শিশুর মানসিক বিকাশে সংগীত অপরিহার্য
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ বিধিমালায় বড় ধরনের পরিবর্তন এনেছে সরকার। গত ২ নভেম্বর জারি করা সংশোধিত বিধিমালায় সংগীত ও শারীরিক শিক্ষা বিষয়ে শিক্ষক নিয়োগের সুযোগ বাতিল করেছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। এর আগে গত আগস্টে জারি করা প্রজ্ঞাপনে ‘সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ বিধিমালা, ২০২৫’-এ চার ধরনের শিক্ষকের পদ রাখা হয়েছিল- প্রধান শিক্ষক, সহকারী শিক্ষক, সহকারী শিক্ষক (সংগীত) ও সহকারী শিক্ষক (শারীরিক শিক্ষা)। কিন্তু সংশোধিত বিধিমালায় কেবল প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষকের পদ বহাল রাখা হয়েছে।
আগস্টের শেষে এই প্রজ্ঞাপনটি জারির পর থেকে ধর্মভিত্তিক কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নেতারা প্রকাশ্যে সংগীত শিক্ষক নিয়োগের বিরোধিতা করেন এবং তার বদলে ধর্ম শিক্ষক নিয়োগের দাবি তোলেন। এমনকি সংগীত শিক্ষক নিয়োগ বাতিল না করা হলে কঠোর আন্দোলনেরও হুমকি দিতে থাকেন। ধর্মভিত্তিক দলগুলোর এই চাপের মুখে সরকার পদগুলো বাতিলের মাধ্যমে যে পিছু হটল, তা নতুন কিছু নয়- এর আগেও অনুরূপ ঘটনায় সরকারের নমনীয় অবস্থান দেখা গেছে। ফলে সরকারের নীতিনির্ধারণে এই দলগুলোর যে প্রভাব বাড়ছে তা আরও দৃশ্যমান হলো; যা নাগরিক সমাজের উদ্বেগ ও আশঙ্কাকে বাড়িয়ে তুলছে। অন্যদিকে ধর্মভিত্তিক দলগুলোও নিজেদের আরও ক্ষমতাবান এবং সরকারের মধ্যে অন্যতম প্রভাব বিস্তারকারী হিসেবে নিজেদের দেখছে এবং নিজেদের খেয়ালখুশিমতো অযৌক্তিক ও গণবিরোধী দাবি আদায় করে নিচ্ছে। সরকারের এই নমনীয়তা এবং নতজানু নীতি অন্য অর্থে সরকারের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ মদদের ইঙ্গিতই বহন করছে।
এদিকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এই দুই বিষয়ে শিক্ষক নিয়োগের সুযোগ বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সুপ্রিমকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ও মহিলা ক্রীড়া সংস্থার সভাপতি ব্যারিস্টার সারওয়াত সিরাজ শুক্লা। তার করা রিটের প্রাথমিক শুনানি শেষে গত ১০ নভেম্বর হাইকোর্ট একটি রুল জারি করেছেন। বিচারপতি ফাহমিদা কাদের এবং বিচারপতি মো. আসিফ হাসানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ জানতে চেয়েছেন- সংশোধিত এই বিধিমালা কেন বেআইনি, অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করা হবে না। শিক্ষা সচিব, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সচিব এবং পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যানকে দুই সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
অ্যানুয়েল প্রাইমারি স্কুল সেনসাস (এপিএসসি) ২০২২ অনুযায়ী, দেশে প্রায় ৬৫,৫৬৬টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। প্রায় সব বিদ্যালয়েই ধর্মীয় শিক্ষা মূল শিক্ষাক্রমের অংশ, যা শিশুদের নৈতিক ও সামাজিক মূল্যবোধ গঠনে ভূমিকা রাখে। প্রাথমিকে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে বাংলা, ইংরেজি ও গণিত পড়ানো হয়, আর তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণিতে ছয়টি বিষয়- বাংলা, ইংরেজি, গণিত, প্রাথমিক বিজ্ঞান, বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় এবং ধর্ম শিক্ষা পড়ানো হয়। প্রাথমিক পর্যায়ে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগ নেই; একই শিক্ষক সব বিষয় পড়ান। তবে বিজ্ঞান ও গণিতে দক্ষতা বাড়াতে কিছু পদ বিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রিধারীদের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে। সংগীত বিষয়ে কোনো আলাদা পাঠ্যপুস্তক বা পরীক্ষা নেই, তবে বছর শেষে শিক্ষকরা নির্দেশিকা অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করেন। সেখানে ১৩টি নির্দিষ্ট গান শেখানোর নির্দেশ রয়েছে। এই গানগুলো শেখানোর জন্য শিক্ষকদের সংগীতে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। কিন্তু যাদের আগে থেকে গান শেখা বা চর্চা নেই তাদের এই প্রশিক্ষণ কোনো কাজে আসে না।
আরও পড়ুন:
নভেম্বরে নারী ও শিশু নির্যাতন ৩৫৮টি
ধর্মীয় শিক্ষা শিশুদের নৈতিক মূল্যবোধ, শৃঙ্খলা ও সামাজিক আচরণ গঠনে ভূমিকা রাখে। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, শিশুকে সৃজনশীল ও মননশীল হতে হলে শুধু ধর্ম শিক্ষা দিয়ে তার পূর্ণ বিকাশ সম্ভব নয়। এমনিতে আমাদের খেলার মাঠ নেই, পাড়া-মহল্লাভিত্তিক সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডগুলো দিনে দিনে সংকুচিত হয়ে পড়েছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে সংগীত, নাটক, চিত্রকলা ও ক্রীড়া কার্যক্রমের ঘাটতিও বিদ্যমান- যা শিশুর আনন্দ, কৌতূহল ও আত্মপ্রকাশের সুযোগ সীমিত করছে। যেখানে সহকারী সংগীত এবং সহকারী শারীরিক শিক্ষক নিয়োগ শিশুদের জন্য সুবাতাস এনে দিত সেখানে সেই সম্ভাবনাকে বাতিল করে দিয়ে শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশ শুরুতেই রুদ্ধ করে দেওয়া হলো।
সংগীত শিক্ষা শিশুর আবেগ, মনোযোগ ও সামাজিক দক্ষতা বৃদ্ধিতে যে কার্যকর ভূমিকা রাখে- বিভিন্ন গবেষণায় তা ইতোমধ্যে উঠে এসেছে। বিশ্বের অনেক দেশে ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি সংগীত ও সাংস্কৃতিক শিক্ষাকে সমান গুরুত্ব দেওয়া হয়। ধর্মের সঙ্গে সংগীত সাংঘর্ষিক ধর্মভিত্তিক দলগুলো যে আপত্তি তুলছেন, খোদ মুসলিম দেশগুলোতে সংগীত শিক্ষা বাধ্যতামূলক অথবা চালু রয়েছে প্রাথমিক থেকেই। উদাহরণস্বরূপ আমরা দেখি- তুরস্কে সরকারি স্কুলে সংগীত, চারুকলা ও নাটক বাধ্যতামূলক; মালয়েশিয়ায় সংগীত সফ্ট স্কিল ও নৈতিক শিক্ষার অংশ এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতে স্কুলগুলোতে সংগীত শিক্ষা বাধ্যতামূলক। এ ছাড়া কিছুদিন আগে একটি সংবাদে প্রকাশ পায়- সৌদি আরবে ১৭ হাজার নারীকে সংগীত বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। এর আগে প্রথম ধাপে সরকারি ও বেসরকারি কিন্ডারগার্টেনের ১২ হাজারের বেশি নারী শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। সৌদি সরকার শিশুদের সংগীত ও শিল্পের সঙ্গে পরিচয় ঘটানো, স্থানীয় সংস্কৃতির বিকাশ এবং শিশুদের সৃজনশীল বিকাশের উদ্দেশ্যে এই কার্যক্রম চালু করেছে।
আমাদের পূর্ববর্তী প্রজন্ম হয়তো শিশুর মানসিক বিকাশকে তেমন গুরুত্ব দিয়ে দেখতেন না, তবু পাড়ায় পাড়ায় খেলার মাঠ, ক্লাবসহ অন্যান্য সাংস্কৃতিক সংগঠনের মাধ্যমে শিশুদের অংশগ্রহণ এবং মননশীল বিকাশের সুযোগ ছিল। এখন খেলার মাঠ হারিয়ে যাওয়া, ক্লাবগুলো রাজনৈতিক দলের কুক্ষিগত হয়ে যাওয়া, নিরপত্তাহীনতা ইত্যাদি মিলিয়ে শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ অনেকটা বাধাগ্রস্ত। সেখানে স্কুলগুলোতে খেলার মাঠ থাকা, শারীরিক শিক্ষার সুযোগ কিংবা সংগীত তাদের দৈহিক ও মানসিক বিকাশে অনেক ‘নাই’-এর ভেতর একটুখানি আশার আলো ছিল। শিশুরা শুধু বই নিয়ে বসে থাকবে না। তাদের পূর্ণাঙ্গ বিকাশে এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটিজ যেমন- খেলাধুলা, চিত্রকলা, সাংস্কৃতিক কার্যক্রম, বিতর্ক, শরীরচর্চা সবকিছুই বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
শিশুদের সৃজনশীল ও মানবিক বিকাশে সংগীত ও শারীরিক শিক্ষার গুরুত্ব অস্বীকার করার সুযোগ নেই। ইউনিসেফের গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে, সংগীত শিশুদের মানসিক বিকাশ, আত্মবিশ্বাস, সামাজিকীকরণ ও মানবিক চেতনা গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদ অনুযায়ী- প্রতিটি শিশুর নাচ, গান, খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিকচর্চায় অংশগ্রহণের অধিকার রয়েছে। এসব কার্যক্রম শিশুর মনের ভারসাম্য, সামাজিক দক্ষতা ও সহযোগিতার মানসিকতা তৈরি করে। শারীরিক শিক্ষার মাধ্যমে শিশুর দলগত চেতনা ও আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি পায়, আর সংগীত বা সংস্কৃতিকচর্চা তাদের মধ্যে সংবেদনশীলতা, বিনয় ও মানবিক মূল্যবোধ গড়ে তুলতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
সংস্কৃতি মানবজীবনের ধারাবাহিক প্রবাহ, যা বন্ধ হয়ে গেলে সমাজের সৃজনশীলতা ও মানবিকতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে প্রাথমিক পর্যায়ে সংগীত শিক্ষা বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত শুধু সাংস্কৃতিক পশ্চাৎপদতা নয়, এটি শিশুদের মৌলিক অধিকার এবং আন্তর্জাতিক আইন-নীতিরও পরিপন্থী। তাই সরকারের উচিত হবে সংগীত ও শারীরিক শিক্ষার জন্য শিক্ষক নিয়োগের সিদ্ধান্ত বাতিল না করে পুনর্বিবেচনা করা।
ফেরদৌস আরা রুমী : লেখক ও অধিকারকর্মী
মতামত লেখকের নিজস্ব