জ্বালানি বিভাগের ভিন্ন ভিন্ন সিদ্ধান্তে বিপাকে গ্রাহক
আবাসিক গ্যাস গ্রাহকদের নিয়ে জ্বালানি বিভাগের ভিন্ন ভিন্ন সিদ্ধান্তে চরম বিপাকে পড়েছেন গ্রাহকরা। একই ইস্যুতে তিন ধরনের সিদ্ধান্তের কারণে গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলোও সিদ্ধান্তহীনতায়।
দেখা গেছে- গ্যাস বিপণন নীতিমালায় বলা আছে এক কথা, জ্বালানি বিভাগের সমন্বয়সভায় বলা হয়েছে আরেক কথা আর কোম্পানিগুলোর বোর্ড মিটিংয়ে নেওয়া হয়েছে ভিন্ন আরেক ধরনের সিদ্ধান্ত।
২০১৪ সালের ১৮ আগস্ট গ্যাস বিপণন নীতিমালার যে গেজেট প্রকাশ করা হয়েছে সেখানে দেখা যায়, কোনো কারণে আবাসিক গ্রাহকদের অস্থায়ী বা স্থায়ীভাবে গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হলে নিয়ম অনুযায়ী গ্যাস বিলসহ অন্যান্য পাওনা পরিশোধ করতে হবে। ন্যূনতম ২ বার অনুনোমোদিত বা অবৈধ কার্যকলাপের জন্য অস্থায়ীভাবে বিচ্ছিন্নকৃত গ্যাস সংযোগের পুনঃসংযোগের ক্ষেত্রে চূড়ান্ত অনুমোদন কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রদান করবেন। এ ছাড়া অস্থায়ী সংযোগ বিচ্ছিন্ন হলে কোম্পানির মহাব্যবস্থাপকই নিয়ম অনুযায়ী পুনঃসংযোগ দিতে পারবেন। কিন্তু বাস্তবে আবাসিক গ্রাহকদের কোনো ধরনের সংযোগই এখন আর কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক দিতে পারেন না। জ্বালানি বিভাগের সচিবের নেতৃত্বে যে বোর্ড, সেখানে অনুমোদন নিতে হয়। এদিকে ২০১৭ সালের ৬ ডিসেম্বর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়সভায় সিদ্ধান্ত হয়- বকেয়া, অবৈধ গ্যাস সংযোগ বা অপসারণ করা হলে বা বৈধ সংযোগের সঙ্গে অবৈধ সংযোগ পাওয়া গেলে, একবার বন্ধ করা হলে পরবর্তীকালে বোর্ডসভার অনুমোদন ছাড়া পুনঃসংযোগ দেওয়া যাবে না। ২০১৯ সালে মন্ত্রণালয়ের এক সমন্বয়সভায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়, বকেয়া বা অবৈধ গ্যাস সংযোগের দায়ে বিচ্ছিন্নকৃত গ্যাস সংযোগ ৪ মাস পার না হলে বোডর্ সভায় উপস্থাপন করা যাবে না।
এদিকে একই বিষয়ে সাম্প্রতিক সময়ে তিতাসের বোর্ড সভায় নেওয়া সিদ্ধান্তে বলা হয়- গ্যাস বিপণন নিয়মাবলি-২০১৪ অনুযায়ী, অতিরিক্ত গ্যাস বিল, বকেয়া গ্যাস বিল, জরিমানা এবং সংযোগ বিচ্ছিন্ন ফিসহ যাবতীয় পাওনা পরিশোধ, অননুমোদিত স্থাপনা অপাসারণ করা হলেও সংযোগ বিচ্ছিন্নের ৬ মাস অতিক্রম না হলে পুনঃসংযোগ প্রদান করা যাবে না। এদিকে গ্যাস বিপণন নীতিমালায় বলা আছে, আবাসিক সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার এক বছরের মধ্যে পুনঃসংযোগের আবেদন না করলে সেটা স্থায়ীভাবে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হিসাবে ধরা হবে। আবাসিক গ্রাহকদের নিয়ে জ্বালানি বিভাগের এমন ভিন্ন ভিন্ন সিদ্ধান্তে চরম বিপাকে গ্রাহকরা।
আরও পড়ুন:
একে আবদুল মোমেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী
বিষয়টি নিয়ে জ্বালানি বিভাগের এক কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, মূলত আবাসিক খাতে অবৈধ সংযোগ নিরুৎসাহিত করতে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে। কারণ বছরের পর বছর চেষ্টা করেও অবৈধ সংযোগ রোধ করা যাচ্ছে না।
তবে এসব নিয়মকানুনে মূলত বৈধ সংযোগ গ্রহণকারীরা বেশি ভোগান্তিতে পড়ছেন। তিনি বলেন, পুরোপুরি অবৈধ সংযোগ গ্রহণকারীরা পুনঃসংযোগের জন্য আবেদন করে না। যাদের হয়তো একটা বা দুটো চুলা অবৈধ বা গ্যাস বিল বকেয়া পড়েছে তারা এসব নিয়মের মধ্যে পড়েছেন। একই বিষয়ে পৃথক সিদ্ধান্ত কেন? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আইনেও বলা আছে প্রয়োজনে সময় সময় নেওয়া সিদ্ধান্ত মেনে সামগ্রিক কার্যক্রম পরিচালনা করা যাবে।
বিষয়টি জানতে চাইলে তিতাস গ্যাস কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী হারুনুর রশীদ মোল্লা বলেন, আমরা আসলে মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কাজ করি। মন্ত্রণালয় থেকে যে সিদ্ধান্ত দেওয়া হবে, সেটাই প্রতিপালন করব।
এদিকে পেট্রোবাংলার এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে আমাদের সময়কে বলেন, বোর্ডের চেয়ারম্যান সাধারণত মন্ত্রণালয়ের সচিব হয়ে থাকেন। সেখানে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির এমডি ছাড়াও এমন অনেকে থাকেন, যাদের কোম্পানির সামগ্রিক কার্যক্রম সম্পর্কে তেমন ধারণাই থাকে না। অনেক সময় না বুঝেই তারা এমন সব প্রস্তাবনা দিয়ে থাকেন বা বাস্তবায়ন করতে বলেন, যার ফলে সামগ্রিক ক্ষতির শিকার হন সাধারণ গ্রাহকরা। পেট্রোবাংলার ওই কর্মকর্তা বলেন, কোম্পানির সামগ্রিক বিষয়ে কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মতামতকে প্রাধান্য দেওয়া উচিত। তবে সত্যিকার অর্থে যেহেতু বোর্ডে চেয়ারম্যান হিসেবে থাকেন সচিব, এ ছাড়া ঊর্ধ্বতন আরও অনেক কর্মকর্তা থাকেন, ফলে কোম্পানির এমডি বা অন্য কর্মকর্তাদের মতামত দেওয়ার তেমন সুযোগ থাকে না কিংবা নানা কারণে তারা মতামত শক্তভাবে উপস্থাপন করেন না।
পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে তিতাসের এক গ্রাহক বলেন, এখানে ছয় মাস বা এক বছরের যে সময় নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে, সেগুলো সঠিকভাবে পালন করা খুবই কঠিন। তিনি বলেন, অনেক ক্ষেত্রেই নিচের দিক থেকে ফাইল এমডির দপ্তর পর্যন্ত পৌঁছতে দিনের পর দিন ঘুরতে হয়। একটা ফাইল পুনঃসংযোগের জন্য বোর্ড পর্যন্ত পৌঁছতেই এক বছরের বেশি সময় পার করে দেন কর্মকর্তা কর্মচারীরা। তিনি বলেন, আমি নিজেও তিতাসে ঘুরছি আবাসিক পুনঃসংযোগের জন্য। কিন্ত আমাকে বলা হয়েছে ৬ মাস পরে আসতে।
ওয়েবসাইটের তথ্যানুযায়ী, তিতাস গ্যাস কোম্পানির মোট গ্রাহক ২৮ লাখ ৭৭ হাজার ৬০০টি। এর মধ্যে আবাসিক গ্রাহক ২৭ লক্ষাধিক। অন্যদিকে কর্ণফুলী গ্যাস কোম্পানির মোট গ্রাহক ৬ লাখ ২ হাজার ৩৮৫। এর মধ্যে আবাসিক গ্রাহক ৫ লাখ ৯৮ হাজার। জালালাবাদ গ্যাস কোম্পানির মোট গ্রাহক ২ লাখ ২১ হাজার ৪৬১ যার মধ্যে আবাসিক গ্রাহক ২ লাখ ১৯ হাজার ৭৬৪। দেখা গেছে, গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলোর যে সংখ্যক গ্রাহক রয়েছে, তার ৮০ শতাংশই আবাসিক। অথচ আবাসিক গ্রাহকদের সেবা দেওয়ার ক্ষেতে উদাসীন কোম্পানিগুলো।
আরও পড়ুন:
পাল্টে যেতে পারে আন্দোলনের ধরন