সেই চেনা সংকটে জাতীয় পার্টি

এখনো সবুজ সংকেত মিলছে না আ.লীগের

মুহম্মদ আকবর
২৬ নভেম্বর ২০২৩, ০০:০০
শেয়ার :
সেই চেনা সংকটে জাতীয় পার্টি

নির্বাচনে যাওয়া রাজনৈতিক দলগুলোর মনোনয়নপ্রত্যাশীদের রীতিমতো অস্থির সময় কাটছে। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময়ও আর মাত্র চার দিন বাকি। এ অবস্থায় জাতীয় পার্টির (জাপা) চিরচেনা ভেতরে-বাইরের সংকট শেষ মুহূর্তে আবারও তীব্র হয়ে উঠেছে। ইতোমধ্যে ৩শ আসনে মনোনয়ন ফরম বিতরণ শেষে প্রার্থী বাছাইয়ের কাজে হাত দিয়েছে দলটি। কিন্তু দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদের দলের মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ না করায় উদ্বেগ ছড়াচ্ছে দলটিতে। এর মধ্যে দফায় দফায় নিজের অনসুারীদের নিয়ে বৈঠক করছেন রওশন। তিনি চাচ্ছেন নিজের অনুসারীদের মনোনয়ন নিশ্চিত করতে। আবার দলটির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু দাবি করেছেন, রওশন শুধু নিজের ও সন্তানসহ মাত্র তিনজনের জন্য মনোনয়ন ফরম চেয়েছেন। অন্যদিকে, বারবার চেষ্টা সত্ত্বেও নির্বাচনী সমঝোতায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাড়া পাচ্ছে না দলটি। ফলে একদিকে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব; আরেকদিকে জোটগত সমঝোতা না হওয়ায় বেকায়দায় পড়েছে জাপার নির্বাচনী যাত্রা।

জানা গেছে, সময়সীমা একদিন বাড়িয়ে দেওয়া এবং সম্মতি পেলে মনোনয়ন ফরম বাসায় পৌঁছে দেওয়ার কথা দল থেকে বলা হলেও এখন পর্যন্ত আগ্রহী হননি রওশন এরশাদ। এর মধ্যে গতকাল শনিবার নিজের বাসায় সকালে এবং বিকালে নির্বাচন বিষয়ে নিজের অনুসারীদের নিয়ে বৈঠক করেন তিনি। এতে সিদ্ধান্ত নেন যে, দল থেকে যাদের অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে তাদের নির্বাচনে যাওয়ার সুযোগ না দিলে তিনি দলীয় ফরম কিনবেন না।

রওশন এরশাদের বাসায় দলীয় ফরম উঠানো না উঠানো বিষয়ে বৈঠক হয়েছে বলে তার প্রেস উইং থেকে নিশ্চিত করা হয়েছে। রওশনের সিদ্ধান্ত হচ্ছে রওশন পুত্র সাদ এরশাদ, মশিউর রহমান রাঙ্গা, গোলাম মসিহ, কাজী মামুন, ইকবাল হোসেন রাজু, এমএ গোফরান, এসএমএম আলম, অধ্যাপক দেলোয়ার, দয়াল বড়ুয়া, নুর ইসলাম নুরু, জিয়াউল হক মৃধা, আকতার হোসেন, ফখরুজ্জামান জাহাঙ্গীরকে দলে ফিরিয়ে নেওয়া এবং যোগ্যতার ভিত্তিতে মনোনয়ন দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করলে তিনি দলীয় ফরম নেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করবেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জাপার একজন কো-চেয়ারম্যান আমাদের সময়কে বলেন, ‘জাতীয় পার্টির বাস্তবতা হচ্ছে এই মুহূর্তে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা ছাড়া সংসদে যাওয়ার মতো প্রার্থী নাই। সে বিবেচনায় আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতার চেষ্টা করা হচ্ছে। প্রথমত এক শত আসন চাওয়া হবে। একপর্যায়ে অন্তত ২৫টি আসনের

নিশ্চিয়তা পাওয়ার চেষ্টা করা হবে। যদিও এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগের সবুজ সংকেত পায়নি দলটির শীর্ষ নেতৃত্ব।

এর আগে ১৯ নভেম্বর রাতে বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে দেখা করতে যান জাপার প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদ। ১৪ নভেম্বর রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করেন দলটির চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের (জিএম কাদের)। তার আগে গত ১ নভেম্বর জাতীয় সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টির ১৭ জন সংসদ সদস্য অধিবেশন চলাকালে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করেন। জাতীয় পার্টির এমপি এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি রওশন আরা মান্নানের উদ্যোগে দলটির সদস্যরা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে যান। তবে দলটির চেয়ারম্যান জিএম কাদের ও মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু সাক্ষাৎ করতে যাননি। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎকালে ছিলেন জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী ফিরোজ রশিদ, রুস্তম আলী ফরাজী, সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা প্রমুখ।

প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন ছাড়া দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদ ও চেয়ারম্যান জিএম কাদের কোনো বৈঠক একসঙ্গে করেননি। নির্বাচন সামনে রেখেও তারা ঐকমত্য হতে পারেননি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জাপার এই ভেতরের সংকট নব্বইয়ের পর থেকেই। তবে নির্বাচনের আগে-পরে নানা রসায়ন করে সব সময় দেশের ক্ষমতায় থেকেছে। এবারও ভিন্ন কিছু হবে না। সময় হলে ঠিকই তারা ক্ষমতার স্বাদ গ্রহণ করে নেবে। তবু দলের এই দ্বন্দ্ব কমেনি, কমবে না।

এর আগে ২০১৪ সালের নির্বাচনে নানা সমীকরণ তৈরির প্রেক্ষাপটে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ নির্বাচন বর্জন করেন। অন্যদিকে রওশন এরশাদের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টির একটি অংশ নিয়ে নির্বাচনে অংশ নেয় এবং এরশাদের সিএমএইচে ভর্তি থাকা নিয়ে সারাদেশে আলোচনার সৃষ্ট হয়। পরে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে এরশাদ সিএমএইচ থেকে সরাসরি বঙ্গভবনে যান শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে। ২০১৮ সালের নির্বাচনকে সামনে রেখে ২০১৬ সালে জিএম কাদেরকে কো- চয়ারম্যান করা নিয়ে বেশ সংকটে পড়ে জাতীয় পার্টি। একপর্যায়ে রওশনকে সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন এরশাদ। এরশাদ মারা যাওয়ার পর জিএম কাদের দলের চেয়ারম্যান হন। কিন্তু রওশনের সঙ্গে তার বিরোধ মেটেনি।

এদিকে, দলের সর্বশেষ অবস্থান জানাতে শনিবার মজিবুল হক চুন্নু গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমাদের সম্মানিত প্রধান পৃষ্ঠপোষক বেগম রওশন এরশাদ গতকালও (শুক্রবার) আমাকে ব্যক্তিগতভাবে ফোন করেছিলেন। তিনি তার ছেলে সাদ এরশাদ এবং ডা. কেআর ইসলামের জন্য তিনটি মনোনয়ন ফরম চেয়েছেন। আজ তার লোক এলে আমরা মনোনয়ন ফরম দিয়ে দেব। বেগম রওশন এরশাদ বললে, আমরা তার মনোনয়ন ফরম পাঠিয়ে দেব। প্রয়োজন হলে আমি নিজে গিয়ে পৌঁছে দেব।’ তবে রওশনের নতুন সিদ্ধান্ত হচ্ছে বহিষ্কৃতদের দলে এনে মনোনয়ন দিলে তিনি মনোনয়ন ফরম নেবেনÑ এ বিষয়ে চুন্নুকে অবহিত করলে তিনি আমাদের সময়কে, আমাদের কেউ এ বিষয়ে জানায়নি।

দলের অভ্যন্তরীণ অবস্থা জানতে চাইলে চুন্নু বলেন, ‘জাতীয় পার্টি জনবন্ধু জিএম কাদেরের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ। জাতীয় পার্টিতে কোনো দ্বিধা-দ্বন্দ্ব নেই। জাতীয় পার্টি ঐক্যবদ্ধ রয়েছে।’

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমরা ৩শ আসনেই লাঙল নিয়ে নির্বাচন করব। প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলের নিজস্ব কৌশল থাকে। আমরা আমাদের নিজস্ব কৌশল নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি। যারা দলে দীর্ঘদিন পার্টিতে অবদান রেখেছেন, এলাকায় যার জনপ্রিয়তা, দেশ ও মানুষের প্রতি তার কতটুকু দরদ আছে, এসব বিবেচনা করেই আমরা মনোনয়ন চূড়ান্ত করব। আমাদের মনোনয়নপ্রত্যাশীরা সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন চায়। আমরা চাই সাধারণ ভোটাররা যেন তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন।’