র্যাপার থেকে নিউইয়র্কের মেয়র
লন্ডনের মেয়র সাদিক খান ৪ নভেম্বর রাতে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের ফলাফল দেখতে জেগে ছিলেন। বিশেষভাবে নজর রেখেছিলেন দেশটির সবচেয়ে বড় শহর নিউইয়র্ক সিটির মেয়র নির্বাচনের দিকে। জোহরান মামদানির জয়ের পর তিনি বলেন, ‘এটি উদার, প্রগতিশীল ও বহু সাংস্কৃতিক রাজনীতির জয়।’ ডেমোক্রেটিক সোশ্যালিস্ট প্রার্থী ও অভিবাসী পরিবারের সন্তান মামদানিকে যেভাবে নিউইয়র্কের স্থানীয়, অভিবাসী, খ্রিস্টান, হিন্দু, মুসলিম, ইহুদিসহ সবাই সমর্থন ও ভালোবাসায় সিক্ত করেছেন- তাতে তার জয়ের ব্যাখ্যায় সাদিক খানের মন্তব্যই সবচেয়ে বাস্তবসম্মত। মামদানি একজন র্যাপার থেকে নিউইয়র্কের মেয়র হয়ে ওঠার গল্প আজ বিশ^মিডিয়ার অন্যতম প্রধান খবর। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মুখে চুনকালি লেপন করে দিয়ে তিনিই বিশে^র রাজধানীখ্যাত নগরটির সর্বকনিষ্ঠ ও প্রথম মুসলিম মেয়র হয়ে ইতিহাস গড়লেন। মামদানির জয়ের পথে ট্রাম্পের চাতুরতাপূর্ণ কোনো কৌশলই বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি।
একজন সুদর্শন, টগবগে ও স্মার্ট তরুণ ৩৪ বছরের মামদানি। নির্বাচনী প্রচারণায় তিনি চমক দেখিয়েছেন তার বুদ্ধিদীপ্ত কথাবার্তা ও ব্যতিক্রমী কৌশলের মাধ্যমে। প্রচারণায় তার শান্ত ও আত্মবিশ^াসী প্রতিশ্রুতি তরুণ ভোটারদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলে। যে কারণে হেরে যান রিপাবলিকান প্রার্থী কার্টিস স্লিওয়া ও সাবেক গভর্নর অ্যান্ড্রু কুওমো। মামদানির নির্বাচনী প্রচারণা ছিল পুরোটাই বলিউড প্রভাবিত ও অনুপ্রাণিত। প্রচারণার পোস্টার ছিল ব্যতিক্রমী, যা আধুনিক আমেরিকার রাজনীতিতে সবচেয়ে আকর্ষণীয়ভাবে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। ক্লাসিক হিন্দি সিনেমার পোস্টার থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে এমন পোস্টার তৈরি করা হয়। মামদানির সমাবেশে ব্যাকগ্রাউন্ডে বেজেছে বলিউডের জনপ্রিয় সব গান। এমনকি প্রচারণায় ছিল বলিউডের সংলাপ, ভিডিও। এগুলো মামদানিকে ভোটারদের কাছে দ্রুত পৌঁছাতে সাহায্য করেছে।
মামদানি ভারতীয় বংশোদ্ভূত। তার মা ভারতের বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা মীরা নায়ার। বাবা যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ^বিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের খ্যাতিমান অধ্যাপক মাহমুদ মামদানিও জন্মগতভাবে ভারতীয়। মা-বাবার পরিচয় মামদানির জনপ্রিয়তা বৃদ্ধিতে কিছুটা হলেও রসদ জুগিয়েছে। তার স্ত্রী সিরীয় বংশোদ্ভূত রমা দুওয়াজি প্রচারণাকালে সর্বক্ষণই তার পাশে থেকে উৎসাহ দিয়েছেন। মামদানির জন্ম উগান্ডার কাম্পালায়। সাত বছর বয়সে তিনি মা-বাবার সঙ্গে নিউইয়র্কে আসেন। ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব পান এই স্নাতক। ২০২১ সাল থেকে তিনি কুইন্সে অবস্থিত নিউইয়র্ক রাজ্য বিধানসভার ৩৬তম অঞ্চলের নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ২০২৪ সালে মামদানি ২০২৫ সালের মেয়র নির্বাচনে তার প্রার্থিতা ঘোষণা করেন। অন্য প্রতিদ্বন্দ¦ীদের পরাজিত করার মাধ্যমে ২০২৫ সালের ২৪ জুন তিনি ডেমোক্রেটিক প্রার্থী মনোনীত হন। সবশেষ ৪ নভেম্বরের ভোটে জিতে তিনি নিউইয়র্কের ১১১তম মেয়র হলেন। এদিন ভোটে ৩০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি উপস্থিতি ছিল। এ ছাড়া প্রেসিডেন্ট নির্বাচন বাদে আগাম ভোট পড়ায়ও রেকর্ড হয়েছে, যা মামদানির জনপ্রিয়তার প্রমাণ দেয়। আগামী জানুয়ারিতে তিনি শপথ নেবেন।
ব্যক্তিগতভাবে মামদানি হিপহপ ভক্ত এবং সংগীত পরিবেশন ও প্রযোজনা করেছেন। তিনি র্যাপিং জগতে ছিলেন। ‘ইয়ং কার্ডমম’ এবং পরে ‘মিস্টার কার্ডমম’ নামে পরিচিতি পান। ২০১৬ সালে ডিজনি ছবি কুইন অব কাটওয়ে-এর জন্য শিল্পী হাবের সঙ্গে ‘ওয়ান স্পাইস’ নামে একটি গান তৈরি করেন। ২০১৯ সালে প্রকাশিত হয়েছিল আরেকটি গান ‘নানি’।
ভোটে মূলত মামদানি বাজিমাত করেছেন নিম্ন আয়ের মানুষের পক্ষে কথা বলে। ভোটের প্রচারণায় তার প্রধান ফোকাস ছিল নিম্ন আয়ের মানুষের উচ্ছেদ এড়ানো এবং সাশ্রয়ী মূল্যে আবাসন বাড়ানো। মামদানির পরিকল্পনায় রয়েছে ভাড়া স্থিতিশীল ইউনিটের সংখ্যা বাড়ানো, বাড়িওয়ালাদের কঠোর নিয়ন্ত্রণ, ধনী ব্যক্তিদের ওপর ন্যায্য ফ্লাট কর আরোপ, করপোরেশন ট্যাক্স বাড়ানো, বিনামূল্যে বাস পরিষেবা চালু, ন্যূনতম মজুরি প্রতিষ্ঠা, শিশুদের যত্নের সুযোগ সম্প্রসারণ, নগর কর্তৃপক্ষের মালিকানাধীন মুদি দোকান প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি। এসব প্রতিশ্রুতি তার ৫০ শতাংশের ওপরে ভোট প্রাপ্তিতে ম্যাজিকের মতো কাজ করেছে। মূলত সিংহভাগ সম্পদের মালিক শীর্ষ ১ শতাংশ ধনী এবং আমেরিকার ধনী ও সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে ক্রমাগত বৈষম্য বৃদ্ধির বিরুদ্ধে তার লড়াই করার মনোভাব সবার নজর কেড়েছে। মামদানি তরুণ ও ক্যারিশম্যাটিক। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও তার প্রভাব রয়েছে। তিনি যেমন সাধারণ ও খেটে খাওয়া মানুষের মধ্যে আশার সঞ্চার করেছেন, তেমনি তার বিজয়ে ইউরোপের বামপন্থিদের মধ্যেও আশার সঞ্চার হয়েছে।
মেয়র হিসেবে মামদানির পথচলা খুব সহজ হবে না। প্রচারণার সময় তিনি গণমাধ্যমের ব্যাপক মনোযোগ আকর্ষণ করেছেন। তাই স্বভাবতই মেয়রের দায়িত্বকালীন তিনি গণমাধ্যমের ছুরির নিচে থাকবেন, বিশেষ করে ট্রাম্পপন্থি গণমাধ্যমের। চুন থেকে পান খসলেই তারা তাকে নাজেহাল করতে উদ্যত হবে। প্রচারণার সময় যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তা বাস্তবায়ন না করতে পারলে ভোটারদের বিরাগভাজন হবেন। ট্রাম্প নানা অজুহাতে কেন্দ্রীয় সরকারের তহবিল আটকে দিতে পারেন। করপোরেট ও অভিজাত ব্যবসায়ীরা তাকে ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করবেন, যাদের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালিয়ে তিনি সফলতা পেয়েছেন। নিউইয়র্কে এলে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে গ্রেপ্তারের কথা বলায় এবং ফিলিস্তিনকে সমর্থন করায় তিনি আমেরিকান-ইসরায়েল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটি (আইপ্যাক) ও জায়নবাদীদের রোষানলে পড়বেন। এ ছাড়া আরও নানা ধরনের চ্যালেঞ্জ তাকে মোকাবিলা করতে হবে।
এক কথায় রিপাবলিকান ও ডানপন্থি শিবির মামদানিকে স্বস্তিতে থাকতে দেবে না। তারা তার বিরুদ্ধে ধর্ম, বর্ণ, আমেরিকায় বামপন্থার উত্থান ইত্যাদি ইস্যুতে তোপ দাগবেন। সম্প্রতি ট্রাম্প সাদিক খানকে ইঙ্গিত করে বলেছিলেন, তিনি লন্ডনে শরিয়া আইন চালু করতে চান। মামদানিকেও ট্রাম্প এ রকম বহু বাক্যবাণে জর্জরিত করবেন। তবে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে মামদানি যদি তার প্রতিশ্রুতি ও তা বাস্তবায়নে অটল থাকতে পারেন, তবে তিনি ভবিষ্যতে ডেমোক্রেটিক পার্টিতে শক্ত অবস্থান তৈরি করতে পারবেন এবং তার জন্য দেশটির প্রেসিডেন্ট পদে লড়াইয়ের পথও সুগম হবে।
জুয়েল জনি : সহসম্পাদক, দৈনিক আমাদের সময়
মতামত লেখকের নিজস্ব