হাত কাঁপা রোগের কারণ ও চিকিৎসা

ডা. এস এম জহিরুল হক চৌধুরী
১৮ নভেম্বর ২০২৫, ০৮:৩৫
শেয়ার :
হাত কাঁপা রোগের কারণ ও চিকিৎসা

বয়স্ক মানুষের মধ্যে হাত কাঁপার সমস্যা বেশ সাধারণ হলেও অনেকে এটিকে স্বাভাবিক বার্ধক্যজনিত লক্ষণ মনে করে গুরুত্ব দেন না। কিন্তু হাতের কব্জি, আঙুল বা বুড়ো আঙুলের পেশিতে অনিচ্ছাকৃত নড়াচড়া তৈরি হলে সেটি আসলে একটি স্নায়ুবিষয়ক সমস্যা। এ কারণে দৈনন্দিন কাজে অস্বস্তি, অক্ষমতা ও মানসিক চাপ তৈরি হয়। যদিও রোগটি প্রাণঘাতী নয়, তবে এর পেছনে মস্তিষ্কের কিছু কোষের নিষ্ক্রিয়তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ফলে রোগী ধীরে ধীরে স্বাভাবিক কার্যক্ষমতার ঘাটতি অনুভব করতে থাকে এবং জীবনের মান কমে যায়।

সাধারণত হাত কাঁপার শুরু হয় এক হাতে। ধীরে ধীরে এটি অন্য হাতে ছড়িয়ে পড়ে এবং শেষপর্যন্ত দুহাতে কাঁপুনি স্থায়ী হয়ে যায়। বিশেষ করে হাত নাড়াচাড়া করলে বা কোনো কাজে মনোনিবেশ করলে কাঁপুনির মাত্রা বেড়ে যায়। মানসিক চাপ, উদ্বেগ, ক্লান্তি বা উত্তেজক খাবার ও পানীয় গ্রহণের সময় কাঁপুনি আরও তীব্র হতে পারে। ফলে পোশাক পরা, গ্লাস ধরা, পানি পান করা, খাওয়া, দাড়ি কামানো এবং এমনকি কলম ধরে লেখার মতো সাধারণ কাজও কঠিন হয়ে পড়ে। এ কারণে অনেক রোগী সামাজিক অস্বস্তি, আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি বা কর্মজীবনে বিঘ্ন অনুভব করেন।

হাত কাঁপার প্রধান কারণ স্নায়ুতন্ত্রের অসঙ্গতি। এর মধ্যে পার্কিন্সন রোগ অন্যতম। এছাড়া জিনগত পরিবর্তন, হাইপারথাইরয়েডিজম, মাল্টিপল স্কলেরোসিস, ডাইস্টোনিয়া, স্ট্রোক-পরবর্তী জটিলতা, বয়স্কজনিত নিউরোডিজেনারেশন এবং পেরিফেরাল নিউরোপ্যাথির কারণেও হাত কাঁপতে পারে। পর্যাপ্ত ঘুম না হলে স্নায়ুর স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হয়, মেজাজ খিটখিটে হয় এবং শরীর কাঁপা অনুভূত হতে পারে। একইভাবে, অতিরিক্ত কফি, চা বা অ্যালকোহল সেবন স্নায়ুর উত্তেজনা বাড়িয়ে কাঁপুনি তৈরি বা বৃদ্ধি করতে পারে। সিগারেটে থাকা নিকোটিন হৃদস্পন্দন বাড়িয়ে দেয়, যা উৎকণ্ঠা ও কাঁপুনি দুই-ই বাড়ায়। শরীরে ভিটামিন-বি১২-এর ঘাটতিও স্নায়ুর কার্যকারিতা কমিয়ে হাতের কম্পন সৃষ্টি করতে পারে।

উপসর্গ নিয়ন্ত্রণে পর্যাপ্ত ও মানসম্মত ঘুম অত্যন্ত জরুরি। প্রতিদিন ৭-৮ ঘণ্টা ভালো ঘুম না হলে মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা ও স্মৃতিশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর প্রভাব শরীরের কার্যক্ষমতা ও হাতের স্থিতিশীলতাতে পড়ে। যদিও হাত কাঁপা সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য নয়, তবে সঠিক চিকিৎসা, জীবনযাপন নিয়ম মানা এবং খাবার-ঘুমের রুটিন ঠিক রাখলে উপসর্গ অনেকাংশে কমিয়ে রাখা যায়। যদি ওষুধে পর্যাপ্ত উপকার না পাওয়া যায় বা কাঁপুনি অত্যন্ত তীব্র হয়, তাহলে মস্তিষ্কে গভীর উত্তেজনা সৃষ্টি (Deep Brain Stimulation) বা থ্যালামোটমি নামক অস্ত্রোপচার বিবেচনা করা যেতে পারে। এসব পদ্ধতি সুনির্দিষ্ট মস্তিষ্ক অঞ্চলে কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করে কাঁপুনি কমাতে সাহায্য করে। ফিজিওথেরাপি এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ভর ব্যবহার, কব্জিতে স্ট্র্যাপ পরা, চাপমুক্ত বল চেপে ধরা বা হাতের সূক্ষ্ম ব্যায়াম কাঁপুনি নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। রোগী যদি নিয়মিত এসব অভ্যাস মেনে চলতে পারেন, তবে হাতের স্থিতিশীলতা বাড়ে এবং দৈনন্দিন কাজের সক্ষমতা উন্নত হয়।

হাত কাঁপা রোগ সম্পূর্ণ প্রতিরোধ সম্ভব নয়। উপসর্গ প্রকাশ পেলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। মদ্যপান, ধূমপান, অতিরিক্ত চা-কফি পান ত্যাগ করে স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন করুন।

লেখক : অধ্যাপক, ক্লিনিক্যাল নিউরোলজি বিভাগ

ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস অ্যান্ড হাসপাতাল

চেম্বার : পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টার লি, শ্যামলী শাখা, ঢাকা

০১৮৬৫৪৪৪৩৮৬; ০১৮৪৩৬১৬৬৮০