ইসির জন্য বাড়তি চাপ গণভোটের আয়োজন

শাহজাহান মোল্লা
১৭ নভেম্বর ২০২৫, ০৯:০৯
শেয়ার :
ইসির জন্য বাড়তি চাপ গণভোটের আয়োজন

আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। যদি ৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন হয়, তাহলে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) হাতে সময় আছে মাত্র ৮০ দিন। এর মধ্যে ডিসেম্বরের প্রথমার্ধে তফসিল ঘোষণা করতে হবে। সেভাবেই প্রস্তুতি নিচ্ছে ইসি। বর্তমানে চলছে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ। ভোটকেন্দ্র, ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা, ব্যালট পেপার, সুই, সুতা, কালি, কলমসহ যাবতীয় নির্বাচনী সামগ্রী কেনাকাটাও শেষ। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে জাতীয় নির্বাচনের দিন গণভোট আয়োজনের ঘোষণা আসায় বিপাকে পড়েছে নির্বাচন কমিশন। সাংবিধানিক এ প্রতিষ্ঠানকে এখন সবকিছু নতুন করে ভাবতে হচ্ছে। ইসির অনেক কর্মকর্তা গণভোটের এ আদেশকে বাড়তি চাপ হিসেবে দেখছেন।

নির্বাচন বিশেষজ্ঞদের মতে, গণভোট করতে হলে ইসির প্রচুর লজিস্টিক সহায়তা লাগবে। পৃথক এক সেট ব্যালট পেপার লাগবে। সংসদ নির্বাচনের জন্য যে বিচার বিশ্লেষণ করে পোলিং বুথ চূড়ান্ত করা হয়েছিল, সেটা এখন কাজে আসবে না। এখন দুটো আলাদা পোলিং বুথ দরকার হবে। এসব কিছু পরিকল্পনা করে আগাতে না পারলে বুমেরাং হতে পারে। কাজেই এখন থেকেই সব প্রস্তুতি নেওয়া দরকার। এ জন্য আলাদা রোডম্যাপ দরকার বলেও মনে করছেন তাঁরা। এ ছাড়া সংসদ নির্বাচনের জন্য যে ব্যয় ধরা হয়েছে, তার অতিরিক্ত ১০ থেকে ২০ শতাংশ ব্যয় বৃদ্ধি পাবে গণভোট আয়োজনে। এ ক্ষেত্রে সরকারের দ্রুত সিদ্ধান্ত প্রয়োজন বলে মনে করছেন নির্বাচনসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ঘোষণা দিয়েছেন, সংসদ নির্বাচনের দিনই গণভোট হবে। সরকারের এ নির্দেশনা এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে ইসির কাছে পৌঁছায়নি। তথাপি তফসিল ঘোষণার আগে রোডম্যাপ অনুযায়ী যে কাজগুলো ছিল, তা দ্রুততার সঙ্গে কাটছাঁট করতে হচ্ছে ইসির। এ কারণে মাসব্যাপী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করার কথা থাকলেও অতি দ্রুত তা শেষ করতে হচ্ছে। গতকাল পর্যন্ত নিবন্ধিত ২৪টি দলের সঙ্গে সংলাপ হয়েছে ইসির। আজ আরও ১২টি দলের সঙ্গে সংলাপ। এভাবে তফসিলের আগে সব কাজে কাটছাঁট করতে হচ্ছে ইসির।

দেশে সবশেষ গণভোট হয়েছিল ১৯৯১ সালে। এর আগে ১৯৭৭ এবং ১৯৮৫ সালে গণভোট হয়। দীর্ঘ ৩৪ বছর পর তাই ইস্যুটি অনেক ভোটারের কাছে নতুন। যাঁরা আগে গণভোট দিয়েছিলেন, তারাও প্রায় ভুলতে বসেছেন। এ অবস্থায় গণভোট করতে হলে ভোটারের মধ্যে ব্যাপক প্রচারণা দরকার। সেই হিসাবে ইসির হাতে সময় খুবই কম। এ ছাড়া সংসদ নির্বাচনের জন্য যে সংখ্যক ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা ও ভোটকেন্দ্র দরকার, গণভোট হলে সেসবও বাড়াতে হবে। সংসদ নির্বাচনের জন্য ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ শেষ পর্যায়ে। এই সময়ের মধ্যে বাড়তি ভোটগ্রহণ কর্মকর্তার সংস্থানও বড় চ্যালেঞ্জ। প্রথম গণভোটের সময় ফল ঘোষণা করতে ৩০ ঘণ্টা সময় লেগেছিল।

উপরন্তু বিগত তিনটি জাতীয় নির্বাচনে দায়িত্ব পালনকারী কর্মকর্তাদের আসন্ন জাতীয নির্বাচনে বাদ দেওয়ার জন্য রাজনৈতিক চাপ রয়েছে। অথচ ইসির নিজস্ব জনবলেও রয়েছে সংকট। এ অবস্থায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা নিতে হয়। সেখানেও রাজনৈতিক দলগুলো থেকে নানারকম ওজর-আপত্তি রয়েছে। তাই ভোটগ্রহণ কর্মকর্তার প্যানেল প্রস্তুত করাই ইসির জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন বিশ্লেষক ও কর্মকর্তারা।

বর্তমানে দেশের প্রায় পৌনে ১৩ কোটি ভোটারের সঙ্গে প্রবাসের লাখ দশেক ভোটারকে নিয়ে ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচন হবে।

নির্বাচনে ছোট-বড় ৩০টির মতো রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এবার প্রার্থীর সংখ্যাও বাড়বে। তফসিল ঘোষণার পর নির্বাচনের পুরো মাঠ ইসির অধীনে চলে যাবে। তখন সারাদেশে ৩০০টি সংসদীয় আসনের প্রার্থীদের তথ্য যাচাই-বাছাই, আচারণবিধি ও নির্বাচনী পরিবেশ বিঘ্নের নানা অভিযোগ উঠবে। এসব সামাল দিতেও যারপরনাই ব্যস্ত থাকবে ইসি। তদুপরি গণভোটের প্রস্তুতি কীভাবে নিতে হবে, তা নিয়ে এখনও বসতে পারেনি নির্বাচন কমিশন।

নির্বাচন কমিশনার মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকার আমাদের সময়কে বলেন, গণভোটের বিষয় পত্রিকায় পড়ি, টেলিভিশনে দেখি। আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানি না। জানার পর প্রস্তুতির বিষয়টি আসবে। আগে এটার আইনি ভিত্তি হতে হবে। তিনি বলেন, সরকারের নির্দেশনা এলে বলতে পারব, সম্ভব কি না। আইন দেখতে হবে। সেখানে কীভাবে নির্দেশনা দেওয়া আছে, সেগুলো দেখে বলা যাবে এ সময়ের মধ্যে করা যাবে, কি যাবে না। আনুষ্ঠানিকভাবে গণভোটের বিষয়টি না জানা পর্যন্ত কিছুই বলা যাচ্ছে নাÑ যোগ করেন তিনি।

গতকাল নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ জানান, প্রধান উপদেষ্টার অফিস থেকে ডাকলে তিনি যাবেন। সোমবার (আজ) প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরে নির্বাচনে দায়িত্ব পালনকারী কর্মকর্তাদের নিয়ে একটি বৈঠক হবে, সেই বৈঠকে সচিব উপস্থিত থাকবেন। গণভোটের বিষয়ে এদিন হালনাগাদ তথ্য জানাতে পারবেন বলে জানান তিনি। তবে এ পর্যন্ত গণভোট নিয়ে সরকার থেকে ইসির কাছে কোনো আনুষ্ঠানিক চিঠি পৌঁছায়নি। গণভোট সংক্রান্ত অধ্যাদেশ জারি ও বিধি প্রণয়নের পরই সার্বিক বিষয়ে প্রকৃত ধারণা পাওয়া যাবে বলে জানাচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা।

নির্বাচন বিশেষজ্ঞ আব্দুল আলীম আমাদের সময়কে বলেন, সংসদ নির্বাচনের জন্য ইসি যে রোডম্যাপ ঘোষণা করেছিল, সেটাকে হয় পুনর্মূল্যায়ন অথবা নতুন করে রোডম্যাপ ঘোষণা করে কাজ শুরু করা দরকার। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যে সংলাপ হচ্ছে, সেখানে গণভোটের বিষয়টি অন্তুর্ভুক্ত করা উচিত। এ বিষয়ে দলগুলোর পরামর্শ ও সহযোগিতা চাইতে হবে। গণভোটের জন্য অনেক কিছুই নতুন করে দরকার হবে। সেই চ্যালেঞ্জ কীভাবে মোকাবিলা করা যায়, সেটার রোডম্যাপ করে প্রস্তুতি নিতে হবে।

এর আগের দুটি গণভোটে সম্পৃক্ত ছিলেন নির্বাচন কমিশনের এমন দুজন কর্মকর্তা বলেছেন, সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতির সঙ্গে ভোটকক্ষ বাড়ানো, ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা বাড়ানো, প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ আর ভোটার সংখ্যা অনুপাতে ব্যালট পেপার, ব্যালট বাক্সসহ সরঞ্জামাদি বাড়াতে হবে গণভোটে। প্রবাসী বাংলাদেশি ভোটারদের বিষয়টিও রয়েছে। একই দিনে ভোটের সময় সংসদ ও গণভোটের যেমন ব্যবস্থাপনার বিষয় রয়েছে, তেমনি গণনার ক্ষেত্রে কোনটি আগে বা পরে এবং কীভাবে করবে, তা নির্ধারণের বিষয়ও রয়েছে। আর গণভোটের ফলাফল গণনায় সময় লাগবে বেশি।

ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে প্রায় ৪৩ হাজার ভোটকেন্দ্রে প্রায় ২ লাখ ৪৫ হাজার ভোটকক্ষ প্রস্তুতির তথ্য দিয়েছে ইসি। নির্বাচনে ৯-১০ লাখ ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা আর ৭-৮ লাখ আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্য নিয়োজিত থাকবে। গণভোট করতে হলে ভোটকেন্দ্র ও কক্ষ বাড়াতে হবে।

ইসির নির্দেশনায় রিটার্নিং অফিসারের তত্ত্বাবধানে ৩০০ আসনে সার্বিক নির্বাচন পরিচালিত হয়। গণভোট নিয়ে নির্বাচন কমিশনের প্রস্তুতি কেমন, এর আভাস পাওয়া যায় গত ২০ অক্টোবরের আইনশৃঙ্খলাবিষয়ক সভায়। সেদিন উপস্থিতদের উদ্দেশে একজন নির্বাচন কমিশনার বলেছিলেন, জুলাই সনদ অনুযায়ী গণভোট করতে গেলে পরিকল্পনা ও প্রস্তুতিতে পরিবর্তন আসতে পারে। বিষয়টি অ্যাডজাস্ট করার জন্য মানসিক প্রস্তুতি রাখার বিষয়টি তুলে ধরেন তিনি।

সর্বশেষ, গত বৃহস্পতিবার প্রধান উপদেষ্টার ভাষণ যখন প্রচার হচ্ছিল, তখন সিইসিহ নির্বাচন কমিশনাররা ছিলেন দলগুলোর সঙ্গে সংলাপে। সংলাপের শেষাংশে সাংবাদিকরা প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কাছে বার্তা পাঠিয়ে একই দিনে নির্বাচন-গণভোট আয়োজনে নির্বাচনে প্রভাব পড়বে কি না, চ্যালেঞ্জিং হবে কি নাÑ প্রশ্ন তুলে ধরে নির্বাচন কমিশনের মতামত জানতে চান।

এ বিষয়ে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য ইসির সাবেক অতিরিক্ত সচিব জেসমিন টুলী আমাদের সময়কে বলেন, গণভোট করতে হলে ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা বাড়ানোর পাশাপাশি গণভোট ব্যবস্থাপনা নিয়ে ভালো প্রশিক্ষণের দরকার আছে।

১৯৮৫ ও ১৯৯১ সালে গণভোটে দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা থেকে জেসমিন টুলী বলেন, একই দিন সংসদ নির্বাচন ও গণভোটের ক্ষেত্রে কেন্দ্র না বাড়ালেও ভোটকক্ষ বাড়িয়ে দিলে সুচারুভাবে সম্পন্ন করা যায়। ব্যালট পেপার গণনার সময় দুই সেট লোকবল লাগবে। এক সেট সংসদ নির্বাচনের ভোট গণনা করবেন, আরেক সেট হ্যাঁ আর না ভোট গণনা করবেন। তিনি বলেন, প্রিসাইডিং কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্টদের যখন প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে, সে সময় আরও দুটি সেশন বাড়িয়ে দিয়ে হয়তো গণভোটের প্রশিক্ষণ করানো যেতে পারে। গণভোট হলে নির্বাচনী ব্যয় ১০ থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়বে। প্রবাসীদের পোস্টাল ব্যালটেও দুটি ব্যালট ইস্যু করতে হবে।