বিএনপির মনোনয়ন বঞ্চিতদের ঐক্য
বিভাগীয় শহর বরিশাল সদর আসনে ষষ্ঠ বারের মতো বিএনপির মনোনয়ন পেয়েছেন দলের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মজিবর রহমান সরোয়ার। কিন্তু এখন পর্যন্ত তাঁর পক্ষে প্রকাশ্যে মাঠে নামেননি দলটির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য আবু নাসের মোহাম্মদ রহমাতুল্লাহ, এবায়েদুল হক চান ও নগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক আফরোজা খানম নাসরিন। মনোনয়নবঞ্চিত এসব নেতা এখনও দলীয় প্রার্থী হওয়ার বিষয়ে আশাবাদী। তবে শেষ পর্যন্ত না হলে দলীয় প্রার্থীর পক্ষে থাকবেন বলে আশ্বস্ত করেছেন তাঁরা।
মনোনয়ন বঞ্চিত এবায়েদুল হক চান বলেন, এখনও চূড়ান্ত তালিকা আসেনি। সুতরাং, মনোনয়ন পাওয়ার ব্যাপারে এখনও আশাবাদী। তবে শেষ পর্যন্ত যদি সরোয়ারকেই প্রার্থী করা হয়, তাহলে সবার আগে থাকব। একই কথা বলেছেন অপর মনোনয়ন প্রত্যাশী আবু নাসের মোহাম্মদ রহমাতুল্লাহ। তবে বিএনপির নেতাকর্মী ও সমর্থকরা মনোনয়নবঞ্চিতদের অবস্থানকে খুব ভালো দেখছেন না। তাঁরা বলছেন- দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে যাওয়া মানেই ধানের শীষের ক্ষতি করা। বিএনপির দুর্গে এভাবে অনৈক্য থাকলে এই সুযোগ নেবে জামায়াত এবং ইসলামী আন্দোলন। এমন অবস্থা শুধু বরিশাল সদর আসনে নয়। বিভাগের ২১ আসনের বেশিরভাগ এলাকায়ই প্রার্থী ঘোষণার পর থেকেই বিভেদ শুরু হয়েছে। গত ৩ নভেম্বর বিএনপি মহাসচিব মীর্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ২৩৭ আসনে প্রার্থী ঘোষণার পর শুরু হয়েছে নিজেদের মধ্যে কোন্দল। অনেক এলাকায় হয়েছে দফায় দফায় সংঘর্ষ।
বরিশালের ২১ আসনে সংঘাত না হলেও থেমে নেই মনোনয়নপ্রাপ্ত ও বঞ্চিতদের বাগযুদ্ধ। অনেক আসনে মনোনয়ন বঞ্চিতরা গড়ে তুলছেন নিজেদের মধ্যে ঐক্য। তাঁদের সমর্থক নেতাকর্মীরা সামাজিক মাধ্যমে পক্ষে-বিপক্ষে পোস্ট দেওয়ার পাশাপাশি প্রার্থিতা বাতিল চেয়ে বিক্ষোভ এবং সংবাদ সম্মেলন করেছেন। গণমাধ্যমে দিচ্ছেন বিভিন্ন ধরনের বিবৃতি। বিভাগের অধিকাংশ আসনের একাধক মনোনয়ন বঞ্চিতরা ঐক্য গড়ে তোলায় মনোনয়নপ্রাপ্ত প্রার্থী নির্বাচনী মাঠ নিজেদের কব্জায় নিতে হিমশিম খাচ্ছেন। পাশাপাশি প্রতিপক্ষ জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থীরা জোরেশোরে মাঠ দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন।
হিজলা-মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলা নিয়ে গঠিত বরিশাল-৪ আসনে মনোনয়ন পেয়েছেন স্বেচ্ছাসেবক দল কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক রাজীব আহসান। এ আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন সাবেক এমপি ও বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য মেজবাউদ্দীন ফরহাদ। কিন্তু তাঁকে বঞ্চিত করা হয়েছে। অথচ ফরহাদ বিএনপির দুর্দিনের কাণ্ডারি। ২০০৮ সালে সেনা সমর্থিত সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে প্রথমবার মনোনয়ন পেয়ে তিনি এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। ওই নির্বাচনে বিএনপি মাত্র ২৯টি আসনে জয়ী হয়েছিল। এর মধ্যে বরিশালের ২১ আসনের মধ্যে দুটিতে জিতেছিল বিএনপি। এর একটি বরিশাল-৪। সবার ধারণা ছিল তিনি যেহেতু ভরাডুবির সময় জয়ী হয়েছেন; সেক্ষেত্রে এবার সবার আগে অগ্রাধিকার পাবেন তিনি। দলীয় টিকিট না পাওয়ায় মেজবাউদ্দিন ফরহাদের পাশাপাশি তাঁর সমর্থকরাও হতাশ। প্রার্থী ঘোষণার পর তিনি গণমাধ্যমকে বলেনÑ চূড়ান্ত তালিকা আসার পর তিনি র্নির্বাচনের মাঠে নামবেন। এ ক্ষেত্রে যদি শেষ পর্যন্ত রাজীব আহসানকে রাখা হয়, তাহলে তাঁর পক্ষেই তিনি কাজ করবেন, এর আগে না।
গৌরনদী-আগৈলঝাড়া নিয়ে গঠিত বরিশাল-১ আসনেও বিভেদ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এ আসনে মনোনয়ন পেয়েছেন সাবেক এমপি জহিরউদ্দীন স্বপন। কিন্তু তাঁকে মানেন না অপর মনোনয়ন প্রত্যাশী বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক (বরিশাল বিভাগ) আকন কুদ্দুসুর রহমান ও জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ইঞ্জিনিয়ার আব্দুস সোবাহান। প্রার্থী ঘোষণার পর জহিরউদ্দীন স্বপন অপর মনোনয়ন প্রত্যাশীদের সঙ্গে যোগাযোগ করেননি, যেমনটা নির্দেশনা দিয়েছিলেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
এ প্রসঙ্গে আকন কুদ্দুসুর রহমান বলেন, তারেক রহমান যে নির্দেশনা দিয়েছেন, সেই নির্দেশনা আমার কাছে মুখ্য বিষয়। ধানের শীষকে বিজয়ী করতে, যা যা করা দরকার সবই আমি করব। এদিকে গত সোমবার আগৈলঝাড়ায় সংবাদ সম্মেলন করে জহিরউদ্দীন স্বপনকে বাদ দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন ইঞ্জিনিয়ার সোবাহানপন্থি নেতাকর্মীরা। এ সময় তাঁরা স্বপনকে সংস্কারপন্থি আখ্যা দিয়ে তাঁর প্রার্থিতা বাতিলের দাবি জানান।
সদর ও নলছিটি উপজেলা নিয়ে গঠিত ঝালকাঠি-২ আসনে মনোনয়ন পেয়েছেন সাবেক এমপি ইসরাত সুলতানা ইলেন ভুট্টো। কিন্তু তাঁকে মানেন না অপর তিন মনোনয়নপ্রত্যাশী। তাঁরা হলেনÑ বিএনপির কেন্দ্রীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক (বরিশাল বিভাগ) মাহবুবুল হক নান্নু, বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য জিবা আমিনা আল গাজী এবং জেলা বিএনপির সদস্যসচিব শাহাদাৎ হোসেন। মনোনয়ন প্রশ্নে বঞ্চিত তিন প্রার্থী একাট্টা হয়েছেন। তাঁরা নিজেদের মতো করে প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছেন সংসদীয় এলাকায়। তাঁদের দাবি, যাঁকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে তিনি ২০০৮ সালের পর এলাকায় ভেড়েননি। খোঁজ নেননি নেতাকর্মীদের।
মাহবুবুল হক নান্নু বলেন, তৃণমূলের নেতাকর্মীরা ইলেন ভুট্টোকে মানতে পারছেন না। কারণ, তিনি দলের সঙ্গে বেইমানি করেছেন। ২০০১ সালে বিএনপির মনোনয়নে তিনি এমপি হয়েছিলেন। ওয়ান-ইলেভেনের সময় সংস্কারপন্থিদের কাতারে যাওয়ার পরও ২০০৮ সালের নির্বাচনে তাঁকে মনোনয়ন দেওয়া হয়। গত ১৭ বছরে দলীয় কোনো কর্মকাণ্ডে তাঁর অংশগ্রহণ ছিল না। এ জন্য তাঁর প্রতি নেতাকর্মীদের ক্ষোভ।
চরফ্যাশন-মনপুরা নিয়ে গঠিত ভোলা-৪ আসনেও প্রার্থী নিয়ে দুই ধারায় বিভক্ত স্থানীয় বিএনপি। এ আসনে সাবেক তিনবারের এমপি নাজিমউদ্দীন আলমকে বাদ দিয়ে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে কেন্দ্রীয় যুবদলের সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম নয়নকে। মনোনয়ন পাওয়ার পর আলমের বাসায় গেলেও দেখা পাননি নয়ন।
মনোনয়নবঞ্চিত নাজিম উদ্দীন আলম বলেন, চূড়ান্ত তালিকা ঘোষণার পর তিনি দলীয় প্রার্থীর পক্ষে মাঠে নামবেন।
একই অবস্থা বরিশাল বিভাগের অধিকাংশ আসনে। এলাকায় গ্রহণযোগ্যতা এবং মাঠ পর্যায়ে যাচাই-বাছাই পূর্বক পুনঃমনোনয়ন চূড়ান্তের দাবি জানিয়েছেন তৃনমূলের নেতাকর্মীরা।
নাম প্রকাশে অনেচ্ছুক বরিশালের প্রভাবশালী এক বিএনপি নেতা বলেন, আগামী নির্বাচন বড় চ্যালেঞ্জিং। বিএনপির বিরুদ্ধে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র চলছে। দলকে নির্বাচনে বিজয়ী করতে অনেক আসনে প্রার্থী পরিবর্তন করা জরুরি। তা নাহলে প্রতিপক্ষরা ফলাফল তাদের ঘরে তুলে নেবে।
এ বিষয়ে বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক আকন কুদ্দুসুর রহমান বলেন, তফসিল ঘোষণার আগে বিভেদ ভুলে ধানের শীষের পক্ষে সবাই ঐক্যবদ্ধ হবেন এবং বিভাগের ২১ আসনেই বিএনপি জয়লাভ করবে।