অর্থায়ন দয়া নয়, অধিকার
ব্রাজিলের বেলেমে অনুষ্ঠিত বিশ্বের বৃহত্তম জলবায়ু সম্মেলন কপ-৩০ সপ্তম দিনে পা রেখেছে। গতকাল রবিবার ছিল সম্মেলনের সাপ্তাহিক বিরতি। এই বিরতির পর আলোচনার টেবিলে গতি আসবে, এমনই প্রত্যাশা অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর। তবে সাত দিন আলোচনার পরও রয়েছে স্থবিরতা, দ্বিধা আর রাজনৈতিক টানাপোড়েন।
সপ্তম দিনে বাংলাদেশের বক্তব্য বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। ব্লু জোনে বাংলাদেশ প্যাভিলিয়নে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী দেশগুলো এবং যারা ক্ষতিগ্রস্ত তাদের মধ্যে যেন এক অসম যুদ্ধ চলছে। জলবায়ু অর্থায়ন দয়া নয়, অধিকার। তাই এটি অনুদান আকারে দিতে হবে।
তিনি নারীর অংশগ্রহণ প্রসঙ্গে বলেন, জলবায়ু দুর্যোগের প্রথম আঘাত পড়ে নারীদের ওপর, অথচ নীতিনির্ধারণে তাদের অংশগ্রহণ এখনও কাক্সিক্ষত নয়। তরুণদের বিষয়ে উপদেষ্টা বলেন, তাদের উপস্থিতি আলোচনায় নতুন প্রাণ যোগ করেছে। ভবিষ্যতের জলবায়ু নেতৃত্ব তাদের কাঁধেই। উপদেষ্টা বাংলাদেশে ইলিশ সংকটের কথাও উল্লেখ করেন। নদীর স্বভাব পরিবর্তন, আবাসস্থল ধ্বংস এবং জলবায়ু চাপের কারণে জাতীয় মাছ ইলিশ হুমকির মুখেÑ এ কথা তুলে ধরে তিনি বৈশ্বিক সহযোগিতার আহ্বান জানান।
সব মিলিয়ে সপ্তম দিনে কপ-৩০ এর অগ্রগতিতে স্পষ্ট হয় ঋণনির্ভর জলবায়ু অর্থায়ন, ভুল প্রকল্প শ্রেণিবিন্যাস, উন্নত দেশগুলোর প্রতিশ্রুতির দুর্বলতা এবং প্রযুক্তিগত আলোচনার ধীরগতি এ সম্মেলনকে কঠিন সংকটে ফেলেছে। সাইমন স্টিলের সতর্কবার্তাÑ কোনো দেশই আর অপেক্ষা করার মতো অবস্থায় নেই- বৈশ্বিক উদ্বেগকে আরও তীব্রভাবে সামনে নিয়ে আসে।
আরও পড়ুন:
রাজধানীতে কিশোরীসহ ২ জনের মরদেহ উদ্ধার
অর্ধেক পথ অতিক্রম করে কপ-৩০ এর সামনে দাঁড়িয়েছে কঠিন পরীক্ষা। আলোচনার বাকি দিনগুলোতে প্রয়োজনীয় সমঝোতা ও সিদ্ধান্ত না এলে সম্মেলনটি বৈশ্বিক জলবায়ু ন্যায্যতার সংগ্রামে আরেকটি অপূর্ণ প্রতিশ্রুতির প্রতীক হয়ে থাকবে। বিশ্বের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর ভবিষ্যৎ এখনও আটকে আছে অসমাপ্ত ড্রাফটে, অনির্দিষ্ট সংখ্যার ঘরে আর সমাধানহীন বিতর্কে। প্রতিশ্রুতির পাহাড় জমলেও বাস্তবায়নের পথ রয়ে গেছে জটিল ও অনিশ্চিত। উন্নত দেশগুলোর প্রতিশ্রুতিতে দৃঢ়তা না থাকায় ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর দাবি আরও তীব্র হয়ে উঠছে। সপ্তম দিনের আলোচনার পর কপ-৩০ যেন আরও স্পষ্টভাবে রূপ নিয়েছে প্রত্যাশা ও হতাশার এক বিপরীতমুখী মঞ্চেÑ যেখানে একদিকে ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলোর অস্তিত্ব রক্ষার আকুতি, অন্যদিকে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক শক্তিÑপ্রতিযোগিতার জটিল হিসাব।
কপ-৩০ এর শেষ সপ্তাহে বিশ্ব এক কঠিন প্রশ্নের সামনে- প্রতিশ্রুতি কি বাস্তবে রূপ নেবে? নাকি ভরসার শেষ পাতাটিও মিলিয়ে যাবে অগ্রগতিহীন আলোচনায়? কপ-৩০ এর সপ্তম দিনের মূল আলোচনায় স্পষ্ট হয়ে ওঠে সম্মেলনের ধীরগতি নিয়ে উদ্বেগ। জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক নির্বাহী সচিব সাইমন স্টিল স্থানীয় সময় রাত ৮টায় স্টকটেক প্লেনারিতে দেওয়া বক্তব্যে জানান, ‘সাত দিনের আলোচনায় কিছু ইতিবাচক অগ্রগতি থাকলেও তা প্যারিস চুক্তিকে কার্যকরভাবে এগিয়ে নিতে যথেষ্ট নয়। আলোচকদের পরিশ্রমের প্রশংসা থাকা সত্ত্বেও আমাদের আরও অগ্রগতি দরকার। সময় দ্রুত কমে আসছে; মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক শুরুর আগেই প্রযুক্তিগত আলোচনায় স্পষ্ট ফল নিশ্চিত করতে হবে।’
স্টিল আরও বলেন, পেতে হলে দিতে হবেÑ এটাই বাস্তবতা। কোনো দেশের কাছে যা খুব বড় অগ্রাধিকার নয়, অন্য দেশের কাছে তা বেঁচে থাকার প্রশ্নÑ এই বাস্তবতা স্মরণ করিয়ে দেন তিনি। আলোচকদের উদ্দেশে তাঁর আবেদন, সম্মেলন কেবল কূটনৈতিক প্রক্রিয়া নয়; এটি ভবিষ্যতের প্রশ্ন। দরকার হলে একে অপরকে হলওয়েতে খুঁজে নিন, কথা বলুন, সমঝোতায় পৌঁছান।
আরও পড়ুন:
নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে এলডিপি?
সাইমন স্টিলের বক্তব্যের ঠিক পরপরই আলোচনার কেন্দ্রে নতুন মাত্রা যোগ করে প্রকাশিত হয় বেসরকারি সংস্থা চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভ ও ইয়ুথ পাওয়ার ইন সোশ্যাল অ্যাকশন (ওয়াইপিএসএ) প্রণীত প্রতিবেদন ‘ক্লাইমেট ডেট রিস্ক ইনডেক্স ২০২৫’। প্রতিবেদনে বলা হয়, জলবায়ু অর্থায়নে ঋণনির্ভরতা এবং তহবিল ছাড়ে বিলম্ব নিম্ন ও মধ্যম আয়ের ৫৫টি দেশকে গুরুতর অর্থনৈতিক ঝুঁকির মুখে ফেলেছে। এই দেশগুলোর মধ্যে ১৩টি রয়েছে ‘অত্যন্ত উচ্চ ঝুঁকিতে’, ৩৪টি ‘উচ্চ ঝুঁকিতে’ এবং মাত্র ২টি ‘নিম্ন ঝুঁকিতে’।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়Ñ ২০২৩ সালে এই ৫৫টি দেশ ঋণদাতাদের দিয়েছে ৪৭.১৭ বিলিয়ন ডলার, অথচ জলবায়ু অর্থায়নের নামে পেয়েছে মাত্র ৩৩.৭৪ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ জলবায়ু ক্ষতির দায়ভার এখন দেশগুলো নিজেদের ঘাড়েই বহন করছে, বরং আরও ঋণের চাপে জর্জরিত হচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে মাথাপিছু ঋণচাপ বৈশ্বিক গড়ের তুলনায় অনেক বেশি; গড়ে ৩০ ডলার, যেখানে বৈশ্বিক গড় ২৩।
প্রতিবেদনে জলবায়ু প্রকল্পের ভুল শ্রেণিবিন্যাস নিয়েও গুরুতর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। কিছু দেশে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, হোটেল, এমনকি চকলেট শপকেও ‘জলবায়ু প্রকল্প’ হিসেবে দেখানোর উদাহরণ তুলে ধরা হয়। এর ফলে আন্তর্জাতিক আস্থার সংকট আরও গভীর হচ্ছে। অ্যাঙ্গোলার ক্ষেত্রে ছাড় অনুপাত ০.১৮ এবং বাংলাদেশের ০.৬৩। ফলে প্রকল্পগুলোর সময়োচিত বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী দীর্ঘ সময় সুরক্ষার বাইরে থাকছে।
চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের প্রধান নির্বাহী এম জাকির হোসেন খান বলেন, বিশ্বে অর্থের অভাব নেই; অভাব আছে নীতি, নিয়ম এবং প্রতিশ্রুতির। একটি বৈশ্বিক কার্বন ট্যাক্স ও অস্ত্র শিল্পে লেভি আরোপ করলেই বছরে ৬ ট্রিলিয়ন ডলার সংগ্রহ সম্ভব; এর এক-তৃতীয়াংশ দুর্বল দেশগুলোর চাহিদা পূরণে যথেষ্ট।
ওয়াইপিএসএ’র প্রধান নির্বাহী ড. আরিফুর রহমান বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলো সবচেয়ে কম দায়ী হয়েও সবচেয়ে বেশি মূল্য দিচ্ছে। ন্যায়সংগত অর্থায়ন নিশ্চিত না হলে বৈশ্বিক বিপর্যয় আরও গভীর হবে।