সমতা ও সমঝোতার নতুন সুর বেলেমে
ব্রাজিলের বেলেমে জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলন কপ-৩০ এর ১১তম দিনটিতে খুঁজে পাওয়া গেল এক ভিন্ন আবহ যেখানে বিজ্ঞান, মানবাধিকার, সাম্য, নারী নেতৃত্ব, স্থানীয় জ্ঞান আর জলবায়ু ন্যায়বিচারের সুর মিলেমিশে তৈরি করল বহুবর্ণের বৈশ্বিক প্রতিশ্রুতির ছবি। এদিন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল মানুষের জীবন, সমাজ ও প্রকৃতিকে একযোগে সুরক্ষার আহ্বান, যেখানে কৃষি থেকে খাদ্যব্যবস্থা, নারী থেকে আদিবাসী, কৃষক থেকে তরুণ-প্রত্যেকেই সমান গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। সম্মেলনস্থলে গতকালের আলোচনায় গড়ে উঠল এই বার্তাÑ জলবায়ু সংকট কেবল পরিবেশের সমস্যা নয়; এটি বৈষম্য, অধিকার, উন্নয়ন ও অস্তিত্বের প্রশ্ন।
ব্রাজিলে গতকাল পালিত হয় ‘ন্যাশনাল ডে অব ব্ল্যাক কনশাসনেস’; আফ্রিকান বংশোদ্ভূত জনগোষ্ঠীর সংগ্রাম, অধিকার ও অবদানের প্রতি গভীর সম্মান জানানোর এক ঐতিহাসিক দিন। এই বিশেষ দিনে কপ-৩০ এর আলোচনা হয়ে উঠল আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক, আরও ন্যায়ভিত্তিক। রাজনৈতিক বক্তৃতা নয়, মানবিক গল্প, সামাজিক বাস্তবতা ও ঐতিহাসিক বৈষম্যের পরিণতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে জলবায়ু সমাধানের কাঠামো এদিন পেল নতুন মাত্রা। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত যখন সবচেয়ে গভীরভাবে আঘাত করছে কৃষি, খাদ্য নিরাপত্তা, নারী, শিশু, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী ও ফ্রন্টলাইন সমাজকে, তখন কপ-৩০ এর গতকালের দিনটি দেখাল একটাই পথÑ সমতা ছাড়া জলবায়ু সমাধান সম্ভব নয়। বন থেকে সমুদ্র, শহর থেকে গ্রাম, উন্নত থেকে উন্নয়নশীল, সবার কণ্ঠ গতকাল এক বিন্দুতে গিয়ে মেলে; অঙ্গীকারের যুগ শেষ, এখন বাস্তব ফল দেখানোর সময়।
এমন বাস্তবতার মাঝেই জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস দিনটির সবচেয়ে শক্তিশালী বার্তা দিলেন আবেগ, সতর্কতা ও দৃঢ়তার সংমিশ্রণে। তাঁর কণ্ঠে প্রতিধ্বনিত হলো হতাশার সঙ্গে আশার মিশেলÑ এ সংকট আমাদের কারও জন্য অপেক্ষা করবে না। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা, খরা, বন্যা, ঝড়ে প্রতিদিন মানুষ ঘরবাড়ি হারাচ্ছে, জীবন হারাচ্ছে। তারা বিশ্বনেতাদের প্রশ্ন করছে: আর কত অপেক্ষা? গুতেরেসের দৃঢ় উচ্চারণে ফুটে উঠল মানবতার মৌলিক দাবিÑ এখনই সমঝোতা, এখনই সাহস, এখনই সিদ্ধান্ত।
সম্মেলনের ১১তম দিন তাই শুধু প্রস্তাব বা আলোচনা নয়, বরং একটি বৈশ্বিক সূচনালগ্ন, যেখানে অগ্রগতির ধারা মিলছে ন্যায়, সমতা ও বাস্তবমুখী অভিযোজনের শক্ত ভিতের সঙ্গে।
কপ-৩০ এর ১১তম দিনটি শুরু হয় আফ্রিকান বংশোদ্ভূত নারী ও কিশোরীদের জলবায়ু নেতৃত্বকে স্বীকৃতি জানানোর মধ্য দিয়ে। বক্তারা বলেন, জলবায়ু সংকটের অভিঘাত সবচেয়ে তীব্রভাবে আঘাত করে সেই জনগোষ্ঠীর ওপর, যারা ঐতিহাসিক বৈষম্যের কারণে বহুস্তরীয় ঝুঁকির মধ্যে থাকে। আফ্রিকান বংশোভূত নারীরা কৃষি, পানি, জীবিকা ও স্বাস্থ্যঝুঁকিতে সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত হলেও জলবায়ু ন্যায়বিচারের আন্দোলনে তাঁদের অবদান সর্বাধিক। জাতিসংঘ ঘোষিত আফ্রিকান বংশোদ্ভূত মানুষের দ্বিতীয় দশক (২০২৫-২০৩৪) সামনে রেখে তাঁদের নেতৃত্ব আরও শক্তিশালী করার আহ্বানও উঠে আসে এদিন।
আরও পড়ুন:
রাজধানীতে কিশোরীসহ ২ জনের মরদেহ উদ্ধার
পরবর্তী সেশনে কপ-৩০ এর বিশেষ দূতেরা জলবায়ু সংকট, জাতিগত বৈষম্য ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের আন্তঃসম্পর্ক বিশ্লেষণ করেন। বক্তারা বলেন, জলবায়ু সংকট কেবল পরিবেশগত বিপর্যয় নয়, এটি মানবাধিকারের গভীর সংকটও, যা সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে বর্ণবাদ, দারিদ্র্য ও প্রান্তিকতায় ভোগা জনগোষ্ঠীর ওপর। ডারবান কনফারেন্সের সুপারিশসমূহকে কপ-৩০ অ্যাকশন অ্যাজেন্ডা ও এসডিজির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে বৈশ্বিক নীতি-পরিবর্তনের প্রস্তাবও ওঠে এদিন। একই সঙ্গে স্থানীয় ও
আদিবাসী জ্ঞানের সুরক্ষা, সমতাভিত্তিক দুর্যোগ মোকাবিলা সক্ষমতা এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর উদ্যোগসমূহ মূলধারায় যুক্ত করার প্রয়োজনীয়তাও তুলে ধরা হয়।
দিনের মধ্যভাগে গ্লোবাল মুতিরাঁও প্ল্যাটফর্মে তরুণ, বিজ্ঞানী, সিভিল সোসাইটি প্রতিনিধি ও আদিবাসী নেতারা দেখান, কীভাবে কমিউনিটি-নেতৃত্বাধীন উদ্যোগ ভূমি পুনরুদ্ধার, জলবায়ু অভিযোজন ও পরিবেশ সংরক্ষণে বাস্তব পরিবর্তন আনছে। ব্রাজিল, আফ্রিকা, প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলÑ সবখানেই এসব উদ্যোগ মানুষকে জলবায়ু সহনশীলতার নতুন পথ দেখাচ্ছে। বক্তারা বলেন, কপ-৩০ এর প্রকৃত উত্তরাধিকার হবে এসব উদ্যোগ যা মাঠপর্যায়ে জীবন বদলে দিচ্ছে।
দিনের শেষদিকে অনুষ্ঠিত আলোচনাগুলো ছিল আদিবাসী ও স্থানীয় সম্প্রদায়ের ভূমিকা নিয়ে। বক্তারা উল্লেখ করেন, ঐতিহ্যগত জ্ঞান, ভাষা, সংস্কৃতি ও ভূমির সঙ্গে মানুষের সম্পর্কই জলবায়ু-সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় সর্বাধিক কার্যকর। এসব সম্প্রদায়ের ওপর চাপ বাড়লেও তাদের অবদান এখনও কাক্সিক্ষতভাবে মূল্যায়ন করা হয়নি। তাই ন্যায়, সমতা ও অধিকারভিত্তিক জলবায়ু সমাধানের লক্ষ্যে একটি বৈশ্বিক জোট গঠনের ঘোষণা দেওয়া হয় যা বিভিন্ন অঞ্চলের সংগ্রামকে একসূত্রে গেঁথে তুলবে।
আরও পড়ুন:
নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে এলডিপি?
দিনের আলোচনায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বার্তাটি উঠে এসেছে তা হলোÑ প্রযুক্তি, নীতি বা বিনিয়োগের পাশাপাশি অন্তর্ভুক্তি, সমতা, স্থানীয় জ্ঞান ও নারী-নেতৃত্বাধীন বাস্তবসম্মত সমাধান ছাড়া জলবায়ু সহনশীল ভবিষ্যৎ সম্ভব নয়। কৃষি, খাদ্য নিরাপত্তা, নারী অধিকার, জাতিগত ন্যায়বিচারÑ প্রতিটি ক্ষেত্রে অগ্রগতি দেখা গেলেও তা আরও বিস্তৃত করা জরুরি।
জাতিসংঘ মহাসচিব তাঁর শক্তিশালী বক্তব্যে বিশ্বনেতাদের উদ্দেশে বলেন, কেউই এই আলোচনাস্থল থেকে সবকিছু নিয়ে যেতে পারবেন না। কিন্তু প্রত্যেকের দায়িত্ব একটি ন্যায়ভিত্তিক, ভারসাম্যপূর্ণ চুক্তিতে পৌঁছানো। তিনি আলোচকদের উদ্দেশে দৃঢ়কণ্ঠে বলেন, সৎ ইচ্ছা নিয়ে আলোচনায় বসুন। প্রতিটি মানুষ এখন দৃশ্যমান ফল চায়।
কপ-৩০ এর ১১তম দিনের আলোচনায় তাই একদিকে ছিল সমাজভিত্তিক বাস্তব অগ্রগতির চিত্র, অন্যদিকে ছিল বৈশ্বিক রাজনৈতিক সাহসের আহ্বান। বিশ্ব আজ গভীর সংকটে; তবু সমঝোতা, সহযোগিতা ও যৌথ দায়িত্ববোধের আলো থেকেই বেরিয়ে আসে টেকসই ভবিষ্যতের পথ।