পাকিস্তানকে সেনা সরানোর আহ্বান ইন্দিরা গান্ধীর
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ১৯৭১ সালের ১ ডিসেম্বর ঘটনাবহুল একটি দিন। এ দিন বাংলাদেশ (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) থেকে পাকিস্তানকে সেনা অপসারণের আহ্বান জানান তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র অষ্টম, একাদশ ও দ্বাদশ খ- থেকে জানা যায়, ভারতের দিল্লিতে রাজ্যসভার অধিবেশনে দেওয়া এক বক্তৃতায় উপমহাদেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার স্বার্থে বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানি সৈন্য অপসারণের নির্দেশ দেওয়ার জন্য পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের প্রতি আহ্বান জানান ইন্দিরা গান্ধী। তিনি বলেন, বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানি সৈন্য অপসারণই সমস্যার শ্রেষ্ঠ সমাধান। ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য বাংলাদেশ ও ভারতের জনসাধারণকে প্রস্তুত থাকতে হবে।
একই দিনে পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডি থেকে জানানো হয়, ভারত পাকিস্তানের আকাশসীমা লঙ্ঘন করেছে। পাকিস্তানি ফাইটারের ধাওয়ায় ভারতীয় যুদ্ধবিমান চলে গেলেও চৌগাছায় মাটি থেকে শত্রুর গুলিতে তাদের স্যাবর যুদ্ধবিমান ভূপাতিত হয়েছে। রাওয়ালপিন্ডি থেকে কেন্দ্রীয় সরকারের মুখপাত্র জানান, ভারত সংঘর্ষ তীব্রতর করে পাকিস্তানকে যুদ্ধের দিকে টেনে আনছে, যদিও পাকিস্তান বরাবরই শান্তি বজায় রাখার এবং যুদ্ধ পরিহার করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
১ ডিসেম্বর নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে গেরিলা তৎপরতা বাড়ার কারণে পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক জান্তার নির্দেশে সামরিক বাহিনীর লোকেরা পুনরায় গ্রামবাসীদের হত্যা এবং বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়ার বর্বর অভিযান শুরু করেছে। গেরিলা সন্দেহে জিঞ্জিরার কতজন যুবককে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে হত্যা করেছে তার সঠিক হিসেব নেই। বুড়িগঙ্গার অপর পারের এই গ্রামটিতে অন্তত ৮৭ জনকে সামরিক বাহিনীর লোকেরা হত্যা করেছে। এদের অধিকাংশই যুবক। নারী এবং শিশুরাও ওদের হাত থেকে রেহাই পায়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র অষ্টম, একাদশ ও দ্বাদশ খ- থেকে জানা যায়, ১ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী গাজীপুরের কালীগঞ্জে বাহাদুরসাদী ইউনিয়নের খলাপাড়া গ্রামে ন্যাশনাল জুট মিলের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের ওপর পৈশাচিক গণহত্যা চালায়। এ গণহত্যায় শহীদ হন ১৩৬ জন নিরীহ মানুষ।
এদিন কালীগঞ্জ ন্যাশনাল জুট মিলের শ্রমিক কর্মচারীরা সকালের নাশতা খেতে বসার সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পার্শ্ববর্তী ঘোড়াশাল ক্যাম্প থেকে নদী পার হয়ে মিলের ভিতর ঢুকে মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজতে থাকে। ওই দিন সকাল থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত ন্যাশনাল জুট মিলের নিরীহ বাঙালি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সারিবদ্ধভাবে লাইনে দাঁড় করিয়ে হানাদার বাহিনী গুলি করে নির্মম গণহত্যা চালায়। এর পর ৩ বা ৪ দিন নিরীহ বাঙালিদের লাশ মিলের সুপারি বাগানে পড়ে ছিল।
আরও পড়ুন:
একে আবদুল মোমেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী
যৌথবাহিনী হানাদারদের হেডকোয়ার্টার আক্রমণ করলে হানাদার বাহিনীর সঙ্গে প্রচ- যুদ্ধ হয়। এ সময় ভারতীয় আর্টিলারির ক্যাপটেন সুধীর শহীদ হন। এদিন সন্ধ্যায় বোদা থানা মুক্ত হয়। এই যুদ্ধে হানাদার বাহিনীর ৬০ থেকে ৭০ সৈন্য হতাহত হয়। পরে ভারতীয় বাহিনী বোদা থানায় অবস্থান নেয়। মুক্তিবাহিনী বোদা থেকে তিন মাইল সামনে ঠাকুরগাঁওয়ের পথে ডিফেন্স নেয়। এ রাতে ভুলক্রমে ভারতীয় বাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর মধ্যে গোলাগুলির কারণে ২০ থেকে ২৫ ভারতীয় জোয়ান হতাহত হয় এবং মুক্তিবাহিনীর খাদ্য ও রান্না বহনকারী পার্টির ৪ থেকে ৫ জন শহীদ হন।
সিলেটের শমসেরনগর ও কুষ্টিয়ার দর্শনা দখলের লড়াই শেষ পর্যায়ে পৌঁছে। এদিন রাতে কর্নেল শফিউল্লাহ, দ্বিতীয় বেঙ্গলের কমান্ডিং অফিসার মেজর মঈন, ১১ বেঙ্গলের কমান্ডিং অফিসার মেজর নাসিমের নেতৃত্বে মুজিব বাহিনী ও বেঙ্গল রেজিমেন্ট ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মেরানী, সিঙ্গারাইল, গৈরালসানী, রাজাপুর ও আজমপুর এলাকা শত্রুমুক্ত করে। যুদ্ধে মুজিববাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা ইয়াসিন খাঁ (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) শহীদ হন। আর ২৩ পাকসেনা নিহত হয়। কুষ্টিয়ার কাছে মুন্সীগঞ্জ ও আলমডাঙ্গা রেলস্টেশনের মধ্যে মুক্তিসেনারা মাইন বিস্ফোরণের মাধ্যমে পাক সৈন্যবাহী ট্রেন বিধ্বস্ত করে। এতে বহু পাকসেনা হতাহত হয়। সিলেটের ছাতক শহরে মুক্তিবাহিনী ও পাকসেনাদের মধ্যে প্রচ- যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে ৬৫ রাজাকার নিহত হয়। আর মুক্তিযোদ্ধারা সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার মুক্ত করে সামনে এগিয়ে যায়। কুমিল্লার কসবা রণাঙ্গনে মুক্তিবাহিনীর হাতে ৬০ জনের বেশি পাকসেনা নিহত হয়।
এদিকে, সাতক্ষীরা মহকুমার কালিগঞ্জ পাকবাহিনী মুক্ত হওয়ায় বিপ্লবী বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ এম কামরুজ্জামান, ফণীভূষণ মজুমদার, তোফায়েল আহমেদ এমএনএ, অর্থসচিব এ জামান, আইজি এম এ খালেক সেখানে বেসামরিক প্রশাসন প্রতিষ্ঠাকল্পে সরেজমিনে পরিদর্শন করেন। অন্যদিকে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়- সিলেট, রংপুর, দিনাজপুর, খুলনা, রাজশাহী ও যশোর জেলার ৬২টি থানা এবং নোয়াখালী জেলার সব চর এলাকায় বেসামরিক প্রশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
আরও পড়ুন:
পাল্টে যেতে পারে আন্দোলনের ধরন