নতুন মায়ের যত্নে অবহেলা নয়
শিশুদের বলা হয় একটি দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ। সেই ভবিষ্যৎ গর্ভে ধারণ করেন একজন নারী। ‘গর্ভাবস্থার সময় একজন নারীর জীবনটা পুরোপুরি বদলে যায়। তার শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে, দিনরাত বমি, মাথা ঘোরা, পেটের ব্যথা আর মানসিক চাপ- সবকিছু তাকে একাই সহ্য করতে হয়। তাই এ সময় সবচেয়ে বড় ভরসা হওয়ার কথা তার স্বামী। এ ছাড়া যত্ন নেবে সংসারের আর সব মানুষ। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, অনেক স্বামীই এই সময় স্ত্রীকে অবহেলা করেন। তারা বোঝেন না, প্রতিদিন একজন নারী মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে আরেকটা প্রাণ বাঁচিয়ে রাখে। তার একটুখানি যত্ন, একটুখানি সাপোর্ট- সেটা তার কাছে পথিবীর সবচেয়ে বড় শক্তি। গর্ভবতী মাকে অবহেলা নয়, তার যত্ন নেওয়া, এটাই একজন স্বামীর সত্যিকারের দায়িত্ব।’ সুস্থ মা সুস্থ সন্তান- বিষয়টা কারও অজানা নয়। মায়ের শারীরিক অবস্থা যেমন শিশুর সুস্থতায় ভূমিকা রাখে, একইভাবে মায়ের মানসিক স্বাস্থ্যও সন্তানের সুস্থ মানসিক বিকাশের সহায়ক। গর্ভবতী মায়ের জন্য দরকার সুষম খাদ্য, এতে করে প্রয়োজনীয় পুষ্টি নিশ্চিত ও খাদ্যঘাটতি দূর করা সম্ভব। এ সময় পর্যাপ্ত পরিমাণে মাছ, মাংস, ডিম ও দুধ, প্রচুর পরিমাণে মৌসুমি ফল ও শাকসবজি খাওয়া দরকার। এসব জোগানের জন্য পরিবারের সবার সতর্ক দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন।
নারীর গর্ভকালীন প্রথম দু-তিন মাস ও শেষের তিন মাস অতিরিক্ত পরিশ্রম না করে হালকা হাঁটাচলা করা উচিত। এ সময় ভারী জিনিস বহন করা বা তোলা যাবে না। হাঁটাচলায় এবং সিঁড়িতে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। পরিবারের লোকজন এসব বিষয়ে বিশেষ দৃষ্টি রাখবেন। এ সময় দিনের বেলা কমপক্ষে দু-ঘণ্টা ঘুম বা বিশ্রাম এবং রাতে কমপক্ষে আট ঘণ্টা ঘুম আবশ্যক। গর্ভবতী মায়েদের অবশ্যই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, আরামদায়ক, সহজে পরিধানযোগ্য ও ঢিলেঢালা পোশাক ও সঠিক মাপের এবং নরম জুতো পরা উচিত। গর্ভকালীন প্রথম তিন মাস ও শেষ তিন মাস দীর্ঘ ভ্রমণে না যাওয়াই ভালো। ঘরের মানুষরা এই বিষয়গুলো খেয়াল রাখুন, তার পাশে থাকুন। ‘অন্তঃসত্ত্বা নারীর শরীর ও মনের অবস্থা নাজুক থাকে। এই সময় তাকে মানসিকভাবে আঘাত করা বা সে কষ্ট পেতে পারে এমন আচরণ করা মোটেও ঠিক নয়।’ গর্ভবতী নারীর মানসিক অবস্থা তার গর্ভস্থ শিশুর ওপর ভীষণ প্রভাব ফেলে। এই সময়ে নারীদের শরীর দুর্বল থাকে যার প্রভাব পড়ে তার মনে। ফলে অনেকের মেজাজ খিটমিটে হয়ে যায়, অনেকের মধ্যে আবার সন্দেহপ্রবণতা দেখা দেয়।
জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের (নিপোর্ট) এক গবেষণার প্রেক্ষিতে জানা যায়, গত ১০ বছরে মাতৃমৃত্যু হার কমেছে, প্রতি লাখে জীবিত শিশু জন্মেছে প্রায় ৯৪ জন। কিন্তু মাতৃমৃত্যু হার এখনও কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছায়নি। প্রায় ১৪ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে দেশের আনাচে-কানাচে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হচ্ছে। মায়েদের হোম ডেলিভারিতে নিরুৎসাহিত করতে মাঠ পর্যায়ের স্বাস্থ্যকর্মীরা কাজ করছেন। নিপোর্টের গবেষণায় বলা হয়, দেশের মাতৃমৃত্যু হারের কারণগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি রক্তক্ষরণে ৩১ শতাংশ, একলামশিয়ায় ২৪ শতাংশ, পরোক্ষ কারণে ২০ শতাংশ, অনির্ধারিত কারণে ৮ শতাংশ, গর্ভপাত জটিলতায় ৭ শতাংশ, অন্যান্য কারণে ৭ শতাংশ এবং অমানুষিক শ্রমে ৩ শতাংশের মৃত্যু হয়।
শুধু সন্তান জন্মের আগেই নয়, বরং পরবর্তী সময়েও মায়ের মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি খেয়াল রাখা উচিত। সন্তান জন্মের পর মাকে অনেক রাত নির্ঘুম কাটাতে হয়, সেই সঙ্গে স্তনদানের কারণে মা অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়েন, দেহে আসে পরিবর্তন। এই বিষয়গুলো মায়ের মনে বাড়তি চাপ সৃষ্টি করে। মাকে মানসিকভাবে সুস্থ রাখতে এই পরিবর্তনকে স্বাভাবিকভাবে দেখা ও মাতৃত্বের প্রতিটা যাত্রাকে উৎসাহিত করতে হবে। কারণ মায়ের মনমেজাজ, মা কতটা হাসিখুশি ও তৎপর তার ভিত্তিতে শিশুর শৈশবের গাঁথুনি হয়। গর্ভাবস্থায় মায়ের মানসিক যত্ন নিতে সন্তানের বাবাকে সদা তৎপর থাকতে হবে। গর্ভবতী স্ত্রী যদি কোনো কারণে অস্বাভাবিক আচরণ করে থাকেন তাহলে তাকে বোঝানোর দায়িত্ব স্বামীর। পাশাপাশি যতটা সম্ভব স্ত্রীকে সময় দেওয়ার চেষ্টা করতে হবে। মাঝে মধ্যে স্ত্রীকে নিয়ে বেড়াতে যাওয়া, তার শরীর স্বাস্থ্যের খোঁজ নেওয়া, ভবিষ্যতে সন্তানকে নিয়ে দুজনে একসঙ্গে পরিকল্পনা করলে স্ত্রীর মনে সন্দেহ বাসা বাঁধার কোনো সুযোগ পাবে না। তাই মা ও শিশুর শারীরিক-মানসিক সুস্থতার কথা বিবেচনা করে স্ত্রীর প্রতি ইতিবাচক আচরণ করা ও তাকে সময় দেওয়া উচিত। গর্ভাবস্থা একটি বিশেষ অবস্থা। এই সময়ে প্রত্যেক নারীর বিশেষ যত্নের প্রয়োজন হয়। কারণ একজন নারী যতবারই গর্ভধারণ করেন ততবারই জটিলতা দেখা দিয়ে তার জীবনের ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে। তাই গর্ভধারণ করলে নারীর নিজের ও পরিবারের সদস্যদের উচিত তার শারীরিক, মানসিক যত্ন নেওয়া।
আরও পড়ুন:
ডেঙ্গুতে ২৪ ঘণ্টায় ১২ জনের মৃত্যু