ফিরে দেখলেন অন্যের সংসারে স্ত্রী, মা-বাবা নেই

নরসিংদী প্রতিনিধি
১৫ নভেম্বর ২০২৫, ০৮:২৪
শেয়ার :
ফিরে দেখলেন অন্যের সংসারে স্ত্রী, মা-বাবা নেই

দালালের মাধ্যমে মালয়েশিয়া গিয়েছিলেন নরসিংদীর চরদিঘলদী ইউনিয়নের জিতরামপুর গ্রামের জাহাঙ্গীর আলম। দীর্ঘ ১৮ বছর নিখোঁজ থাকার পর তিনি অবশেষে ফিরে এসেছেন নিজের পরিবারে। বিষয়টি গতকাল শুক্রবার নিশ্চিত করেছেন নরসিংদী সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আসমা জাহান সরকার।

৬৬ বছরের জাহাঙ্গীর আলম পেশায় ছিলেন জেলে। জন্মেছেন দরিদ্র পরিবারে। মেঘনার বুকে নৌকা বেয়ে মাছ ধরে চলত সংসার। স্ত্রী ও পাঁচ সন্তানের ছোট্ট ঘরেই ছিল সব সুখ-দুঃখ। চার ছেলের জন্মের পরই জীবিকা টানাপড়েনে পড়ে ভাগ্য বদলের আশায় দালালের মাধ্যমে অবৈধ পথে মালয়েশিয়া যান তিনি। আর সেখান থেকেই শুরু হয় তার জীবনের অন্ধকার অধ্যায়।

প্রথম দিকে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। এরপর হঠাৎ সব বন্ধ হয়ে যায়। ধীরে ধীরে পরিবার ধরে নেয়- জাহাঙ্গীর আলম আর বেঁচে নেই। এভাবে দেড় যুগ কেটে যায় কোনো খোঁজখবর ছাড়া।

গত ২১ অক্টোবর মালয়েশিয়ার বাংলাদেশ হাইকমিশন থেকে নরসিংদী ইউএনওর কাছে ফোন আসে। জানানো হয়Ñ এক বাংলাদেশি ক্যাম্পে আটক আছেন। তার কাছে নেই কোনো কাগজপত্র। অসুস্থতার কারণে কথা বলতে পারেন না। তাই তার পরিচয় জানা যাচ্ছিল না।

হাইকমিশন তার ছবি সামাজিক মাধ্যমে দিয়ে পরিচয় জানতে চায়। দেশে বহু মানুষ নিজেদের স্বজন দাবি করে যোগাযোগ করলেও মিলছিল না কোনো প্রমাণ। এসময় নরসিংদী সদরের এক ব্যক্তি মন্তব্য করে জানান, লোকটি চরদিঘলদীর বাসিন্দা হতে পারেন। এরপর স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সহায়তায় খুঁজে পাওয়া যায় জাহাঙ্গীর আলমের পরিবারকে। মিলিয়ে দেখা হয় মুখ; পরিচয় নিশ্চিত হয়।

পরিবার অত্যন্ত অসচ্ছল। বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে ইউএনও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র তৈরি করে দ্রুত হাইকমিশনে পাঠান। সরকারি খরচে তাকে দেশে আনার অনুরোধ জানান।

অবশেষে ৭ নভেম্বর জাহাঙ্গীর আলম দেশে ফেরেন। পরিবারের সদস্যরা তাকে বিমানবন্দর থেকে বাড়ি নিয়ে যান; কিন্তু ফিরেও যেন নিজের আগের জীবনে আর ফিরতে পারেননি তিনি। মালয়েশিয়ায় অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে আটক হয়ে বছরের পর বছর বন্দিদশা ও অসুস্থতায় হারিয়েছেন বাকশক্তি। বাংলাও স্পষ্ট বলতে পারেন না। শুধু চুপচাপ তাকিয়ে থাকেন, কখনও ফুঁপিয়ে কাঁদেন।

এই ১৮ বছরে হারিয়েছেন বাবা-মাকে। অপেক্ষায় থাকা স্ত্রী, বহু বছর পর নতুন পরিবারে ঠাঁই নিয়েছেন। জাহাঙ্গীর আলমের হারানো দেড় যুগ যেন কোনো সিনেমার গল্পও ছাপিয়ে যায়।

গত বৃহস্পতিবার উপজেলা প্রশাসন জাহাঙ্গীর আলমকে ২০ হাজার টাকা নগদ সহায়তা ও প্রয়োজনীয় উপহারসামগ্রী দিয়েছে। সমাজসেবা অধিদপ্তরের মাধ্যমে তাকে প্রতিবন্ধী ভাতা দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। বর্তমানে তিনি নরসিংদী জেলা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

ভুক্তভোগীর বড় ছেলে আমান উল্লাহ বলেন, ‘বাবাকে ফিরে পেয়েছিÑ এটাই আমাদের সবচেয়ে বড় পাওয়া, আমরা সবাই খুশি।’

চরদিঘলদী ইউনিয়ন পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান সেলিনা আক্তার বলেন, ‘দালালের খপ্পরে কেউ যেন আর না পড়ে, সেই সচেতনতা আমরা সবাই মিলে বাড়াব।’

নরসিংদী সদর উপজেলার ইউএনও আসমা জাহান সরকার বলেন, ‘একবার ভুল সিদ্ধান্ত পরিবারের সারাজীবনের কান্না হয়ে দাঁড়াতে পারে। অবৈধ পথে বিদেশে যাওয়ার চেষ্টা করবেন না।’