পার্বত্য চট্টগ্রামে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও বিচারহীনতার সংস্কৃতি নিয়ে আলোচনা সভা

অনলাইন ডেস্ক
১৪ নভেম্বর ২০২৫, ১২:৫০
শেয়ার :
পার্বত্য চট্টগ্রামে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও বিচারহীনতার সংস্কৃতি নিয়ে আলোচনা সভা

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনের উদ্যোগে ‘পার্বত্য চট্টগ্রামে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও বিচারহীনতার সংস্কৃতি’ শীর্ষক এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। বৃহস্পতিবার (১৩ নভেম্বর) ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির শফিকুল কবির মিলনায়তনে এ সভা হয়।

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনের সদস্য দীপায়ন খীসার সঞ্চালনায় এবং যুগ্ম সমন্বয়কারী জাকির হোসেনের সভাপতিত্বে এটি অনুষ্ঠিত হয়। 

এ সময় উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনের যুগ্ম সমন্বয়কারী অধ্যাপক খায়রুল ইসলাম চৌধুরী, নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রধান ও নারীপক্ষের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য শিরিন হক, টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান, এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা এবং বিশিষ্ট কবি ও সাংবাদিক সোহরাব হাসান প্রমুখ। 

আলোচনা সভায় মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনের যুগ্ম সমন্বয়কারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. খায়রুল ইসলাম চৌধুরী। 

মূল বক্তব্য উপস্থাপন করতে গিয়ে তিনি বলেন, জনসংহতি সমিতির প্রতিবেদন অনুযায়ী ১৯৭৬-৯৭ পর্যন্ত সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসীদের ওপর কমপক্ষে ১৬টি গণহত্যা পরিচালিত হয়। এসব গণহত্যায় দুই দশকে কমপক্ষে ১ লাখ লোক ভারতের পার্শ্ববর্তী রাজ্য ত্রিপুরায় শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয় এবং তাদের বহুলাংশেই নিজেদের বাস্তুভিটা হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছে। 

তিনি আরও বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (১৯৯৮-২০১১) ও কাপেং ফাউন্ডেশন (২০১২-২০২৪) এর তথ্যানুসারে বিগত ২৭ বছরে রাজনৈতিক ও নাগরিক অধিকার সংক্রান্ত মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়েছেন সর্বমোট ৯ হাজার ১৬২ জন। এসবের মধ্যে নারী ও শিশুর ওপর সহিসংসতা সংক্রান্ত মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ৫১৩টি, ২ হাজার ৮১৪টি আদিবাসী বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও মূল্যবান জিনিসপত্র তছনছ করা হয়েছে। ৩ হাজার ৬২২ পরিবারকে হুমকি দেওয়া হয়েছে। ভূমিদস্যুদের হামলায় ৬১৬ পরিবারের জীবনযাত্রা বিপন্ন হয়েছে, ৫ হাজার ৯৬৬ একর ভূমি ভূমিদস্যুরা জবরদখল করেছে। এ ছাড়া ও ক্যাম্প স্থাপনের নামে ৩১৬ একর ভূমি এবং ২ হাজার ২০৫ একর জায়গা দখলের জন্য ভূয়া দলিল তৈরি করা হয়েছে।

ঘটনাগুলোর কোনোটির সুষ্ঠু ও বস্তুনিস্তু বিচার করা হয়নি উল্লেখ করে অধ্যাপক ড. খায়রুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘এ ধরনের ঘটনাগুলো বারবার সংগঠিত হয়েছে এবং হচ্ছে। এই ধরনের কাঠামোগত বিচারহীনতা দূর করতে হলে শুধু নীতি নয়; বরং আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার প্রয়োজন। পার্বত্য চুক্তির ধারাগুলো পূর্ণ বাস্তবায়ন, ভূমি কমিশনের পুনঃসক্রিয়করণ, ও একটি স্বাধীন মানবাধিকার তদন্ত কমিশন গঠন এখন সময়ের দাবি।’

এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক অধিকারসহ মৌলিক মানবাধিকারকে অস্বীকার করার যে খেলা পাকিস্থান আমলে শাসকরা শুরু করেছিলেন সেটি মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীকালীন সময়েও চালিয়ে নেওয়া হয়েছে। তদুপরি ওই অঞ্চলের গণমানুষের অধিকার সুরক্ষার জন্য যে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি করা হয়েছিল সে চুক্তিটিরও বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না। 

তিনি বলেন, মানবাধিকার সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক আইনগুলো যতদিন না রাষ্ট্র স্বীকৃতি দিচ্ছে ততদিন পর্যন্ত গণঅভ্যুত্থানের চেতনা এবং আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন হবে না। তিনি অন্তর্বতীকালীন সরকারকে বিগত ৫০ বছরে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের ওপর সংগঠিত হত্যা, ভূমি বেদখল, সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনাগুলো তদন্তের জন্য একটি আন্তর্জাতিক কমিশন গঠনের মাধ্যমে তদন্ত করে ওই ঘটনাগুলোর সুষ্ঠু বিচারের আহ্বান জানান। 

বিশিষ্ট কবি ও সাংবাদিক সোহরাব হাসান বলেন, রাষ্ট্রের সব মানুষের মানবাধিকার রক্ষার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। এ দায়িত্ব যদি রাষ্ট্র সঠিকভাবে পালন করতো তাহলে আজকে আলাদা করে পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষদের নিয়ে আলোচনা করতে হতো না। তিনি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে দেশের গণমানুষের অধিকার সংরক্ষণ করার জন্য রাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান জানান।  

নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রধান এবং নারীপক্ষের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য শিরীন হক বলেন, দেশের কোনো জনগোষ্ঠীকে ‘সংখ্যালঘু’ শব্দটি চাপিয়ে দেওয়ার মানে সেই জনগোষ্ঠীর মানুষের অধিকার, মানবিক মর্যাদাকে অপমান করা, ছোট করা। অথচ সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রের সব মানুষের সমান অধিকার ও মানবিক মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকার অধিকার রয়েছে। তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামে সব গুম, হত্যা, অপহরণ, ধর্ষণসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলোর সঠিক ডকুমেন্টেশনের জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানান। 

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘এদেশের কোনো সরকারের এখতিয়ার নাই পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী মানুষের অধিকার সংরক্ষণ করা। সামরিকীকরণ যারা করেছেন সেই সেনাবাহিনী-ই একমাত্র শক্তি যারা চাইলেই পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী মানুষদের অধিকার এবং শান্তি আনতে পারেন।’ 

তিনি বলেন, ‘সেনাবাহিনীর যদি সদিচ্ছা থাকে তবে সরকারের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে না, সেনাবাহিনী-ই পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নে সহযোগিতা প্রদান করে সেখানে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারে।’ 

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনের যুগ্ম-সমন্বয়কারী জাকির হোসেন বলেন, মানবাধিকার বিষয়ক যে আন্তর্জাতিক চুক্তিগুলোতে বাংলাদেশ রাষ্ট্র অনুস্বাক্ষর করেছে সেগুলোর যে হালনাগাদ করা হয় সেগুলোতে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মতামত নিতে হবে। এ ব্যাপারে আরও অধিক আকারে আলাপ-আলোচনা করতে হবে। তিনি উপস্থিত সবার কাছে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলনে আরও অধিকতরভাবে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।  

আমাদের সময়/এএস