শেষ দিনেও ঐকমত্যের কোনো লক্ষণ নেই
বেলেমের আকাশে সকাল থেকেই ছিল টানটান উত্তেজনা। আমাজনের এই প্রান্তঘেঁষা সবুজ শহরটিতে বিশ্বের নেতারা যখন জলবায়ু সংকট মোকাবিলার শেষ দৌড়ে নেমেছেন, ঠিক তখনই কপ-৩০ আলোচনায় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে এক গভীর বাস্তবতা; ভূরাজনৈতিক স্বার্থের লড়াই এখন সিদ্ধান্তমূলক অগ্রগতিকে প্রায় অসম্ভব করে তুলেছে। গতকাল শুক্রবার কনফারেন্সের শেষ দিনে এসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় দেশগুলোর অবস্থান এমনভাবে বিভক্ত হয়ে পড়েছে যে, নির্ধারিত শেষ সময় পেরিয়ে গেলেও চূড়ান্ত ঐকমত্যের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
বৃহস্পতিবারের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে মূল প্লেনারি ছয় ঘণ্টা স্থগিত থাকায় আলোচনা ব্যাহত হয়েছিল। তবে বৃহস্পতিবার প্রকাশিত নতুন খসড়া যেন আগুনের মতো কাজ করেছে। বহুল প্রত্যাশিত ‘জীবাশ্ম জ্বালানি ফেজ আউট’ বা পর্যায়ক্রমে ব্যবহারের সমাপ্তি সংক্রান্ত কোনো উল্লেখই সেখানে রাখা হয়নি। বরং ভাষা আরও দুর্বল করা হয়েছে, যা সঙ্গে সঙ্গে তীব্র সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, চিলি, কলম্বিয়া, কুক আইল্যান্ডসসহ অন্তত ২৯টি দেশ বৃহস্পতিবার গভীর রাতে ব্রাজিলীয় সভাপতিত্বকে চিঠি দিয়ে জানায়, ফসিল জ্বালানি উত্তরণের রোডম্যাপ ছাড়া কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণযোগ্য নয়।
কিন্তু ঘোষিত যে রোডম্যাপের কথা বলা হচ্ছে, সেটিও বাধ্যতামূলক কিছু নয়। এর মাধ্যমে শুধু ভবিষ্যতের দীর্ঘ আলোচনার কাঠামো তৈরি হবে, যেখানে দেশগুলো তাদের মতামত জানাবে, কিন্তু উৎপাদন বা ব্যবহার কমানোর নির্দিষ্ট বছর বা মাইলস্টোন স্থির হবে না। অর্থাৎ এটি মূলত ‘সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করার সিদ্ধান্ত’। এই স্বল্প অগ্রগতিও মানতে রাজি নয় সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন আরব গ্রুপ। তাদের পাশে রয়েছে বলিভিয়া, ভেনেজুয়েলা ও কয়েকটি উন্নয়নশীল দেশের জোট ‘লাইক-মাইন্ডেড গ্রুপ’। ভারত ও চীনের অবস্থানও স্পষ্ট নয়। ফলে আলোচনার আড়ালে শক্তিশালী বিরোধী জোট ক্রমেই সক্রিয় হয়ে উঠেছে।
অন্যদিকে নাইজেরিয়া, সিয়েরা লিওন, কলম্বিয়ার মতো জ্বালানিনির্ভর অর্থনীতিগুলো জলবায়ু ঝুঁকির চাপের কারণে উত্তরণের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। এতে আলোচনায় বিরল এক বিভাজন তৈরি হয়েছে। সভার সভাপতিত্বকারী দেশ ব্রাজিলের ওপরও চাপ বাড়ছে। সম্মেলনের শুরুতে তারা যে ‘মুতিরাঁও’ অর্থাৎ উন্মুক্ত ও অংশগ্রহণমূলক ঐতিহ্য ব্যবহারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, আলোচনা শেষে তার ছিটেফোঁটাও দেখা যাচ্ছে না। দেশগুলো অভিযোগ করেছে, ব্রাজিল আলাদা বৈঠকে দেশভিত্তিক সমঝোতার চেষ্টা করছে, ফলে সামষ্টিক আলোচনার স্বচ্ছতা কমে গেছে। বিশেষভাবে বলা হয়েছেÑ আরব গ্রুপের মতামতকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
আরও পড়ুন:
রাজধানীতে কিশোরীসহ ২ জনের মরদেহ উদ্ধার
২০ নভেম্বরের অগ্নিকাণ্ড এবং তার প্রভাব গতকালও ছিল স্পষ্ট। প্লেনারি অধিবেশনে অংশগ্রহণকারীরা জানিয়েছেন, আগুনের ফলে ছয় ঘণ্টা আলোচনার সময় হারানো হয়েছে। তবে আসল সমস্যার উৎস হলো রাজনৈতিক অচলাবস্থা। জীবাশ্ম জ্বালানি, ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস লক্ষ্য বজায় রাখা এবং দরিদ্র দেশগুলোর জন্য আর্থিক সহায়তাÑ এই তিনটি মূল ইস্যুতে এখনও গভীর মতপার্থক্য রয়ে গেছে। খসড়ায় থাকা ‘গ্লোবাল ইমপ্লিমেন্টেশন অ্যাক্সিলারেটর’ প্রস্তাবকে অনেকেই বলেছেন ‘অপর্যাপ্ত ও অস্পষ্ট’। ক্ষতিগ্রস্ত দরিদ্র দেশগুলোর জন্য অর্থায়ন বিষয়েও কোনো সুস্পষ্ট অগ্রগতি নেই।
জলবায়ু বিজ্ঞান ও মানবিক বাস্তবতা একদিকে, আর বৈশ্বিক জ্বালানি রাজনীতি অন্যদিকেÑ বেলেমের এই কনফারেন্স এখন এক প্রকার অস্তর্পণ-বিধ্বস্ত অবস্থায় দাঁড়িয়ে। অনেক দেশের কূটনীতিকের মতে, আলোচনার টেবিলে থাকা সব খসড়া এবং প্রস্তাব ‘অপ্রতুল, দুর্বল ও বাস্তবায়নযোগ্য নয়’। ইউরোপীয় কমিশনার ভোপকে হোকস্ত্রা বলেন, ‘আমরা এমন খসড়া গ্রহণ করতে পারি না। এখন আমরা যেখানে আছি, সেখানে থেকে যাওয়া সম্ভব নয়। নো-ডিল পরিস্থিতি আসন্ন।’
গতকাল শুক্রবার সকাল থেকে দেশের প্রতিনিধিরা চূড়ান্ত খসড়া নিয়ে দরকষাকষি শুরু করেছেন। সৌদি আরব, ভারত, চীনসহ বড় জ্বালানিনির্ভর দেশগুলো ক্রমশ জীবাশ্ম জ্বালানি রোডম্যাপ থেকে নিজেরা বেরিয়ে আসতে চায়। বিপরীতে কলম্বিয়া, সিয়েরা লিওন এবং নাইজেরিয়ার মতো কিছু দেশ রোডম্যাপের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছে। দেশের অগ্রাধিকার, অর্থায়ন এবং রাজনৈতিক চাপ মিলিয়ে কপ ৩০-এর চূড়ান্ত খসড়া প্রায় নিশ্চিতভাবে অতিরিক্ত সময়ে যাচ্ছে।
আরও পড়ুন:
নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে এলডিপি?
কপ-৩০ জলবায়ু সম্মেলনের শেষ পর্যায়ে সম্মেলন সভাপতি দেশগুলোর প্রতি মিলিতভাবে চুক্তিতে পৌঁছানোর আহ্বান জানিয়েছেন। গত রাতের আলোচনার পর তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোকে জীবাশ্ম জ্বালানি কমানোর রোডম্যাপ প্রণয়নে বাধা দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। একই সময়ে বেশ কিছু উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশ এই রোডম্যাপ অন্তর্ভুক্ত করা তাদের জন্য ন্যায্য সীমা বলে উল্লেখ করেছে। নাগরিক সমাজও সমালোচনা করেছে যে ধনী দেশগুলো এখনও দরিদ্র দেশের জলবায়ু কর্মসূচির জন্য প্রতিশ্রুত অর্থ প্রদান করছে না।
কপ ৩০-এর সভাপতি আন্দ্রে কোরেয়া দো লাগো বলেন, আমাদের এই প্যারিস চুক্তির ব্যবস্থাকে সহযোগিতার মনোভাবের সঙ্গে সংরক্ষণ করতে হবে, কে জিতবে বা হারবে তা নিয়ে নয়। আমরা জানি, যদি আমরা এটি শক্তিশালী না করি, সবাই হারবে। তিনি আরও উল্লেখ করেন, বিশ্ব বর্তমানে বিপজ্জনক ২.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস উষ্ণায়নের দিকে এগোচ্ছে এবং মানুষকে জলবায়ুর প্রভাব থেকে রক্ষা করার জন্য তহবিল অপর্যাপ্ত। চরম আবহাওয়ার ঘটনা আমাদের সতর্ক করছে, আমাদের কাজ অত্যন্ত জরুরি, বলেন দো লাগো।
তিনি বলেন, প্যারিস চুক্তি ইতোমধ্যেই অনেক কিছু অর্জন করেছে, যা শুধু দেশের কাজ নয়, নাগরিক, সম্প্রদায়, ব্যবসা ও প্রযুক্তির কার্যক্রমকেও এগিয়েছে। তবে এটি আরও শক্তিশালী করার প্রয়োজন রয়েছে। চুক্তি গৃহীত হয় সম্মতির ভিত্তিতে, যা কিছু দেশকে কার্যকর ভেটো দেওয়ার ক্ষমতা দেয়। তেল উৎপাদনকারী আরব দেশগুলোর মতো ছোট গোষ্ঠীর প্রভাব থাকলেও দো লাগো মনে করান, যেই সম্মতি অনেককে বিরক্ত করে, সেটিই এই ব্যবস্থার শক্তি। দো লাগো জলবায়ু কর্মসূচির সুফলেও গুরুত্বারোপ করেছেন। তিনি বলেন, আমরা একটি নতুন অর্থনীতি তৈরি করছি, যা বর্ধন, কর্মসংস্থান ও উন্নয়নের অসাধারণ সুযোগ দিচ্ছে। এটি একটি ইতিবাচক এজেন্ডা এবং আমাদের বিভক্ত হতে হবে না। তবে তিনি উল্লেখ করেন যে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমেরিকার প্রস্থান একটি চ্যালেঞ্জ।
এদিকে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস সৌদি আরবকে কপ ৩০-এ গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করছে বলে চিহ্নিত করেছেন। কিছু ইউরোপীয় কর্মকর্তাও জানিয়েছেন, এবারের সম্মেলনে সৌদি আরব আগের চেয়ে আরও দৃঢ়ভাবে তাদের অবস্থান উপস্থাপন করেছে। তবে গুতেরেসের মুখপাত্র স্টেফানে ডুজারিক বলেন, ক্লোজ ডোর আলোচনার অংশগ্রহণকারীদের ব্যাখ্যা সঠিক নয়, সৌদি আরবকে এককভাবে নির্দেশ করা হয়নি। শেষ সময়ে সব দেশের মন্ত্রীদের একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে, যেখানে চূড়ান্ত চুক্তি নিয়ে আলোচনা ও সমাধানের চেষ্টা করা হবে।