দেশের বিভিন্ন স্থানে বাড়ছে অগ্নিসংযোগ-নাশকতা

সাজ্জাদ মাহমুদ খান
১৬ নভেম্বর ২০২৫, ০৯:০১
শেয়ার :
দেশের বিভিন্ন স্থানে বাড়ছে অগ্নিসংযোগ-নাশকতা

সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন স্থানে বেড়ে গেছে অগ্নিসংযোগ ও নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিভিন্ন আইডি ও পেজ থেকে গ্রামীণ ব্যাংকের বিভিন্ন শাখা-উপশাখার ঠিকানা ছড়িয়ে দিয়ে তাতে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার ও ভাঙচুর চালানোর উসকানি দেওয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে গ্রামীণ ব্যাংকের কয়েকটি স্থাপনায় হামলা-ভাঙচুর, ককটেল নিক্ষেপ ও আগুন দেওয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়। দেশের কয়েকটি স্থানে জুলাই স্মৃতিস্তম্ভে পেট্রল ঢেলে আগুন দেওয়া হয়েছে। পুলিশ বলছে, অগ্নিকাণ্ডের জন্য ভাড়াটে তরুণ ও কিশোরদের ব্যবহার করা হচ্ছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিশেষ অভিযানের গতি বাড়াচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জুলাই অভ্যুত্থানে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনার বিচারের রায় ঘনিয়ে আসায় ১০ থেকে ১৩ নভেম্বর বিক্ষোভ ও ‘ঢাকা লকডাউন’ কর্মসূচি দেয় রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ। এসব কর্মসূচি ঘিরে গত সোমবার থেকে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বাসে-ট্রেনে আগুন দেওয়ার পাশাপাশি হাতবোমার বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে। আজ রবিবার ও আগামীকাল সোমবার দেশজুড়ে কমপ্লিট শাটডাউন ঘোষণা করেছে দলটি। সামাজিক মাধ্যমে ঘোষণা দেওয়া এ কর্মসূচি ঘিরে অগ্নিসংযোগ, ককটেল নিক্ষেপ ও নাশকতার শঙ্কা তৈরি হয়েছে।

স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, আদালতের আদেশ অনুযায়ী ১৭ নভেম্বর (আগামীকাল) শেখ হাসিনার মামলার রায় ঘোষণা করা হবে। এ জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যা যা প্রস্তুতি নেওয়ার, নিয়েছে। এ নিয়ে কোনো শঙ্কা নেই। রায় খুব ভালোভাবে হবে। কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা হবে না।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সামাজিক মাধ্যমের বিভিন্ন আইডি ও পেজ থেকে ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগের উসকানি দেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে গত শুক্রবার বিকাল ৩টা ৫৮ মিনিটে এনায়েত উল্লাহ নামে একজন তার ফেসবুক আইডি থেকে গ্রামীণ ব্যাংকের সব শাখার ঠিকানা শেয়ার করে লিখেছেন- ‘যাদের বাসা-বাড়িতে গ্রামীণ ব্যাংকের অফিস ভাড়া দেওয়া

আছে, আপনারা তাড়াতাড়ি ভাড়া বাতিল করে দিন, তা না হলে আপনারাও বিপদে পড়ে যাবেন।’ তিনি আরও লেখেন, ‘সবাই নিজ নিজ দায়িত্বে এলাকার গ্রামীণ ব্যাংকের ঠিকানা সেভ করে রাখুন। আর কী করতে হবে, বাকিটা আপনারা জানেন।’

প্রায় একইভাবে গ্রামীণ ব্যাংকের ঠিকানা শেয়ার করে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করার উসকানি দেওয়া হয়েছে। শুভ চৌধুরী নামে একজন লিখেছেন, ‘সবাই নিজ দায়িত্বে এগুলোকে (গ্রামীণ ব্যাংক) জয় বাংলা করে দিন।’ তবে আগুন ও ভাঙচুরের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠেছেন অনেকেই। তানিম মাহফুজ নামে একজন ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন- ‘আপনারা (আওয়ামী লীগ নেতারা) সবাই দেশের বাইরে। যারা করতে যাবে তাদের ফোনও ঠিকমতো ধরে না কেউ। জেলে গেলে কেউ খবরও নেয় না। আপনারা এ রকম ডাক না দিয়ে নিজেরাও একটু মাঠে থেকে নেতৃত্ব দিন।’

দেশের বিভিন্ন স্থানে গ্রামীণ ব্যাংকের শাখা-উপশাখায় হামলা ও আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটছে। গতকাল শনিবার ভোররাতে ফরিদপুরের মধুখালীর রায়পুর ইউনিয়নের মাঝকান্দি এলাকায় গ্রামীণ ব্যাংকের একটি শাখা কার্যালয়ে পেট্রল ঢেলে অগ্নিসংযোগ করা হয়। শাখার ব্যবস্থাপক নবিনা নুরুল পিয়া বলেন, ভোর সাড়ে ৩টার মধ্যে দুর্বৃত্তরা ব্যাংকের দরজার সামনে পেট্রল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। তবে তেমন কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।

গত মঙ্গলবার রাত ২টায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগরে গ্রামীণ ব্যাংকের চান্দুরা শাখায় জানালার কাচ ভেঙে পেট্রল ঢেলে আগুন দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। গত বৃহস্পতিবার ভোর সাড়ে ৪টার দিকে গোপালগঞ্জের সদর উপজেলার গ্রামীণ ব্যাংক উলপুর শাখার ভবন লক্ষ্য করে পেট্রল বোমা নিক্ষেপ করে দুর্বৃত্তরা। কালো রঙের একটি মাইক্রোবাস থেকে দুর্বৃত্তরা পাঁচ থেকে ছয়টি পেট্রল বোমা নিক্ষেপ করে। গত রবিবার রাত আড়াইটার দিকে মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া উপজেলার দড়গ্রাম ইউনিয়নে তেবাড়িয়া এলাকায় গ্রামীণ ব্যাংকের স্থানীয় কার্যালয়ে আগুন দেওয়ার চেষ্টা করে একদল দুর্বৃত্ত। গত সোমবার রাজধানীর মিরপুর-২ এ গ্রামীণ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের সামনে মোটরসাইকেলে হেলমেট পরা দুই দুর্বৃত্ত ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে পালিয়ে যায়। গতকাল শনিবার সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় রাজধানীর হাতিরঝিলে ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। ককটেল বিস্ফোরণের পর পাশেই থাকা একটি মোটরসাইকেলে আগুন ধরে যায়।

দেশের জেলায় জেলায় গড়ে ওঠা জুলাই স্মৃতিস্তম্ভে হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটছে। পিরোজপুরে জুলাই আন্দোলনে শহীদদের উদ্দেশে শহীদ মিনার চত্বরে নির্মিত ‘জুলাই স্মৃতিস্তম্ভে’ গতকাল শনিবার ভোর রাতে অগ্নিসংযোগ করা হয়। ঘটনার পর টহলের দায়িত্বে থাকা দুই পুলিশ সদস্যকে পুলিশ লাইনে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে বলে জেলা পুলিশ সুপার খান মোহাম্মদ আবু নাসের জানান। পিরোজপুর পৌরসভার সাবেক কাউন্সিলর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সালাম বাতেন গণমাধ্যমকে বলেন, শহীদদের প্রতি অবমাননাকর এ ধরনের কর্মকাণ্ড পরিকল্পিতভাবে করা হয়েছে। ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রলীগ ও যুবলীগের কর্মীদের দিয়ে পিরোজপুরসহ একাধিক স্থানে শহীদদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভগুলোয় নাশকতা চালানো হচ্ছে।

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে সড়ক ও জনপদ (সওজ) কার্যালয়ের সামনে থামিয়ে রাখা একটি মিনিবাসে গতকাল সকাল ৬টার দিকে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। এ বিষয়ে সিদ্ধিরগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ শাহিনূর আলম জানান, মিনিবাসটি শুক্রবার রাতে চালক সেখানে রেখে চলে যান। পরে শনিবার সকালে বাসটিতে হঠাৎ আগুন দেখা গেলে স্থানীয় লোকজন ও ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনেন। অগ্নিকাণ্ডে বাসের সিট ও কাচ পুড়ে গেলেও কোনো প্রাণহানির ঘটনা ঘটেনি।

গত বৃহস্পতিবার রাত সোয়া ১টার দিকে বরগুনা সার্কিট হাউস এবং মুক্তিযুদ্ধের শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ সংলগ্ন ‘জুলাই শহীদ স্মৃতিস্তম্ভে’ আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া পটুয়াখালীতে জুলাই স্মৃতিস্তম্ভে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। গত শুক্রবার ভোরে জেলার সার্কিট হাউস চত্বরসংলগ্ন দক্ষিণ পাশে স্থাপিত ওই স্মৃতিস্তম্ভে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে- অগ্নিসস্ত্রাস প্রতিরোধ ও নাশকতাকারীদের দমনে পুলিশ কঠোর অবস্থানে রয়েছে। সারা দেশে বিশেষ অভিযানে প্রতিদিন হাজারের বেশি চিহ্নিত অপরাধী গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। গতকাল শনিবার ঢাকা থেকে কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সম্পাদক বাবলুর রহমানসহ কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী যুবলীগের আরও চার নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। ঢাকার পাশাপাশি বাইরের জেলাগুলোতে অভিযান জোরদার করা হয়েছে। কুড়িগ্রাম জেলা পুলিশ জানিয়েছে, নাশকতা ও সহিংস কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে বিশেষ অভিযানে শুক্রবার ১১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আর গত চার দিনের ধারাবাহিক অভিযানে ৬২ জনকে গ্রেপ্তার করেছে জেলা পুলিশ।

কুড়িগ্রাম জেলা পুলিশের মিডিয়া অফিসার ও উলিপুর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. আশরাফুল আলম বলেন, ‘কুড়িগ্রাম জেলার বিভিন্ন থানায় নাশকতা ও সহিংসতার অভিযোগে বিশেষ অভিযান চালানো হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে এই অভিযান অব্যাহত থাকবে।

অগ্নিকাণ্ডে ভাড়াটে কিশোর-তরুণ : কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের বিভিন্ন কর্মসূচি ঘিরে গাড়িতে আগুন ও ককটেল নিক্ষেপে ভাড়াটে কিশোর-তরুণদের ব্যবহার করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। তাদের কোনো রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা নেই, শুধু অর্থের জন্য নাশকতায় অংশ নিচ্ছে। এর মধ্যে গত বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে শাহআলী থানাধীন মিরপুর বেড়িবাঁধ সড়কের পাশে রাখা একটি বাসে আগুন দেওয়ার সময় স্থানীয় লোকজন ধাওয়া দিলে তুরাগ নদে পড়ে মারা যান আব্দুল্লাহ আল সাইয়াফ (১৮) নামে এক তরুণ। এ সময় ধরা পড়েন রুদ্র মোহাম্মদ নাহিয়ান আমির সানি (১৮) নামে আরেক তরুণ। তাদের সঙ্গে থাকা আরেকজন পালিয়ে যান। নিহত সাইয়াফ মিরপুরের নেভাল একাডেমি কলেজে উচ্চমাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষে (বাণিজ্য বিভাগ) পড়তেন। আর গ্রেপ্তার হওয়া সানি ইংরেজি মাধ্যম স্কুল একাডেমিয়ার শিক্ষার্থী।

পুলিশ ও পরিবারের দাবি, ওই তরুণের কোনো রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা ছিল না। পুলিশ বলছে, আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনের স্থানীয় এক নেতা তাদের ‘পার্টি করার’ জন্য অর্থ দিতে চেয়েছিলেন। সেই ‘প্রলোভনে’ পড়েই এসব তরুণ মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে গিয়েছিলেন বাসে আগুন দিতে। গ্রেপ্তার হওয়া রুদ্র মোহাম্মদ নাহিয়ান আমির সানিকে জিজ্ঞাসাবাদের বরাতে পুলিশ বলেছে- এ ঘটনায় আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনের স্থানীয় এক নেতার সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। ‘পার্টি করার টাকা দেওয়ার’ লোভ দেখিয়ে তরুণদের এ কাজে যুক্ত করেছে ওই নেতা।

পুলিশের দারুস সালাম জোনের সহকারী কমিশনার ইমদাদ হোসেন বিপুল বলেছেন, স্থানীয় এক রাজনৈতিক নেতার প্ররোচনায় তারা বাসে আগুন দিতে যায়। ওদের বলা হয়েছে, ‘যদি একটা বাস পোড়ানোর ভিডিও ফুটেজ আনতে পারো, তাহলে তোমাদের ৫ হাজার টাকা দেব। রাতে পার্টি করতে পারবে।’