বাস্তবায়নযোগ্য প্রতিশ্রুতি এখনও মেলেনি

আরিফুজ্জামান মামুন, বেলেম (ব্রাজিল) থেকে
১৮ নভেম্বর ২০২৫, ০৯:১২
শেয়ার :
বাস্তবায়নযোগ্য প্রতিশ্রুতি এখনও মেলেনি

ব্রাজিলের আমাজনঘেঁষা নগরী বেলেমে বিশ্ব নেতারা টানটান উত্তেজনা নিয়ে শুরু করেছেন কপ-৩০এর শেষ সপ্তাহের আলোচনা। একদিনের বিরতির পর গতকাল সোমবার পুনরায় জমে ওঠা বৈশ্বিক জলবায়ু কূটনীতির এই মঞ্চ যেন আরও এক ধাপ সংকটের মুখোমুখি। কারণ এখনও নির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা বা বাস্তবায়নযোগ্য প্রতিশ্রুতির দেখা মেলেনি।

প্রকৃতিনির্ভর রূপান্তরের যে আহ্বান প্রথম দিনের আলোচনাতেই উঠে এসেছিল, তা দ্বিতীয় সপ্তাহের শুরুতেই হয়ে উঠেছে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। নেতারা উপলব্ধি করছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াই কোনো একক দেশের পক্ষে সম্ভব নয়; বরং বন, জীববৈচিত্র্য, নদী, পাহাড়- এই পৃথিবীর প্রাকৃতিক পরিকাঠামো রক্ষার মাধ্যমেই সমাধান খোঁজা জরুরি। সেই ভাবনা থেকে বৈঠকে গুরুত্ব পেয়েছে ৫.৫ বিলিয়ন ডলারের ট্রপিকাল ফরেস্ট ফরএভার ফ্যাসিলিটি (টিএফএফএফ), যা আমাজনসহ বিশ্বের

ঝুঁকিপূর্ণ বনাঞ্চলের ভবিষ্যৎ রক্ষার প্রতীক হয়ে উঠেছে। একই সঙ্গে ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও মানবকেন্দ্রিক জলবায়ু পদক্ষেপ নিয়ে ঘোষিত বেলেম ডিক্লারেশন বৈশ্বিক আলোচনায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে।

তবে শুধু ঘোষণায় সীমাবদ্ধ নয় কপ-৩০। টেকসই জ্বালানি রূপান্তরের জন্য ৪এক্স সাসটেইনেবল ফুয়েলস প্লেজ, অভিযোজন ও জলবায়ু সহনশীলতা বৃদ্ধির বহুমাত্রিক পরিকল্পনা, বায়োইকোনমি চ্যালেঞ্জ- সব মিলিয়ে কপ-৩০এর প্রথম সপ্তাহকে অনেকেই বলছেন ‘বাস্তবায়নের সপ্তাহ’। আলোচকদের ভাষায়, এই কনফারেন্সে খেলা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চলে এবং বাস্তবতা হলো, চূড়ান্ত সমঝোতার জন্য প্রতিটি বাক্য, প্রতিটি শব্দকে দরকষাকষির কঠিন প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যেতে হচ্ছে।

দ্বিতীয় সপ্তাহ শুরু হতেই প্রকৃতি রক্ষাকে কেন্দ্র করে বিশ্বসমাজের ঐকমত্য যেন আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বন সংরক্ষণ, আদিবাসী জনগোষ্ঠী ও স্থানীয় সম্প্রদায়ের অধিকার সুরক্ষা এবং জীববৈচিত্র্যের ওপর নির্ভরশীল জীবন-অর্থনীতিকে রূপান্তর করা- এসব এখন আর বিকল্প নয়, বরং বৈশ্বিক টেকসই ভবিষ্যতের মূল স্তম্ভ। উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে বন-অর্থায়নের নতুন রূপরেখা ঘোষণা করেছে বিভিন্ন দেশ, যা টিএফএফএফকে আরও শক্তিশালী করবে। একই সময়ে অভিযোজন তহবিলে নতুন প্রতিশ্রুতি আসে কয়েকটি দেশ থেকে, যার লক্ষ্য ২০২৫ সালের মধ্যে ৩০০ মিলিয়ন ডলার সংগ্রহ করা। ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর এক বিলিয়ন ডলারের বেশি প্রকল্প ইতোমধ্যে অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে, যা তহবিল পেলেই বাস্তবায়ন শুরু করা সম্ভব হবে।

সোমবার শুরু হওয়া আলোচনায় ‘বায়োইকোনমি চ্যালেঞ্জ’ বিশেষভাবে আলোচিত হয়। জি২০ উচ্চস্তরের নীতিমালাকে বাস্তব রোডম্যাপে রূপ দিতে এই উদ্যোগ কাজ করছে নতুন পরিমাপ, প্রযুক্তি, বাজার সংযোগ এবং অর্থায়ন কাঠামো তৈরির মাধ্যমে। প্রকৃতিকে অর্থনীতির অন্তর্গত অংশ করে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করাই এই উদ্যোগের লক্ষ্য। এদিন আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভূমি-অধিকার স্বীকৃতির জন্যও সম্পন্ন হয়েছে একটি উচ্চপর্যায়ের স্বাক্ষর অনুষ্ঠান। ১.৮ বিলিয়ন ডলারের এই অঙ্গীকার বিশ্বব্যাপী বনরক্ষায় নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে বলে আশা করা হচ্ছে।

পরে অনুষ্ঠিত গোলটেবিল বৈঠকে আলোচনা হয় কীভাবে আদিবাসীদের জ্ঞানব্যবস্থা ও শাসন মডেল জলবায়ু অর্থায়নের উদীয়মান কাঠামোগুলোকে আরও শক্তিশালী করতে পারে। শিশু ও যুবদের অংশগ্রহণও গতকাল ছিল দিনের আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ। কপ-৩০এর অ্যাকশন এজেন্ডায় তাদের সক্রিয় উপস্থিতি নিশ্চিত করতে আয়োজিত ‘ফ্রম লিসনিং টু অ্যাকশন’ সেশনে জলবায়ু নেতৃত্বে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ভূমিকা তুলে ধরা হয়। শিশুদের সঙ্গে সংলাপে ব্রাজিলের বিখ্যাত চরিত্র জে গোটিনহা ও কুরুপিরার উপস্থিতি আলোচনা ঘরকে ভরে তুলেছিল উৎসাহ ও প্রতিশ্রুতিতে।

এদিকে গ্লোবাল মিথেন প্লেজের মন্ত্রী–স্তরের বৈঠকে ১৫৯টি দেশ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিরা অংশ নেন। প্রথমবার প্রকাশিত গ্লোবাল মিথেন স্ট্যাটাস রিপোর্টে স্পষ্ট করা হয়, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের দ্রুততম চালক মিথেনকে নিয়ন্ত্রণে এনে ২০৩০ সালের লক্ষ্য অর্জনে গতি বাড়াতে হবে অবিলম্বে।

দিন শেষে প্রেসিডেন্সির ব্রিফিংয়ে কপ-৩০ সভাপতি আন্দ্রেয়া করেয়া দো লাগো বলেন, প্রকৃতি ছাড়া জলবায়ু সমাধান নেই। তাঁর সঙ্গে একমত ব্রাজিলের উপরাষ্ট্রপতি জেরালদো আলক্?মিন, পরিবেশমন্ত্রী মারিনা সিলভা এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জলবায়ু বিভাগের পরিচালক লিলিয়াম শাগাস। তাদের বক্তব্যে বারবার উঠে আসে, বন রক্ষা ও আদিবাসী অধিকার হলো জলবায়ু ন্যায্যতার ভিত্তি। তবে বৈশ্বিক জলবায়ু কূটনীতির বাস্তবতা আরও জটিল। যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চাদপসরণ এবং চীনের নবায়নযোগ্য শক্তি খাতে আগ্রাসী বিনিয়োগ আজ আন্তর্জাতিক জলবায়ু রাজনীতিতে নতুন ভারসাম্য তৈরি করেছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, উন্নয়নশীল দেশগুলো এখন অনেকটাই চীনের প্রযুক্তি ও অর্থায়নের দিকে ঝুঁকছে। গতকালের আলোচনায় নতুন মাত্রা যোগ করে জাতিসংঘের জলবায়ুবিষয়ক নির্বাহী সচিব সাইমন স্টিল কড়া সতর্কবার্তা দিয়েছেন। রাত ৮টার স্টকটেক প্লেনারিতে তিনি বলেন, অগ্রগতি হয়েছে, কিন্তু যথেষ্ট নয়। সময় খুব দ্রুত কমে আসছে।

একই দিনে প্রকাশিত হয় চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভ ও ওয়াইপিএসএর যৌথ প্রতিবেদন ‘ক্লাইমেট ডেট রিস্ক ইনডেক্স ২০২৫’। এতে তুলে ধরা হয় ৫৫টি নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশের গুরুতর ঋণঝুঁকি। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ২০২৩ সালে এই দেশগুলো ঋণ শোধে দিয়েছে ৪৭.১৭ বিলিয়ন ডলার, অথচ জলবায়ু অর্থায়ন হিসেবে পেয়েছে মাত্র ৩৩.৭৪ বিলিয়ন। বাংলাদেশের ছাড় অনুপাত কম হওয়ায় প্রকল্প বাস্তবায়ন আরও ধীর হচ্ছে।