুরু করে পাকিস্তানি বাহিনীর। চারদিকে শুরু হয়ে যায় পাল্টা আক্রমণ। মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা বাহিনী গেরিলা আক্রমণ ছেড়ে সম্মুখ রণাঙ্গনে যোগ দিলে যুদ্ধের গতিপথ মুহূর্তেই পাল্টে যায়। মুহুর্মুহু আক্রমণে দিশাহারা হয়ে পড়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে আক্রমণ শুরু করে ভারতীয় মিত্রবাহিনীও। মুজিবনগর সরকার অনেকটা নিশ্চিত হয়ে যায়, বাংলাদেশের বিজয় আসন্ন। তবে পরাজয় সুনিশ্চিত জেনে নৃশংসতা বাড়িয়ে দেয় পাকিস্তানের সেনারা।

১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর ভারতীয় সংবাদপত্র দৈনিক আনন্দবাজারের এক খবরে জানা যায়, মুক্তিবাহিনীর সাফল্যের খবর। প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানানো হয়Ñ যশোর, কুষ্টিয়া ও দিনাজপুর এলাকার বেশকিছু থানা মুক্তিবাহিনীর দখলে চলে এসেছে। গেরিলা বাহিনীর একের পর এক সফল আক্রমণের কারণে এদিন (২ ডিসেম্বর) পাকিস্তানি বাহিনী তাদের নবম ডিভিশনের হেডকোয়ার্টার যশোর থেকে মাগুরায় স্থানান্তরিত করতে বাধ্য হয়। এদিন মুক্তিবাহিনীর দখলে চলে যায় লালমনিরহাট বিমানবন্দর। মুক্তিবাহিনী ঘিরে ফেলে সাতক্ষীরা জেলা, কুষ্টিয়ার জীবননগর ও বগুড়ায় বেশকিছু অংশ।

সিলেটের গুরুত্বপূর্ণ সমসেরনগর বিমানবন্দর মুক্তিবাহিনী সম্পূর্ণ দখলে নিয়ে নেয়। এদিন রংপুর জেলার আটটি থানা শত্রুমুক্ত হয়। চট্টগ্রামে মুক্তিবাহিনী উত্তরে ফটিকছড়ি ও রাউজান থানা এবং দক্ষিণে আনোয়ারার অধিকাংশ স্থান তাদের নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। নোয়াখালী থেকে চট্টগ্রামের পথে পথে মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা হানাদারদের সঙ্গে খণ্ড খণ্ড সম্মুখযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে।

সীমান্ত এলাকাগুলোতে সংঘাত তীব্র আকার ধারণ করলে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যোগ দেয় ভারতীয় বাহিনী। বীর মুক্তিযোদ্ধারা ভারতীয় সেনাবাহিনীর সহায়তায় গভীর রাতে ক্ষিপ্রগতিতে আক্রমণ করে পঞ্চগড় মুক্ত করে নেয় এবং ঠাকুরগাঁওয়ের দিকে বিজয়ের বেশে এগিয়ে যেতে থাকে। মুক্তিযোদ্ধাদের হামলা ও বোমা বিস্ফোরণে ঢাকার রামপুরা বিদ্যুৎ সরবরাহকেন্দ্র, চট্টগ্রামের পাঁচটি বিদ্যুৎ সাব-স্টেশন ও দুটি পেট্রলপাম্প বিধ্বস্ত হয়, যা আন্তর্জাতিক মিডিয়াসমূহে মুক্তিবাহিনীর সাফল্যের খবর গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করে। বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা, আকাশবাণী এবং স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের সংবাদে প্রচারিত হতে থাকে মুক্তিযোদ্ধাদের নিত্যনতুন বিজয়ের সংবাদ।

তবে ব্যর্থতায় পর্যুদস্ত হয়ে হানাদার বাহিনী বাংলাদেশের সাধারণ জনগণের ওপর তাদের অত্যাচারের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। ওই সময় নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, গেরিলা আক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ায় পাকসেনা ও তাদের দোসররা নিরীহ গ্রামবাসীদের হত্যা এবং অত্যাচারের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে। ওই সময় ঢাকার জিনজিরা এলাকা থেকে গেরিলা সন্দেহে ২২ থেকে ৮৭ তরুণকে হত্যার ঘটনা জানানো হয়। গ্রামে গ্রামে তল্লাশির সময় গুলিতে আহত অন্তত ৩৭ জনের হাসপাতালে ভর্তির খবরও জানানো হয় ওই প্রতিবেদনে। এদিন দৈনিক আনন্দবাজারে লেখা হয়, ‘বিদেশি সংবাদ প্রতিষ্ঠান সিবিএসের সংবাদদাতা গতকাল লিখেছেন- আগুনের রক্তিম শিখায় ঢাকার দিগন্ত রক্তিমাভ। বুড়িগঙ্গা দিয়ে ভেসে যাচ্ছে অগণিত মৃতদেহ।’

১ ডিসেম্বর আগরতলায় অতর্কিত বিমান হামলা চালায় পাকিস্তানের তিনটি যুদ্ধবিমান। এতে পাঁচজন নিহত এবং ৪০ জন ভারতীয় আহত হন। হামলার জবাবে পরদিন ভারতীয় সেনা সদস্যরা আগরতলা খ-ের সেনাপতির কাছে নয়াদিল্লির নির্দেশ পায় পাক এলাকায় ঢুকে পড়ার। একই দিন ভারতকে ‘আক্রমণকারী’ আখ্যা দেওয়ায় ব্রিটেনকে কড়া জবাব দেন ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। দৈনিক আনন্দবাজারে প্রকাশিত সংবাদে ব্রিটেনকে উদ্দেশ করে ইন্দিরা গান্ধী বলেন, ‘সেদিন আর নেই, তিন চার হাজার মাইল দূর থেকে হুকুম জারি আর চলবে না। জাতীয় স্বার্থে আমাদের যা করা উচিত, আমরা তাই করব।’ এ দিন বালুরঘাট-হিলি সীমান্তে ভারতীয়দের পাল্টা আক্রমণে ২০ পাকসেনার মৃত্যু হয়।

ইন্দিরা গান্ধীর পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানি সৈন্য প্রত্যাহারের দাবি অগ্রাহ্য করে পাকিস্তান। এই দাবির কারণে অস্বস্তি প্রকাশ করেন মার্কিন কর্মকর্তারা। এ দিন পাক বেতারের এক খবরে বলা হয়, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খাঁ ভারতের অঘোষিত যুদ্ধের বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে রুশ নেতাদের কাছে নালিশ জানায়।