ভোটকেন্দ্রে অনিয়ম হলেই বার্তা যাবে নিয়ন্ত্রণকক্ষে

শাহজাহান আকন্দ শুভ
১৭ নভেম্বর ২০২৫, ০৮:১৫
শেয়ার :
ভোটকেন্দ্রে অনিয়ম হলেই বার্তা যাবে নিয়ন্ত্রণকক্ষে

আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটকেন্দ্রের ভেতরে-বাইরে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবং স্বচ্ছতা বাড়াতে সরকার ৩৫ হাজার বডিঅর্ন ক্যামেরা কিনতে যাচ্ছে। অনলাইন এবং অফলাইন দুই ধরনের ক্যামেরাই থাকবে ভোটকেন্দ্রে। এর মধ্যে অনলাইনে থাকা ৫ হাজার বডিঅর্ন ক্যামেরায় এআই প্রযুক্তির ফিচার রাখার পরিকল্পনা করা হয়েছে। গতকাল রবিবার পর্যন্ত ৫৮ হাজার পুলিশ সদস্যকে নির্বাচনী প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে বডিঅর্ন ব্যবহারের প্রশিক্ষণও দেওয়া হচ্ছে পুলিশ সদস্যদের। লাল, কমলা ও সবুজ তিন ধরনের ভোটকেন্দ্রের তালিকা করে বডিঅর্ন ক্যামেরার ব্যবহারের পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে।

পুলিশ সদর দপ্তরের কর্মকর্তারা বলেছেন, আগামী নির্বাচনে চাপ, শক্তি বা হস্তক্ষেপমুক্ত আইনানুগ দায়িত্ব পালন; ফ্রন্ট ফোর্স হিসেবে নির্বাচনকালে স্থিতিশীল পরিবেশ বজায় রাখা, পেশাদারত্ব-নিরপেক্ষতা বজায় রাখা; গুজব ও অপপ্রচারসহ সম্ভাব্য সংকট মোকাবিলায় গোয়েন্দা তৎপরতাসহ সার্বিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে পুলিশ সদস্যদের ১১৭টি ভেন্যুতে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। আগামী ১৫ জানুয়ারি এই প্রশিক্ষণ শেষ হওয়ার কথা।

পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে শান্তিপূর্ণ ও প্রযুক্তিনির্ভর করতে ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তায় সরকার গত আগস্ট মাসে ৪০ হাজার বডিঅর্ন ক্যামেরা কেনার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়। এরপর এই ক্যামেরা কারা কিনবে, অর্থায়ন কীভাবে হবে, কত ক্যামেরা কেনা হবে এ নিয়ে নানা আলোচনার পর শেষ পর্যন্ত ৩৫ হাজার ক্যামেরা কেনার সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে। এ ছাড়া বর্তমানে পুলিশের হাতেও কয়েক হাজার বডিঅর্ন ক্যামেরা রয়েছে, সেগুলোও ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তায় কাজে লাগানোর পরিকল্পনা রয়েছে পুলিশের।

পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ভোটকেন্দ্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী পুলিশ সদস্যদের শরীরে ক্যামেরা (বডিঅর্ন) থাকবে। ভোটকেন্দ্রে হঠাৎ উত্তেজনা, বিশৃঙ্খলা, সংঘাত, হঠাৎ দৌড়ঝাঁপ, কেন্দ্র দখল, মারামারি বা অস্বাভাবিক আচরণ, অস্ত্র প্রদর্শন বা অন্য যে কোনো অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার ভিডিও ও অডিও রেকর্ড করবে বডিঅর্ন ক্যামেরা। এসব ঘটনা বডিঅর্ন ক্যামেরার নজরে আসামাত্র পুলিশ কন্ট্রোল রুমে সংকেত পাঠাবে। সে অনুযায়ী পুলিশের দায়িত্বশীলরা বাড়তি নিরাপত্তার প্রয়োজন হলে সে ব্যবস্থা নিতে পারবেন। এ ছাড়া ব্যালট বাক্স ও ভোটের সামগ্রী পরিবহনকালে পথে হামলা, ছিনতাই বা ভাঙচুরের ঘটনা হলে, সেই সংকেতও চলে যাবে পুলিশ কন্ট্রোল রুমে। পাশাপাশি এসব ঘটনার প্রমাণাদি তাৎক্ষণিক সংরক্ষণ করা যাবে। তা পরবর্তীকালে স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ তদন্তে গুরুত্বপূর্ণ আলামত হিসেবে কাজ করবে। এ ছাড়া ব্যালট বাক্স ও নির্বাচনী সামগ্রী পরিবহনকালে লজিস্টিক টিমের গতিবিধি ট্র্যাকিং সহজ

হবে এবং ‘চেইন অব কাস্টডি’ আরও স্বচ্ছ হবে বলে পুলিশ কর্মকর্তারা মনে করেন।

পুলিশ সদর দপ্তরের একজন কর্মকর্তা জানান, ভোটপূর্ব সহিংসতা, কেন্দ্র দখল, ব্যালট ছিনতাই, ভোটার ভয়ভীতি বা অপকর্ম নিয়ে বিতর্ক হলে বডিঅর্ন ক্যামেরার ফুটেজ নির্ভরযোগ্য প্রমাণ হিসেবে কাজে দেবে। অনেক দেশ ভোট-সংক্রান্ত মামলায় বডিক্যাম ভিডিও ব্যবহার করে দ্রুত বিচার সম্পন্ন করছে।

সারা বিশ্বের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ভিন্ন ভিন্ন মডেলের বডি ক্যামেরার ব্যবহার করে থাকে। এর মধ্যে কোনোটি অনলাইন, কোনোটি অফলাইন, আবার কোনোটিতে অত্যাধুনিক এআই প্রযুক্তিরও ব্যবহার হয়ে থাকে। বাংলাদেশে অনেক আগেই বডিঅর্ন ক্যামেরার ব্যবহার শুরু হয়। যেটা প্রথম ব্যবহার শুরু করে ঢাকা মহানগর পুলিশ। তবে এবারই প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সরকার এই ক্যামেরা ব্যবহার করবে। ভোট চুরি, কেন্দ্র দখল ঠেকাতে এই ক্যামেরাগুলোয় অত্যাধুনিক এআই প্রযুক্তি ব্যবহারেরও সিদ্ধান্ত নেয় সরকার।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, যদি কেউ ছুরি, দা, লাঠিসোঁটা, হকিস্টিক বা অন্য কোনো মারণাস্ত্র নিয়ে ভোটকেন্দ্রে ঢোকার চেষ্টা করে, তখন দূর থেকে ক্যামেরা দেখে এআই প্রযুক্তির সাহায্যে পুলিশ কন্ট্রোল রুমের স্ক্রিনে সতর্কতা সংকেত দেবে। এবার বডিঅর্ন ক্যামেরায় এআই প্রযুক্তির পাশাপাশি মেটা ডাটার তথ্য থাকবে।

গত ১৫ বছরের নির্বাচনে অনিয়ম-কারচুপির অভিযোগ উঠে আসে বার বার। এমন কি ২০১৮ সালের নির্বাচনে দিনের ভোট রাতে করারও অভিযোগ রয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটেই বডিঅর্ন ক্যামেরা ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এ ছাড়া নিরপেক্ষভাবে ভোট অনুষ্ঠানে এবার দেড় লাখ পুলিশকে নির্বাচনী প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। গত ৭ সেপ্টেম্বর পুলিশের নির্বাচনী প্রশিক্ষণ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়। যার সেøাগান ছিল ‘থাকবে পুলিশ জনপদে ভোট দিবেন নিরাপদে’।

পুলিশের নির্বাচনী প্রশিক্ষণের সমন্বয়ক পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত আইজি (এইচআর) আবু নাছের মোহাম্মদ খালেদ গতকাল আমাদের সময়কে বলেন, নির্বাচনে নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালনে মাঠ পুলিশের দেড় লাখ সদস্যকে আইন, বিধি বিধান, অস্ত্র ব্যবহার, বডিঅর্ন ক্যামেরাসহ আরও নানা বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। আমরা আন্তর্জাতিকমানের প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। আগামী ১৫ জানুয়ারি সব ধরনের প্রশিক্ষণ শেষ করা হবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন এই পুলিশ কর্মকর্তা।

জানা গেছে, ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতার অপব্যবহার, অপরাধমূলক অসদাচরণ, জাল-জালিয়াতি, দিনের ভোট রাতে করা এবং আর্থিক লেনদেনের অভিযোগের কারণে চরম বিতর্কিত হয়ে পড়ে পুলিশ বাহিনী। আগামী জাতীয় নির্বাচনে সেই কলঙ্ক মোচনের বড় সুযোগ হিসেবে দেখছেন পুলিশের কর্মকর্তারা। নির্বাচনকালে কোনো দল বা গোষ্ঠীর হয়ে পুলিশ সদস্যরা যেন কাজ না করেন, এ জন্য দায়িত্ব পালনকালে সর্বোচ্চ নিরপেক্ষ ভূমিকা পালনে ওপরও গুরুত্বারোপ করা হচ্ছে প্রশিক্ষণে। পক্ষাবলম্বন করলে কী পরিণতি হতে পারে, এ বিষয়টিও স্মরণ করে দেওয়া হচ্ছে প্রশিক্ষণকালে। মাঠ পুলিশকে নির্বাচনের পূর্ব, নির্বাচনকালীন এবং নির্বাচন পরবর্তী তিন ধরনের নির্বাচনী দায়িত্ব পালনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।

প্রশিক্ষণে বডিঅর্ন ক্যামেরা কীভাবে ব্যবহার করতে হবে, তা হাতে-কলমে শেখানো হচ্ছে। এ জন্য প্রশিক্ষণকালে প্রতিটি ভেন্যুতে বডিঅর্ন ক্যামেরা রাখা হচ্ছে। নির্বাচনকালীন সময়ে কীভাবে দায়িত্ব পালন করতে হবে, তার দিক নির্দেশনাও থাকছে প্রশিক্ষণে। এর মধ্যে নির্বাচনি সামগ্রী, ভোটার, ভোটকেন্দ্র ও বুথের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে পুলিশের আইনানুগ দায়িত্ব; ভোটের দিন মোবাইল, স্ট্রাইকিং এবং রির্জাভ ফোর্সের কর্মবণ্টন, পারস্পরিক যোগাযোগ ও সমন্বয় প্রক্রিয়া এবং দেশি ও বিদেশি নির্বাচনি পর্যবেক্ষক ও সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিরাপত্তা বিধানে পুলিশের করণীয় বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।

জানা গেছে, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৪২ হাজার ৭৬১টি কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ করা হবে। আর মোট ভোটকক্ষ থাকবে ২ লাখ ৪৬ হাজার ৭৩৯টি। লাল, কমলা ও সবুজ তিন ধরনের ভোটকেন্দ্রের তালিকা তৈরি করে সেই অনুযায়ী বডিঅর্ন ক্যামেরার ব্যবহার করা হবে। যেসব কেন্দ্র খুবই ঝুঁকিপূর্ণ, সহিংসতা হওয়ার শঙ্কা বেশি সেসব কেন্দ্রে এক ধরনের ক্যামেরা ব্যবহার করা হবে। ওই ক্যামেরাগুলো ভিডিও ধারণের পাশাপাশি অনলাইনেও সার্ভারের সঙ্গে যুক্ত থাকবে। ভোট গ্রহণকালে কন্ট্রোল রুম থেকে সরাসরি পর্যবেক্ষণ করা যাবে।

আর যেসব কেন্দ্র ততটা ঝুঁকিপূর্ণ নয় কিংবা সংঘাত-সহিংসতার আশঙ্কা কম, সেসব কেন্দ্রে সাধারণ বডিঅর্ন ক্যামেরা ব্যবহার করা হবে। যেগুলো শুধু ভিডিও ধারণ করবে এবং নির্বাচনের পর যদি কোনো প্রয়োজন হয় ওই ক্যামেরার ভিডিওগুলো আদালতে প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করা হবে।