সমুদ্র থেকে অরণ্য রক্ষায় নতুন প্রতিশ্রুতি

আরিফুজ্জামান মামুন, বেলেম (ব্রাজিল) থেকে
১৯ নভেম্বর ২০২৫, ০৯:৪৬
শেয়ার :
সমুদ্র থেকে অরণ্য রক্ষায় নতুন প্রতিশ্রুতি

ব্রাজিলের বেলেম শহর বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদের ব্যস্ত দৌড়ঝাঁপ; এসবের মধ্যেই কপ-৩০ এর গতকালের দিনটি এক অনন্য আবহ সৃষ্টি করে। সকালের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গেই ভেন্যুর করিডোরগুলো সরব হয়ে ওঠে সমুদ্র, বন, জীববৈচিত্র্য আর মানবজীবন রক্ষার দাবি নিয়ে। পৃথিবীর প্রাণভোমরা সমুদ্রের নীল গভীরতা আর বনের সবুজ বিস্তার কীভাবে রক্ষা করা যায়, কত দ্রুত করা যায় এবং কোন দেশ কোন দায়িত্ব নেবে- এসব নিয়ে গতকাল আলোচনা ছিল তীব্র। বিশেষ করে সমুদ্রভিত্তিক জলবায়ু সমাধান থেকে শুরু করে রিও কনভেনশনগুলোর সম্মিলিত অ্যাকশন সবখানেই ছিল জরুরি আহ্বানÑ প্রকৃতিকে বাঁচানো মানেই মানুষকে বাঁচানো, আগামী প্রজন্মকে বাঁচানো।

গতকাল আলোচনার কেন্দ্রে ওঠে এসেছে উন্নয়নশীল দেশগুলো, বিশেষত ঝুঁকিপূর্ণ উপকূলীয় অঞ্চলসমৃদ্ধ দেশগুলোর দুর্দশা ও অভিযোজনের প্রয়োজনীয়তা। বাংলাদেশের নামও এসেছে একাধিকবার; ঘূর্ণিঝড়, লবণাক্ততা, নদীভাঙন, জীববৈচিত্র্য হ্রাস আর উপকূলীয় বাস্তুতন্ত্রের হুমকির উদাহরণ হিসেবে। আলোচকরা বলেন, বাংলাদেশের মতো দেশগুলোকে টিকিয়ে রাখতে চাইলে শুধু প্রতিশ্রুতি নয়, এখনই প্রয়োজন দ্রুত আর্থিক সহায়তা, প্রকৃতিভিত্তিক সমাধানের সরাসরি বাস্তবায়ন এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার নতুন কাঠামো।

আলোচনায় আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভূমিকা ছিল প্রাধান্যপূর্ণ। বনের রক্ষক, নদীর ধারক, সংস্কৃতির বাহক এই জনগোষ্ঠীগুলোর অভিজ্ঞতাই পৃথিবীর টিকে থাকার মূলমন্ত্রÑ এই সত্যকে নতুনভাবে স্বীকৃতি দিয়েছে কপ-৩০।

ব্রাজিলের আদিবাসী নেতা ও দেশটির আদিবাসীবিষয়ক মন্ত্রী সোনিয়া গুজাজারার বক্তব্য যেন পুরো সম্মেলনের ওপর ছায়া ফেলে দেয়Ñ বন শুধু বৃক্ষ নয়, এটি স্মৃতি, জীবন, ইতিহাস এবং ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি। মঙ্গলবার দিনটি স্পষ্ট করে দিয়েছেÑ জলবায়ু লড়াই মানব সভ্যতার অস্তিত্ব রক্ষার এক চূড়ান্ত সংগ্রাম। সমুদ্র, বন, জীববৈচিত্র্য আর মানুষÑ এই চারটি টিকলে পৃথিবী টিকে থাকবে।

বেলেমে চলমান জলবায়ু সম্মেলনের নবম দিনে বিশ্ব সম্প্রদায় প্রকৃতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাস্তুতন্ত্র সমুদ্র, উপকূল, বন এবং জীববৈচিত্র্য রক্ষার বিষয়ে অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির দিকে এগিয়েছে। প্রকৃতি সুরক্ষায় বহুপাক্ষিক সহযোগিতা, সমুদ্রভিত্তিক জলবায়ু সমাধান, বন রক্ষায় আদিবাসী নেতৃত্ব এবং দেশগুলোর অভিযোজন সক্ষমতা বৃদ্ধির ওপর জোর দেওয়া হয়েছে বিশেষভাবে।

দিনটি শুরু হয় ‘ডেলিভারিং ওশান কমিটমেন্টস’ শীর্ষক উচ্চপর্যায়ের সভা দিয়ে, যেখানে উপকূল ও সমুদ্র ব্যবস্থার গুরুত্ব বিশেষভাবে আলোচনায় আসে। অগ্রগতি তুলে ধরে বক্তারা বলেন, সমুদ্রভিত্তিক জলবায়ু সমাধান জাতীয় জলবায়ু পরিকল্পনার মূল স্তম্ভে পরিণত হচ্ছে। প্রথম গ্লোবাল স্টকটেকের আলোকে দেশগুলো কীভাবে সমুদ্রের স্বাস্থ্য রক্ষাকে জলবায়ু অভিযোজনের অংশ করে তুলছে, তা এখানে তুলে ধরা হয়। বিশেষ করে উপকূলীয় দেশগুলোর ক্ষতির ঝুঁকি এবং পুনরুদ্ধার পরিকল্পনায় সমুদ্রভিত্তিক সমাধানের কার্যকারিতা নিয়ে আলোচনা হয়। এই আলোচনাতেই কয়েকজন বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলকে সমুদ্রের ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা, জলোচ্ছ্বাস এবং লবণাক্ততার কারণে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোর মধ্যে একটি হিসেবে উল্লেখ করেন। তাঁরা বলেন, বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর অভিজ্ঞতা বৈশ্বিক অভিযোজন পরিকল্পনা প্রণয়নে সত্যিকারের শিক্ষা দেয়।

একই সময়ে অনুষ্ঠিত ‘কপ-১৬ থেকে কপ-৩০ পর্যন্ত অ্যাকশন এজেন্ডা সমন্বয়’ শীর্ষক রাউন্ডটেবিলে রিও কনভেনশনের সমন্বয় জোরদারের অঙ্গীকার করা হয়। বিশেষজ্ঞরা বলেন, আমরা এতদিন প্রকৃতি রক্ষার তিনটি আলাদা আলাদা লড়াই করেছি; কিন্তু এখন সময় এসেছে এগুলো একীভূত করার। ভূমি পুনর্গঠন, বন সংরক্ষণ, জীববৈচিত্র্য রক্ষা এবং জলবায়ুর প্রভাব কমানোÑ এসবকে এক সূত্রে না গাঁথলে টেকসই ভবিষ্যৎ সম্ভব নয়। উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশে উপকূলীয় চরাঞ্চল, সুন্দরবন এবং পাহাড়ি অঞ্চলে আন্তঃসংযুক্ত বিপর্যয় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবকে আরও বাড়িয়ে তোলে; রিও কনভেনশনের সমন্বিত বাস্তবায়নের প্রয়োজনীয়তা বোঝায় তা।

‘সেন্টারিং এসএমইজ ইন ক্লাইমেট অ্যাকশন’ সেশনটিতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানগুলো জলবায়ু অভিযোজন ও উদ্ভাবনে কীভাবে বড় ভূমিকা রাখতে পারে, তা নিয়ে আলোচনা হয়। গ্লোবাল সাউথের উদাহরণ তুলে ধরে আলোচকরা বলেন, এসএমই সেক্টরকে অর্থায়ন, নীতিগত সহায়তা এবং সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে শক্তিশালী করা গেলে স্থানীয় পর্যায়ে দুর্যোগ মোকাবিলায় নতুন সমাধান তৈরি হবে। এ ধরনের প্রতিষ্ঠানই বৃহৎ জনগোষ্ঠীর জীবিকা নিশ্চিত করে এবং তাদের অভিযোজন সক্ষমতা বাড়ানো মানে পুরো দেশের স্থিতিস্থাপকতা বৃদ্ধি।

বিকালে অনুষ্ঠিত হয় গুরুত্বপূর্ণ ‘ন্যাপ ইমপ্লিমেন্টেশন অ্যালায়েন্স’র উদ্বোধন। কপ-৩০ এর অ্যাকশন এজেন্ডার অংশ হিসেবে গঠিত এই প্ল্যাটফর্মটি হবে জলবায়ু অভিযোজন বাস্তবায়নে বহুপাক্ষিক সহযোগিতার নতুন কেন্দ্র। আলোচকরা বলেন, অনেক দেশ জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা তৈরি করেছে ঠিকই, কিন্তু বাস্তবায়নের জন্য যে অর্থায়ন, প্রযুক্তি, সক্ষমতা ও অংশীদারিত্ব দরকার, তা এখনও সীমিত। এই নতুন অ্যালায়েন্স দেশগুলোকে তাদের অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় সহায়তা দেবে এবং প্রকৃতভিত্তিক সমাধান, পানি ব্যবস্থাপনা, স্বাস্থ্যঝুঁকি মোকাবিলা ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সহযোগিতা জোরদার করবে। এখানেও বাংলাদেশের উদাহরণ ওঠে আসে, বিশেষ করে উপকূলীয় বাঁধ সংস্কার, ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ এবং জলবায়ু সহনশীল কৃষিপদ্ধতিকে ‘উন্নয়নশীল দেশে অভিযোজনের সফল উদাহরণ’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়।

‘গ্লোবাল এথিক্যাল স্টকটেক’ শীর্ষক আলোচনায় জলবায়ু ন্যায্যতা, সমান দায়িত্ব ও নৈতিকতার আলোকে বৈশ্বিক জলবায়ু নীতিকে পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানানো হয়। এখানে ২০২৫ সালের কর্মপরিকল্পনা উপস্থাপন করা হয় এবং ছয়টি আঞ্চলিক সংলাপের ঘোষণা দেওয়া হয়। অনুষ্ঠানে প্রকাশ করা হয় ‘জিইএস গ্লোবাল রিপোর্ট’ যেখানে বলা হয়Ñ জলবায়ু পরিবর্তন শুধু পরিবেশগত নয়, এটি এখন নৈতিক সংকট; তাই উন্নত দেশগুলোকে দ্রুত নির্গমন কমানো, অর্থায়ন বাড়ানো এবং ক্ষতিগ্রস্ত দেশের পাশে দাঁড়ানো ছাড়া বিকল্প নেই।

দিনের শেষের দিকে কপ-৩০এর অফিসিয়াল পডকাস্ট ইনসাইড কপে একটি গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। ব্রাজিলের আদিবাসীবিষয়ক মন্ত্রী সোনিয়া গুজাজারার সঙ্গে আলাপচারিতায় ওঠে আসে বন রক্ষায় আদিবাসীদের ভূমিকা এবং কপ-৩০কে কেন প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারের এক ঐতিহাসিক কপ বলা হচ্ছে। তিনি বলেন, আমাদের অস্তিত্বের সঙ্গে বন জড়িত; বন হারালে আমরা হারিয়ে যাব। আর আমাদের হারানো মানে পৃথিবীর হারিয়ে যাওয়া। নবম দিনের এই বিস্তৃত আলোচনাগুলো একটাই বার্তা দেয়Ñ পৃথিবীর বাস্তুতন্ত্র রক্ষায় আর দেরি করা যাবে না। সমুদ্র, বন, ভূমি এবং জীববৈচিত্র্য সবই পরস্পর নির্ভরশীল, এসব রক্ষা করা মানেই মানুষের ভবিষ্যৎ রক্ষা করা। কপ-৩০ এর নবম দিন তাই নীতি, বিজ্ঞান, নৈতিকতা, সংস্কৃতি এবং বাস্তবতার এক অভূতপূর্ব সংমিশ্রণে প্রকৃতি রক্ষার বৈশ্বিক অঙ্গীকারকে আরও সুদৃঢ় করেছে।