মানবপাচার ও চোরাচালান রোধে কঠোর সরকার
মানবপাচার ও অভিবাসী চোরাচালান রোধে কঠোর হচ্ছে সরকার। এ জন্য বাড়ানো হচ্ছে শাস্তি। নতুন অধ্যাদেশে তদন্তপর্যায়ে মানবপাচারকারীদের ব্যাংক হিসাব নিষ্ক্রিয়, সম্পদ জব্দ এবং বিদেশ যাত্রায় বাধাদানের সুযোগ রাখা হয়েছে। এ ছাড়া অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে প্রতারণামূলক বিজ্ঞাপন বন্ধ এবং অপরাধমূলক কার্যক্রম চালানো (সাইবার স্ক্যামিং), আপস করতে ভিকটিম বা সাক্ষীকে চাপ প্রয়োগের ক্ষেত্রে আসামির অনুপস্থিতিতে তার বিচার করার বিধান যুক্ত করা হয়েছে। ইতোমধ্যে ‘মানবপাচার ও অভিবাসী চোরাচালান প্রতিরোধ ও দমন অধ্যাদেশ, ২০২৫’-এর খসড়া মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
জানা গেছে, দেশে শাসনব্যবস্থার পটপরিবর্তন এবং বিশ্বব্যাপী অভিবাসনের চাপ সংশ্লিষ্ট চলমান চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও মানবপাচার ও অভিবাসী চোরাচালানের শিকার ব্যক্তিদের সুরক্ষা অধিকার নিশ্চিতে নতুন অধ্যাদেশ জারি করা হচ্ছে। আন্তঃদেশীয় অপরাধ প্রতিরোধ ও দমনে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে এই অধ্যাদেশ জারি করা হতে পারে। এর আগে ২০১২ সালে বাংলাদেশে মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন, ২০১২ প্রণয়ন করা হয়। বিদ্যমান আইনে অনেক ফাঁকফোকর রয়েছে। তাই নতুন অধ্যাদেশে অনেক বিধান যুক্ত করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগরীয় অঞ্চলে পাচারবিরোধী সমন্বয় জোরদারে ভারত, নেপাল, শ্রীলংকা ও থাইল্যান্ডের সঙ্গে কাজ করছে। এর মধ্যেই বিদেশ গমনেচ্ছু বাংলাদেশি নাগরিকরা প্রতিনিয়ত মানবপাচারের শিকার হচ্ছেন। কিন্তু অভিবাসী চোরাচালান প্রতিরোধ ও দমনে প্রটোকল এগেইনস্ট দ্য স্মাগলিং অব মাইগ্রেন্টস বাই ল্যান্ড, সি অ্যান্ড এয়ার (এসওএম প্রটোকল) অনুযায়ী আলাদা কোনো আইন করা হয়নি। তেমনি বিদ্যমান মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে সে সম্পর্কে কোনো বিধান সংযোজন করা হয়নি। আবার অভিবাসী চোরাচালান সম্পর্কেও বিদ্যমান আইনে পর্যাপ্ত বিধান নেই। এ ক্ষেত্রে পৃথক আইন প্রণয়ন এবং ট্রাইব্যুনাল গঠনে লোকবল ও আর্থিক বিষয় জড়িত। যে কারণে পৃথক আইন প্রণয়নের পরিবর্তে অভিবাসী চোরাচালানের সংজ্ঞা এবং এ সম্পর্কিত অপরাধ ও এর শাস্তি এবং মানবপাচার অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনালকে অভিবাসী চোরাচালান অপরাধের বিচারের এখতিয়ার দিয়ে বিধান সন্নিবেশ করা হয়েছে। এতে সরকারের নতুন আর্থিক সংশ্লেষ হবে না।
জানা গেছে, মানবপাচার ও অভিবাসী চোরাচালান প্রতিরোধ ও দমন অধ্যাদেশ, ২০২৫-এর খসড়াটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আয়োজিত আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় উপস্থাপন করা হয়েছিল। এরপর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে গত ১৭ নভেম্বর আরেকটি আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা হয়। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ আইনটি সংশোধনের পরিবর্তে নতুন অধ্যাদেশ প্রণয়নের সুপারিশ করে। ইতোমধ্যে খসড়াটি স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে. জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী অনুমোদন দিয়েছেন। তবে এ বিষয়ে তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
আরও পড়ুন:
রাজধানীতে কিশোরীসহ ২ জনের মরদেহ উদ্ধার
সূত্রমতে, মানবপাচার ও চোরাচালান নিয়ে তৈরি অধ্যাদেশের প্রাধান্য হিসেবে বলা হয়েছেÑ আপাতত বলবৎ অন্য কোনো আইনে যা-ই থাকুন, এ অধ্যাদেশের বিধানাবলি কার্যকর হবে। মানবপাচার ও সংশ্লিষ্ট অপরাধের দণ্ডের বিষয়ে অধ্যাদেশের দ্বিতীয় অধ্যায়ে বলা হয়েছে- মানবপাচারের অপরাধে কোনো ব্যক্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং অন্যূন ৫ বছর সশ্রম কারাদণ্ডে এবং অন্যূন ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন। কোনো সংঘবদ্ধ গোষ্ঠীর একাধিক সদস্য সব সদস্যের সাধারণ অভিপ্রায় সাধনে আর্থিক বা অন্য কোনো বস্তুগত বা অবস্তুগত মুনাফা অর্জনের নিমিত্তে অপরাধ করলে প্রত্যেক সদস্য অভিযুক্ত হবেন এবং অপরাধ সংঘঠনকারী ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ডে বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে বা অন্যূন ৭ বছর সশ্রম কারাদণ্ডে এবং অন্যূন ৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন। মানবপাচার অপরাধ সংঘটনের সুযোগ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে সম্পদ ব্যবহারের অনুমতি অথবা কোনো দলিল দস্তাবেজ গ্রহণ, বাতিল, গোপন, অপসারণ, ধ্বংস বা এর স্বত্ব গ্রহণ করে নিজেকে ওই অপরাধের সঙ্গে জড়িত করলে ওই ব্যক্তি অনধিক ৭ বছর এবং অন্যূন ৩ বছর সশ্রম কারাদণ্ডে এবং অন্যূন ৩০ হাজার টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন। মানবপাচারের অপরাধের অভিপ্রায়ে বা যৌন শোষণসহ অন্য কোনো অপরাধ করলে অনধিক ১০ বছর এবং অন্যূন ৫ বছর এবং অন্যূন ২০ হাজার টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন।
মানবপাচারের উদ্দেশ্যে কোনো ব্যক্তি নবজাতক শিশুকে হাসপাতাল, সেবাসদন, মাতৃসদন, শিশু সদন বা ওই নবজাতকের পিতামাতার হেফাজত থেকে চুরি করলে অনধিক যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং অন্যূন ৫ বছর সশ্রম কারাদণ্ডে এবং অন্যূন ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন। পতিতাবৃত্তি বা অন্য কোনো প্রকারের যৌন শোষণের উদ্দেশ্যে আমদানি বা স্থানান্তরের উদ্দেশ্যে বিদেশ থেকে বাংলাদেশে আনা বা বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পাঠানো বা ক্রয় কিংবা বিক্রয় করলে অনধিক ১০ বছর এবং অন্যূন ৩ বছর সশ্রম কারাদণ্ডে এবং অন্যূন ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন। অধ্যাদেশে আরও বলা হয়েছেÑ কোনো ব্যক্তি পতিতালয় স্থাপন বা পরিচালনা করলে অথবা তা স্থাপন বা পরিচালনা করতে অনুমতি দিলে কিংবা সহায়তা বা অংশগ্রহণ করলে তিনি অপরাধী হিসেবে গণ্য হবেন। এ অপরাধের জন্য অনধিক ৫ বছর এবং অন্যূন ৩ বছর সশ্রম কারাদণ্ডে এবং অন্যূন ২০ হাজার টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন। অর্থাৎ বাড়ির মালিক, ভাড়াটিয়া বা ইজারাদাররাও শাস্তির আওতায় আসবেন।
প্রস্তাবিত অধ্যাদেশে অভিবাসী চোরাচালান নিয়ে উল্লেখ আছে তৃতীয় অধ্যায়ে। কোনো ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে অভিবাসী চোরাচালানে লিপ্ত হলে অনধিক ১০ বছর এবং অন্যূন ৩ বছর এবং অন্যূন ১ লাখ টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন। অভিবাসী চোরাচালানের উদ্দেশ্যে দলিল সংগ্রহ বা সরবরাহ করলে অনধিক ৩ বছর, অন্যূন ১ বছল এবং অন্যূন ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন। সুবিধা লাভের আশায় বিদেশি নাগরিককে আশ্রয় দিলে শাস্তি হবে অনধিক ৩ বছর এবং অন্যূন ১ বছর এবং অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন। চোরাচালানের শিকার অভিবাসী মারাত্মকভাবে জখম হলে বা তার প্রতি নিষ্ঠুর বা অমানবিক আচরণ করলে চোরাচালান চক্রের প্রত্যেক সদস্য অনধিক যাবজ্জীবন এবং অন্যূন ৫ বছর সশ্রম কারাদণ্ডে এবং অন্যূন ১ লাখ টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন। অভিবাসী চোরাচালানের উদ্দেশ্যে ডিজিটাল মাধ্যমে বিজ্ঞাপন প্রচার, ওয়েবসাইট, লাইভ স্ট্রিমিং প্ল্যাটফরম বা অন্য কোনো অনলাইন বা ইলেকট্রনিক মাধ্যম ব্যবহার করে প্ররোচিত করা হলে অনধিক ৭ বছর এবং অন্যূন ৩ বছর সশ্রম কারাদণ্ডে এবং অন্যূন ১ লাখ টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন।
আরও পড়ুন:
নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে এলডিপি?
অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, মানবপাচার বা অভিবাসী চোরাচালান অপরাধ প্রতিরোধে সাব ইান্সপেক্টর পদমর্যাদার কর্মকর্তারা তল্লাশি করতে পারবেন। তল্লাশির ৭২ ঘণ্টার মধ্যে কারণ, ফলাফলের বিবরণসহ প্রতিবেদন তৈরি করার কথা বলা হয়েছে।
ব্যাংক হিসাব নিরীক্ষা ও নিষ্ক্রিয়করণের সংজ্ঞায় বলা হয়েছেÑ তদন্তকারী কর্মকর্তা মানি লন্ডালিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ অনুযায়ী রেকর্ডপত্র পরীক্ষা করা যাবে। ব্যাংক হিসাব নিষ্ক্রিয় কিংবা সম্পদ যাচাই-বাছাইয়ের অনুমতি চেয়ে ট্রাইব্যুনালে আবেদন করতে পারবেন তদন্তকারী কর্মকর্তা। এ ছাড়া গাড়ি, বাড়ি বা স্থাপনা বা জমি আটক করার সুযোগ আছে একই পন্থায়। অর্জিত সম্পত্তি হস্তান্তরেও নিষিদ্ধ করার সুযোগ আছে। মোটকথা মামলা নিষ্পত্তি হওয়ার আগ পর্যন্ত এরকম আবেদন করা যাবে। এ অধ্যাদেশের অধীনে সংঘটিত কোনো অপরাধের বিচারের স্বার্থে বিদেশে অবস্থিত অপরাধলব্ধ অর্জিত সম্পত্তি এবং ওই সম্পত্তির মাধ্যমে পরে অভিযুক্ত ব্যক্তির অর্জিত বা অন্য কোনো সম্পত্তি অবরুদ্ধ এবং ক্রোক করতে সরকারকে নির্দেশ দিতে পারবে ট্রাইব্যুনাল। এ অধ্যাদেশের অধীনে অভিযুক্তের বিদেশ গমনে নিষেধাজ্ঞার সুযোগ রাখা হয়েছে। আসামির অনুপস্থিতিতে বিচারকার্যের ব্যাখ্যাও রয়েছে প্রস্তাবিত অধ্যাদেশে। তা ছাড়া মানবপাচার ও অভিবাসী চোরাচালানের শিকার ব্যক্তি ও এবং সাক্ষীদের সহায়তা ও তাদের সুরক্ষা ও পুনর্বাসনের বিধান রাখা হয়েছে খসড়ায়।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ মানবপাচার রোধে ভুক্তভোগীদের সুরক্ষা, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং আন্তঃসংস্থা সমন্বয়ের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখানো হয়েছে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের ২০২৫ সালের মানবপাচার (টিআইপি) বিষয়ক প্রতিবেদনে। ভুক্তভোগী শনাক্তকরণ এবং সুরক্ষা পরিষেবা বৃদ্ধি, সম্মুখ সারির কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ সম্প্রসারণ এবং আনুষ্ঠানিকভাবে একটি ‘ন্যাশনাল রেফারেল মেকানিজম’ গ্রহণের জন্য সরকারের প্রশংসা করা হয়েছে সেখানে। আন্তর্জাতিক মানবপাচার নেটওয়ার্ক তদন্তে ইন্টারপোল, ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকাসহ বৈশ্বিক অংশীজনদের সঙ্গে বাংলাদেশের চলমান সহযোগিতার কথাও স্বীকার করা হয়েছে ওই প্রতিবেদনে।