দুটির মধ্যে একটি মেয়ে বাল্যবিয়ের শিকার

নিজস্ব প্রতিবেদক
১৭ নভেম্বর ২০২৫, ০০:৪২
শেয়ার :
দুটির মধ্যে একটি মেয়ে বাল্যবিয়ের শিকার

দেশে এখনও প্রতি দুটি মেয়ের মধ্যে একটি বাল্যবিয়ের শিকার হচ্ছে। ২০১৯ সালের তুলনায় এ হার ৪ শতাংশ কমলেও পরিস্থিতি এখনও উদ্বেগজনক। নতুন এক জরিপে দেখা গেছে, ১৮ বছরের কম বয়সী মেয়েদের বাল্যবিয়ের হার ৬০ থেকে নেমে ৫৬ শতাংশ হয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও ইউনিসেফের নতুন প্রকাশিত মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে (এমআইসিএস-বহুনির্দেশক গুচ্ছ জরিপ) প্রতিবেদনে এসব তথ্য ওঠে এসেছে।

গতকাল রবিবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে চীন-মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে জরিপ প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়। এ বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত দুই ধাপে দেশজুড়ে ৬৩ হাজার পরিবারের ওপর তথ্য সংগ্রহ করা হয়। জাতীয় অগ্রাধিকার ও বৈশ্বিক মানদণ্ড মিলিয়ে ১৭২টি সূচক এবং এসডিজির ২৭টি নির্দেশক এতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। প্রথমবারের মতো অন্তঃসত্ত্বা নারী ও শিশুদের রক্তস্বল্পতা এবং সিসাসহ ভারী ধাতুর দূষণের মাত্রা পরিমাপের বিষয়টিও যোগ করা হয়েছে। এর আগে সর্বশেষ এমআইসিএসের প্রতিবেদনটি ছিল ২০১৯ সালের। ওই সময় থেকে কতটুকু অগ্রগতি বা অবনতি হয়েছে, তার তুলনামূলক চিত্রও তুলে ধরা হয়েছে নতুন প্রতিবেদনে।

জরিপে দেখা গেছে, ২০ থেকে ২৪ বছর বয়সী নারীদের মধ্যে ১৮ বছরের আগেই বাল্যবিয়ের হার ২০১৯ সালের ৫১ শতাংশ থেকে কমে ৪৭ শতাংশে নেমেছে। দেশজুড়ে ১৮ বছরের কম বয়সী মেয়েদের বাল্যবিয়ের হার দাঁড়িয়েছে ৫৬ শতাংশে। এতে বলা হয়েছে- এখনও প্রায় ৩৬ লাখ কিশোরী ১৮ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই বিয়ের মুখোমুখি হচ্ছে। এ কারণে বছরে ৭ থেকে ৮ বিলিয়ন ডলারের অর্থনৈতিক ক্ষতি হচ্ছে। বর্তমান প্রবৃদ্ধির হার বজায় থাকলে বাল্যবিয়ে পুরোপুরি বন্ধ হতে সময় লাগবে ৬৪ বছর।

মা ও শিশুর স্বাস্থ্য স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান বা হাসপাতালে প্রসবের হার ১৮ শতাংশ বেড়ে ৭১ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। তবে উদ্বেগজনকভাবে সিজারিয়ান প্রসব বেড়ে প্রায় ৫২ শতাংশে পৌঁছেছে, যা ২০১৯ সালের তুলনায় ১৬ শতাংশ বেশি। কিশোরী মায়েদের সন্তান জন্মদানের হারও বেড়ে প্রতি হাজারে ৯২ হয়েছে।

অন্যদিকে নবজাতক থেকে শুরু করে ৫ বছরের কম বয়সী শিশুর মৃত্যুর হার কমেছে। শিশুশ্রম ও স্কুলের বাইরে থাকা শিশুর হার বেড়েছে। জরিপে দেখা গেছে, শিশুশ্রম ২ শতাংশের বেশি বেড়ে হয়েছে ৯ শতাংশ। মাধ্যমিক স্কুলে পড়ার বয়সী শিশুদের স্কুলে না পড়ার হার ২ শতাংশ বেড়ে প্রায় ৩৪ শতাংশ হয়েছে। জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রীর ব্যবহার ৫ শতাংশ কমে ৫৮ শতাংশ হয়েছে। মোট প্রজননহার (টিএফআর) ২ দশমিক ৩ থেকে বেড়ে ২ দশমিক ৪ হয়েছে।

নিরাপদ পানি ও সিসা দূষণ

জরিপে দেখা গেছে, ১২ থেকে ৫৯ মাস বয়সী শিশুদের ৩৮ শতাংশের এবং অন্তঃসত্ত্বা নারীদের প্রায় ৮ শতাংশের রক্তে সিসার মাত্রা নিরাপদ সীমার চেয়ে বেশি। সিসাদূষণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা ঢাকা। এখানে আক্রান্তের হার ৬৫ শতাংশ। পানীয় জলের অর্ধেক উৎস এবং গৃহস্থালিতে ব্যবহৃত পানির ৮০ শতাংশে ই. কোলাই ব্যাকটেরিয়া পাওয়া গেছে।

বিশেষজ্ঞদের মতামত

জরিপের ফলাফল প্রকাশ অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বিবিএসের মহাপরিচালক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব আলেয়া আক্তার। সম্মানিত অতিথি ছিলেন ইউনিসেফ বাংলাদেশের প্রতিনিধি রানা ফ্লাওয়ার্স।

রানা ফ্লাওয়ার্স বলেন, বাল্যবিয়ে ও শিশুমৃত্যুর হার প্রমাণ করে অগ্রগতি সম্ভব। সিসাদূষণ ও শিশুশ্রমের মতো সংকট লাখ লাখ শিশুকে সম্ভাবনা থেকে বঞ্চিত করছে। শিশুদের সুরক্ষায় বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।

অষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন মোহাম্মদ মাসুদ রানা চৌধুরী। এমআইসিএসের ফোকাল পয়েন্ট কর্মকর্তা এমদাদুল হক প্রতিবেদনের মূল তথ্য উপস্থাপন করেন। মুক্ত আলোচনা পর্বটি সঞ্চালনা করেন বিবিএসের উপ-পরিচালক মো. আলমগীর হোসেন।

অনুষ্ঠানে প্যানেল আলোচনা সঞ্চালনা করার সময় সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, উন্মুক্ত উপাত্তের দিকে এমআইসিএসের এই প্রতিবেদন একটি গুরুত্বপূর্ণ যাত্রা। বড় পরিসরে আলোচনার জন্য এই উপাত্ত যেন সহজলভ্য হয়। বাল্যবিয়ের ক্ষেত্রে দুটো উপাত্ত এসেছে। নীতিনির্ধারণী ক্ষেত্রে কোনটা ব্যবহার করা হবে, সেই প্রশ্ন থেকে যায়। কোনো ক্ষেত্রে হার কেন বাড়ছে, কোনো ক্ষেত্রে কেন কমছেÑ সেই পেছনের গল্পগুলো ওঠে আসা উচিত। জরিপের মান বাড়াতে হবে।

পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব আলেয়া আক্তার বলেন, এবারের এমআইসিএস পূর্বের যে কোনো সময়ের তুলনায় আরও প্রাসঙ্গিক, কারণ এতে প্রথমবারের মতো গর্ভবতী নারী এবং অল্প বয়সী শিশুদের মধ্যে অ্যানিমিয়া (রক্তস্বল্পতা) ও ভারী ধাতু দূষণের মাত্রা পরীক্ষার নতুন মডিউল অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

প্যানেল আলোচনায় অংশ নেন বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ ও ভুটানের বিভাগীয় পরিচালক জ্যঁ পেস্?ম, ওয়াটারএইডের দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের আঞ্চলিক পরিচালক খায়রুল ইসলাম, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের জ্যেষ্ঠ ফেলো মাহীন সুলতান, সাবেক সচিব মো. সারোয়ার বারী এবং আইসিডিডিআরবির পুষ্টি গবেষণা বিভাগের জ্যেষ্ঠ পরিচালক থাডেয়াস ডেভিড মে।

বক্তারা নিরাপদ পানি সরবরাহে নগর ও গ্রামের বৈষম্য কমানোর ওপর জোর দেন। তাঁরা সি-সেকশনের উচ্চ হার কমাতে সরকারকে নজরদারিব্যবস্থা জোরদার করার আহ্বান জানান। এর বাইরে অনুষ্ঠানে আরও চারটি প্যানেল আলোচনা হয়।