সংকটে বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি
দেশে পাঁচটি কয়লাখনি আবিষ্কৃত হলেও একমাত্র বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি থেকেই নিয়মিত কয়লা উত্তোলন করা হয়। এই কয়লা দিয়েই বড়পুকুরিয়া ৫২৫ মেগাওয়াট ক্ষমতার কেন্দ্রটি বিদ্যুৎ উৎপাদন করে থাকে। তবে দীর্ঘদিন ধরে বিদ্যুৎকেন্দ্রের একাধিক ইউনিট বন্ধ থাকায় এবং কেন্দ্রটি নিয়মিত চালু না থাকায় বড় ধরনের সংকটে পড়েছে কয়লাখনিটি।
একদিকে বিদেশি ঠিকাদারদের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী কয়লা উত্তোলন অব্যাহত রাখতে হচ্ছে, অন্যদিকে বিদ্যুৎকেন্দ্র কয়লা না নেওয়ায় কোল ইয়ার্ডে বিপুল পরিমাণ কয়লা জমে পাহাড় হয়েছে। ব্যবহৃত না হওয়ায় ক্ষতিগ্রস্তও হচ্ছে উৎপাদিত কয়লা। খনি থেকে বাইরের ক্রেতাদের কয়লা বিক্রির অনুমোদন না থাকায় আরও জটিলতা তৈরি হয়েছে। ফলে আর্থিক সংকট ও অচলাবস্থার ঝুঁকি বাড়ছে সরকারি এই খনির। ঘটতে পারে অগ্নিকাণ্ডের মতো দুর্ঘটনা।
বাইরের ক্রেতাদের কাছে বিক্রির উদ্যোগ
জ্বালানি বিভাগ ও খনি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, বিদ্যুৎকেন্দ্রই একমাত্র ক্রেতা হওয়ায় নতুনভাবে বাইরের ক্রেতাদের কাছে কয়লা বিক্রির প্রক্রিয়া চালু করা নিয়ে আলোচনা চলছে। বাইরের সাধারণ ক্রেতারা যেন কয়লা কিনতে পারে সেই প্রক্রিয়া অনুমোদনের চেষ্টা করছে খনি কর্তৃপক্ষ। কারণ নিয়মিত উৎপাদিত কয়লা বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) গ্রহণ না করায় খনির কোল ইয়ার্ডে মজুদ বিপজ্জনক মাত্রায় পৌঁছেছে।
বড়পুকুরিয়া কয়লাখনির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবু তালেব ফারাজী বলেন, বিদ্যুৎকেন্দ্রে কয়লার ব্যবহার কমে যাওয়ায় উত্তোলিত কয়লা জমে যাচ্ছে। এতে পরিকল্পনামাফিক উত্তোলন বাধাগ্রস্ত হতে পারে। এখন বাইরে বিক্রি ছাড়া উপায় নেই। মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পেলে সাধারণ ক্রেতাদের কাছেও বিক্রি করা যাবে।
কয়লা উত্তোলনের অবস্থা
আরও পড়ুন:
রাজধানীতে কিশোরীসহ ২ জনের মরদেহ উদ্ধার
খনি সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরের ৯ আগস্ট থেকে ১৪০৬ নম্বর ফেস থেকে কয়লা উত্তোলন শুরু হয়। এখান থেকে ইতোমধ্যে প্রায় তিন লাখ মেট্রিক টন কয়লা উত্তোলন করা হয়েছে। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত আরও এক লাখ মেট্রিক টন উত্তোলনের লক্ষ্য রয়েছে। এরপর ১৩০৯ নম্বর ফেসে আগামী ফেব্রুয়ারিতে উত্তোলন শুরু হবে। চীনা ঠিকাদারদের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী উত্তোলন অব্যাহত রাখতে হবে। কিন্তু উত্তোলিত কয়লা কোথায় ব্যবহার হবেÑ এ নিয়েই এখন বিপাকে খনি কর্তৃপক্ষ। কারণ পিডিবি ইতোমধ্যে খনিকে জানিয়েছে, আগামী তিন মাস বড়পুকুরিয়া বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ থাকবে।
বিদ্যুৎকেন্দ্রের অচলাবস্থা
বিদ্যমান কেন্দ্রটিতে তিনটি উৎপাদন ইউনিট থাকলেও দুটি ইউনিট বহুদিন ধরে বন্ধ। ১২৫ মেগাওয়াট ক্ষমতার ১নং ইউনিটও বিদ্যুৎ উৎপাদন করলেও অনিয়মিত। মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণজনিত কারণে প্রায়ই বন্ধ থাকে। ১২৫ মেগাওয়াট ক্ষমতার ২নং ইউনিট দীর্ঘদিন যাবৎ বন্ধ রয়েছে। ২৭৫ মেগাওয়াট ক্ষমতার ৩ নম্বর ইউনিটটির মেজর ওভারহলিং কাজের জন্য আগামী বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত বন্ধ থাকবে।
খনি সূত্রে জানা যায়, ১ নম্বর ইউনিটটি চালু হলেও প্রতিদিন ৬৫০ থেকে ৭০০ মেট্রিক টন অর্থাৎ মাসে গড়ে ২০ হাজার মেট্রিক টনের বেশি কয়লা ব্যবহৃত হবে না। আগামী বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত গড়ে প্রতি মাসে ২০ হাজার মেট্রিক টন এবং ফেব্রুয়ারি হতে ৭৬ হাজার মেট্রিক টন কয়লা ব্যবহার হতে পারে যদি ৩ নম্বর ইউনিট চালু করা যায়। কয়লাখনি কর্তৃপক্ষ বলছে যদিও চলতি মাসের ১২ তারিখ থেকে পিডিবি কোনো কয়লা গ্রহণ করেনি।
ইয়ার্ডে কয়লা জমে বিপজ্জনক অবস্থা
আরও পড়ুন:
নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে এলডিপি?
খনি থেকে উত্তোলিত কয়লা সংরক্ষণ ও বিক্রয়ের জন্য বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানির (বিসিএমসিএল) ৩টি কোল ইয়ার্ডে জমা রাখা হয়। যার মোট আয়তন প্রায় ১৫ একর। সেখানে নিরাপদ মজুদ ক্ষমতা ২ দশমিক ২২ লাখ মেট্রিক টন। কিন্তু বর্তমানে ৩টি ইয়ার্ডে মজুদ উচ্চতা গড়ে ২০ মিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি করে প্রায় ৪ দশমিক ৪০ লাখ মেট্রিক টন মজুদ করে রাখা আছে, যা নিরাপদ মজুদ ক্ষমতার প্রায় দ্বিগুণ।
পিডিবির নিজস্ব ইয়ার্ডেও ৪৪ হাজার মেট্রিক টন ধারণক্ষমতার স্থানে মজুদ রয়েছে প্রায় ৯০ হাজার মেট্রিক টন। ফলে খনির কোল ইয়ার্ডে মজুদ উচ্চতা স্বাভাবিক সীমার তিন গুণ পর্যন্ত বাড়াতে হয়েছে, যা ইতোমধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থা তৈরি করেছে। খনি কর্তৃপক্ষ বলছে ১৪০৬ ফেস হতে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত আরও প্রায় এক লাখ মেট্রিক টন কয়লা উত্তোলন হলে সংরক্ষণ করার প্রয়োজন হবে। যা ঝুঁকির পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে।
কোল ইয়ার্ডে অতিরিক্ত মজুদে সম্ভাব্য ঝুঁকি
খনি কর্তৃপক্ষ বলছে, কোল ইয়ার্ডে অতিরিক্ত মজুদের ফলে স্বতঃস্ফূর্ত প্রজ্বলন (আগুন জ¦লে) হয়। পিডিবি কর্তৃক কয়লা যথাযথভাবে গ্রহণ না করায় ২০২৩ সাল হতে বিসিএমসিএল-এর ইয়ার্ডে কয়লা মজুদের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। খনি হতে কয়লা উত্তোলন অব্যাহত রাখা এবং পিডিবি কর্তৃক কয়লা গ্রহণ না করায় কোল ইয়ার্ডর স্থান স্বল্পতার কারণে স্বাভাবিক মজুদ উচ্চতার ৩ গুণ (প্রায় ২০ মিটার) উচ্চতায় কয়লা মজুদ রাখা হচ্ছে। যা কয়লার স্বতঃস্ফূর্ত প্রজ্বালন ঝুঁকি অনেকাংশে বৃদ্ধি করেছে। কর্তৃপক্ষ বলছে, গত শুষ্ক মৌসুমে কয়লার স্তূপের বিভিন্ন অংশে স্বতঃস্ফূর্ত প্রজ্বালন (আগুন) দেখা গেছে।
এছাড়া কোল স্লাইডিং : অতিরিক্ত উচ্চতায় কয়লা মজুদ রাখার কারণে কয়লার স্বতঃস্ফূর্ত প্রজ্বালন ঝুঁকি হ্রাসের লক্ষ্যে প্রতিনিয়ত পানি স্প্রে করা হচ্ছে। কিন্তু অধিক উচ্চতায় স্তূপের ঢাল বেড়ে যাওয়ায় এবং ডাস্ট ধুয়ে যাওয়ার ফলে কোল স্লাইডিং হওয়ার ঝুঁকি বৃদ্ধি পেয়েছে। কয়লার স্তূপ হতে কোল ইয়ার্ডের প্রাচীর নিকটবর্তী (প্রায় ১০ ফুট) হওয়ায় কোল স্লাইডিং হলে প্রাচীর ভেঙে যাবে ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা বিঘ্নিত হবে।
এছাড়া কোল স্লাইডিংকালীন প্রাণহানিসহ অন্যান্য সম্পদ ধ্বংস হতে পারে। খনির কর্মকর্তারা বলছে, ২০২৪ সালে স্বল্প মাত্রার কোল স্লাইডিং হয়েছিল। এ ছাড়া অতিরিক্ত মজুদের ফলে কোল ইয়ার্ডে অব্যস্থাপনা দেখা যায়। এ ছাড়া কয়লার স্তূপের উচ্চতা বৃদ্ধি হওয়ার ফলে ভারী যান-বাহন চলাচলে যে কোনো ধরনের দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা বেড়ে যায়।