রওশন-কাদের সমীকরণ ঘিরে নানামুখী ভাবনা

মুহম্মদ আকবর
৩০ নভেম্বর ২০২৩, ০০:০০
শেয়ার :
রওশন-কাদের সমীকরণ ঘিরে নানামুখী ভাবনা


নির্বাচন কমিশন ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী আজ বৃহস্পতিবার মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ দিন। সব ঠিক থাকলে রাজনীতির অনেক সমীকরণের হিসাব মিলবে আজ। শেষ পর্যন্ত কোন কোন দল নির্বাচনে যাবে আর কোন দলই বা যাবে না, তা স্পষ্ট হয়ে যাবে আজ। একইভাবে বহুল ‘আলোচিত-সমালোচিত’ দল জাতীয় পার্টি (জাপা) কোন প্রক্রিয়ায় নির্বাচনে অংশ নেবে, সে সম্পর্কেও ধারণা পাওয়া যাবে। গতকাল রাতে গুলশানের বাসায় অনুসারীদের সঙ্গে বৈঠকের পর দলের শীর্ষনেতাদের বিরুদ্ধে অসহযোগিতার অভিযোগ এনে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন জাপার প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদ। গত সোমবার তার অনুসারীদের বাদ রেখে ২৮৭ আসনে মনোনয়ন ঘোষণা করেছে দলটি। বাদ পড়েছেন এরশাদপুত্র সাদ এরশাদ ও জাপার সাবেক মহাসচিব মশিউর রহমান রাঙ্গা। এ নিয়ে দলের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া বিরাজ করছে।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এখন পর্যন্ত আসন বণ্টন নিয়ে সমঝোতার জন্য জাতীয় পার্টিকে ডাকেনি। ফলে জাতীয় পার্টির ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত দলটির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ। দলটির শীর্ষনেতাদের গতিবিধিতে শঙ্কিত খোদ কেন্দ্রীয় নেতারাও। বছরজুড়ে নির্বাচনবিরোধী কথাবার্তা বললেও হঠাৎ করে নির্বাচনে যাওয়ার চিন্তাটাও আওয়ামী লীগকে ভাবনার মধ্যে ফেলেছে। তবে রওশন এরশাদ ও জিএম কাদেরের সম্পর্কের সমীকরণ কোন দিকে যাচ্ছে, তার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে বলে ধারণা অনেকের।

বিএনপির নির্বাচনে না আসা, জাপায় অন্তর্কোন্দলের অবসান না হওয়া এবং আওয়ামী লীগের সঙ্গে দলটির সমঝোতা না হওয়ায় গত দ্ইু সপ্তাহ আগে জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান এবং ঢাকা মহানগর দক্ষিণ জাতীয় পার্টির সভাপতি সৈয়দ আবু হোসেন বাবলার একটি বক্তব্য ভাবনার খোরাক দিয়েছে। তিনি একাধিকার বলেছেন, ফের নির্বাচনের ট্রাম্পকার্ড হবে জাতীয় পার্টি।

এদিকে বিএনপিসহ সমমনা দল ও বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি নেতৃত্বাধীন বাম গণতান্ত্রিক জোটের শরিকরা নির্বাচনে না যাওয়ার পক্ষে রয়েছেন। অন্যদিকে আওয়ামী লীগসহ নির্বাচনে যেতে আগ্রহী ইসিতে নিবন্ধিত ৩৪টি রাজনৈতিক দল। নির্বাচনমুখী দলগুলোর মধ্যে আওয়ামী লীগের

পরই এগিয়ে জাপা। কিন্তু আসন্ন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের কাছে জাপা যাবে, নাকি আওয়ামী লীগ জাপার কাছে যাবেÑ এ নিয়ে চলছে আলোচনা। পাশাপাশি বিএনপির দিকেও জাপা ঢু মারছে কিনা, এ নিয়েও গুঞ্জন রয়েছে। এতসব আলোচনায় প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক, আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাপা কী তা হলে ফের ট্রাম্পকার্ড হিসেবে আবির্ভূত হবে?

কোন অর্থে সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা জাপাকে ট্রাম্পকার্ড বলছেন? তা জানার জন্য দলটির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা হয়। নেতৃবৃন্দের ভাষ্য, ১৯৭৫ পরবর্তী বাংলাদেশে জাতীয় পার্টিকে ১৯৯০-এ অভ্যুত্থানের মাধ্যমে পতন ঘটানো এবং পরে এরশাদের শাসনামলকে সর্বোচ্চ আদালত অবৈধ ঘোষণা করলেও দলটি এ দেশের রাজনীতি থেকে হারিয়ে যায়নি। বরং বারবার নানা ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে ক্ষমতায় থেকেছে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে সরকার গঠন করার ক্ষেত্রে জাতীয় পার্টির ভূমিকা ছিল। এরপর মাঝে আওয়ামী লীগ একবার হোঁচট খেলেও আজ অবধি জাতীয় নির্বাচনে অনিবার্য দল হিসেবেই রয়ে গেছে জাপা। এবারও তাই। নেতৃবৃন্দ আরও বলেন, সুতার টানে নানা দিকে গেলেও এবার জাতীয় পার্টির হিসাব পাক্কা। তাদের বাদ দিয়ে নির্বাচনী হিসাব কষা কঠিন।

জানা গেছে, ২০১৪ সালের নির্বাচনে নানা সমীকরণ তৈরির প্রেক্ষাপটে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ নির্বাচন বর্জন করেন। অন্যদিকে রওশন এরশাদের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টির একটি অংশ নির্বাচনে অংশ নেয় এবং জাপা থেকে ৩৪ জন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ওই সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা হন রওশন এরশাদ। উপনেতা হন জিএম কাদের। ওই নির্বাচনের আগে এরশাদের রহস্যজনক অসুস্থতা ও সিএমএইচে ভর্তি থাকা নিয়ে সারাদেশে আলোচনার সৃষ্টি হয়। পরে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে এরশাদ সিএমএইচ থেকে সরাসরি বঙ্গভবনে যান শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে।

২০১৮ সালের নির্বাচনকে সামনে রেখে ২০১৬ সালে জিএম কাদেরকে কো-চেয়ারম্যান করা নিয়ে বেশ সংকটে পড়ে জাতীয় পার্টি। একপর্যায়ে রওশনকে সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন এরশাদ। পরে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা হন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। উপনেতা বানান ছোট ভাই জিএম কাদেরকে। এর কিছুদিন পরই জিএম কাদেরকে সরিয়ে পুনরায় উপনেতা বানান স্ত্রী রওশন এরশাদকে। এরশাদ মারা যাওয়ার পর জিএম কাদের দলের চেয়ারম্যান হন। কিন্তু রওশনের সঙ্গে তার বিরোধ মেটেনি।

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে ফের টানাপোড়েন শুরু হলে বুধবার রাতে গুলশানের বাসায় অনুসারীদের সঙ্গে বৈঠক করেন সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা বেগম রওশন এরশাদ। পরে সাংবাদিকদের উদ্দেশে পাঠ করা লিখিত বক্তব্যে তিনি নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, জাতীয় পার্টি দলের নেতাদের অবমূল্যায়ন করেছে। এ কারণে তিনি নির্বাচন করবেন না।

এদিকে নির্বাচন ছাড়াও দলীয় কার্যক্রম নিয়ে রওশন ও কাদেরের পৃথক বক্তব্য, কর্মসূচি ও সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাঠানোর বিষয়গুলো থেকে দেখা যায়, দুই নেতার বিরোধ আগের মতোই আছে।

১৯ নভেম্বর মঙ্গলবার রাত ৮টার দিকে বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে দেখা করতে যান জাপার প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদ। এ সময় তিনি মনোনয়ন দাখিলের তারিখ পেছানোর দাবিসহ ৫ দফা দাবি তুলে ধরেন। এ সময় তার সঙ্গে মশিউর রহমান রাঙ্গা, গোলাম মসীহ, সাদ এরশাদ, কাজী মামুন প্রমুখও ছিলেন। এর আগে ১৪ নভেম্বর দলটির চেয়ারম্যান ও জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় উপনেতা জিএম কাদের রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করেন। এ সময় তার সঙ্গে জাপার চেয়ারম্যানের আন্তর্জাতিকবিষয়ক উপদেষ্টা মশরুর মাওলা উপস্থিত ছিলেন। সেখান থেকে বেরিয়ে জিএম কাদের জানিয়েছিলেন, রাষ্ট্রপতির চায়ের আমন্ত্রণে তিনি সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে গিয়েছিলেন।

এরও আগে গত ১ নভেম্বর জাতীয় সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টির ১৭ জন সংসদ সদস্য অধিবেশন চলাকালে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করেন। জাতীয় পার্টির এমপি এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি রওশন আরা মান্নানের উদ্যোগে দলটির সদস্যরা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে যান। এ সময় জাপার প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ, রুস্তম আলী ফরাজী, সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা প্রমুখ থাকলেও ছিলেন না দলটির চেয়ারম্যান জিএম কাদের ও মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু।

রওশন এরশাদ ও জিএম কাদের কখনো এক চিন্তায় আসতে পারেননি। রওশন এরশাদ একাধিকবার বলেছেন, তিনি আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটবদ্ধভাবে নির্বাচনে যেতে রাজি। নির্বাচন কমিশন গঠনের শুরু থেকেই রওশন ওই কমিশনের প্রতি তার আস্থার কথা প্রকাশ করে আসছেন। সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, এ মুহূর্তে দলটির কিছু বিষয় অতীতের তুলনায় ভিন্ন। জিএম কাদের অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে রওশনকে দলে সাইনিং পাওয়ার থেকে সরিয়েছেন। আর এটি বুঝতে পেরে রওশন ও তার অনুসারীরা বিভিন্ন সময় জিএম কাদেরকে অবৈধ চেয়ারম্যান বলা শুরু করেন। নির্বাচন ইস্যুতে সমঝোতায় না এলে দলটি আবারও ভাঙনের মুখে পড়বে, নাকি জাতীয় পার্টি অন্যদিকে মোড় নেবেÑ এ নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে অনেকের।

জাপার ইতিহাস থেকে জানা যায়, ছাত্র আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ১৯৯০ সালে এরশাদ সরকারের পতন হয়। এর পর থেকে আজ পর্যন্ত অনেক ভাঙা-গড়ার মধ্য দিয়ে গেছে দলটি। এই ভাঙা-গড়ার কাজটিও জাতীয় সংসদ নির্বাচন কিংবা দলীয় নেতা নির্বাচনের জের ধরেই হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। আর এভাবেই পর্যায়ক্রমে জাতীয় পার্টি (জাপা) ভেঙে ছয়টি দলে ভাগ হয়ে আছে। এগুলো হলো- বর্তমানে জিএম কাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি (জাপা), আনোয়ার হোসেন মঞ্জু নেতৃত্বাধীন জেপি, আন্দালিব রহমান পার্থের নেতৃত্বাধীন বিজেপি, ডা. মতিনের নেতৃত্বাধীন বিজেপি, মোস্তফা জামান হায়দারের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি ও সর্বশেষ এরশাদের সাবেক স্ত্রী বিদিশা সিদ্দিক নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি (পুনর্গঠন)। এর মধ্যে জাতীয় পার্টি (জিএম কাদের), জেপি (মঞ্জু), বিজেপি (পার্থ), জাতীয় পার্টি (ডা. মতিন)Ñ এই চার দলের নিবন্ধন রয়েছে। জেপি (মঞ্জু) বর্তমান আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন চৌদ্দ দলের অন্যতম শরিক। বিজেপির প্রতিষ্ঠাতা আন্দালিব রহমান পার্থ’র বাবা নাজিউর রহমান মঞ্জু। নাজির রহমান মঞ্জুর সঙ্গে মহাসচিব ছিলেন বর্তমানে জিএম কাদেরের সঙ্গে থাকা জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান সাবেক ছাত্রলীগ নেতা কাজী ফিরোজ রশীদ। বিজেপি বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটে থাকলেও পরে বের হয়ে যায়। মোস্তফা জামান হায়দার যে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান, এই দলের প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত কাজী জাফর।

যদিও জাপায় কোনো দ্বন্দ্ব নেই, ক্ষোভ নেইÑ এমনটি গণমাধ্যমকে বলেছেন দলটির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু। তিনি বলেছেন, জিএম কাদেরের নেতৃত্বে সবাই ঐক্যবদ্ধ। নির্বাচনে যাওয়ার বিষয়ে চুন্নুর ভাষ্য, নির্বাচন সুষ্ঠু হবে এমন আশ^াস পেয়ে তারা নির্বাচনে যাচ্ছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দলটির এক কো-চেয়ারম্যান আমাদের সময়কে বলেন, বিএনপি না এলে জাপা নির্বাচনে গিয়ে ফের নিশ্চিতভাবে বিরোধী দলের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারবে। এর জন্য দরকার আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা। এর বিকল্প কোনো পথ নেই। অন্তত রওশন এরশাদ এটির বিকল্প কিছু ভাবছেন না।