অ্যামাজনের কোলে আলো আর গর্জনের মেলবন্ধন
রাতে অ্যামাজনের আকাশজুড়ে ছড়িয়ে পড়া আলোর রেখা আর দিনে গর্জন তোলা মানুষের সেøাগানে মুখর হয়ে উঠেছে ব্রাজিলের বেলেম শহর; যেখানে চলছে জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলন, কপ-৩০। বন, বৃষ্টি, আদিবাসী অধিকার, অর্থায়ন আর বাস্তবায়নের দাবিতে চতুর্থ দিনও পরিণত হয়েছে মানবতার এক সীমানা-সংঘর্ষে। অ্যামাজনের হৃদয়ে দাঁড়িয়ে যখন বিশ্বনেতারা জলবায়ু ন্যায়ের নতুন প্রতিশ্রুতি খুঁজছেন, তখন একই মঞ্চে গর্জে উঠেছে আদিবাসী কণ্ঠÑ ‘আমাদের বন বিক্রি হবে না’, ‘আমাদের ভূমি ফেরত দাও’, ‘আমাদের ছাড়া সিদ্ধান্ত নয়।’
এই বৈশ্বিক আওয়াজের মধ্যে বাংলাদেশের প্রতিধ্বনিও স্পষ্ট। দক্ষিণ এশিয়ার উপকূলীয় এই দেশ বিশ্বকে আবারও স্মরণ করিয়ে দিয়েছে, অভিযোজন অর্থায়ন ও ক্ষতি-ক্ষতিপূরণ এখন আর বিলাসী প্রতিশ্রুতি নয়, বরং টিকে থাকার প্রশ্ন। বাংলাদেশের প্রতিনিধি দল জানিয়েছে, জলবায়ু অর্থায়নের অধিকাংশ এখনও মিটিগেশনে সীমিত, অথচ অভিযোজনের অর্থায়ন অত্যন্ত কম, যা নাজুক দেশগুলোর জন্য ভয়াবহ। তারা দাবি তুলেছে, অনুদানভিত্তিক অর্থায়ন বাড়াতে হবে, যাতে উপকূলীয় জনগণকে রক্ষা করা যায়।
তবে সম্মেলনের আড়ালে রয়েছে হতাশার ছায়াও বেলেমে বাংলাদেশের প্যাভিলিয়ন এখনও কার্যকরভাবে খোলা হয়নি, যার ফলে আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীর মঞ্চে দেশটির উপস্থিতি দুর্বল দেখাচ্ছে। তবুও দেশের পক্ষ থেকে স্পষ্ট বলা হয়েছে, ‘আমরা কথার নয়, বাস্তবায়নের ফল চাই। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের আলোচনায় যখন বন সংরক্ষণ, তথ্যের সততা ও আদিবাসী অধিকার উঠে আসছে, তখন বাংলাদেশ মনে করিয়ে দিচ্ছে : জলবায়ু ন্যায় মানে শুধু কার্বন হ্রাস নয়, বরং মানুষের জীবনের নিশ্চয়তা।’
সম্মেলনে তৃতীয় দিনে বেলেমের প্রধান কনফারেন্স হলে শুরু হয় স্বাস্থ্য ও মানবসম্পদবিষয়ক সেশন। ইউএনএফসিসির নেতৃত্ব ঘোষণা করে ‘বেলেম হেলথ অ্যাকশন প্ল্যান’, যা বৈশ্বিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত থেকে সুরক্ষিত রাখতে একটি রূপরেখা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। পরিকল্পনার মূল লক্ষ্যÑ উষ্ণায়ন, বন্যা ও খরার মতো জলবায়ু-সম্পর্কিত দুর্যোগে স্বাস্থ্য
আরও পড়ুন:
রাজধানীতে কিশোরীসহ ২ জনের মরদেহ উদ্ধার
অবকাঠামোকে আরও শক্তিশালী করা। একই দিনে চালু হয় ‘গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ অন জবস অ্যান্ড স্কিলস ফর দ্য নিউ ইকোনমি’Ñ যেখানে আগামী এক দশকে ৬৫০ মিলিয়ন নতুন কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়, যা জলবায়ু-সচেতন অর্থনীতির দিকে বিশ্বকে ধাবিত করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
আলোচনার সবচেয়ে উত্তেজনাপূর্ণ অধ্যায়টি আসে রাতের বেলায়। স্থানীয় আদিবাসী জনগোষ্ঠী ও আন্দোলনকারীরা সম্মেলনের মূল প্রাঙ্গণে প্রবেশের চেষ্টা করে, তাদের সেøাগানÑ ‘আমরা টাকা খাইনি, আমরা জীবন চাই।’ নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে কিছু সময়ের জন্য বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়। এই ঘটনাকে বিশ্লেষকরা দেখছেন বাস্তবতার তীব্র সংকেত হিসেবেÑ বিশ্ব নেতারা এখন আর শুধু বক্তব্য দিয়ে নিজেদের দায় শেষ করতে পারবেন না, বাস্তবায়নের সময় এসেছে।
চতুর্থ দিনের আলোচনায় প্রাধান্য পায় তথ্যের সততা ও ভুয়া তথ্য প্রতিরোধের বিষয়টি। ‘ডিক্লারেশন অন ইনফরমেশন ইন্টেগ্রিটি’ নামে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা গ্রহণ করা হয়, যেখানে অংশ নেয় বহু দেশ, গণমাধ্যম ও আন্তর্জাতিক সংগঠন। এই ঘোষণায় বলা হয়, জলবায়ু সংকট নিয়ে ভুল তথ্য ছড়ানো এখন বৈশ্বিক বিপদের সমান, কারণ এটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়াকে দুর্বল করে এবং জনগণের সচেতনতা নষ্ট করে। এই প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোর তাঁর প্রেজেন্টেশনে বলেন, ‘আমরা শুধু পৃথিবীর উষ্ণতা নয়, সত্যের তাপমাত্রাও হারাচ্ছি।’ তাঁর প্রদর্শিত সøাইডে দেখা যায়, কীভাবে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের পাশাপাশি ভুল তথ্যের বিস্তার জলবায়ু নীতিকে বিপথে নিচ্ছে।
আরও পড়ুন:
নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে এলডিপি?
বাংলাদেশের অবস্থান এখানে তুলনামূলক নীরব হলেও অর্থবহ। দেশের প্রতিনিধি দল জানিয়েছে, তারা দ্রুত গ্রান্ট-ভিত্তিক সহায়তার প্রত্যাশা করছে, যাতে অভিযোজন প্রকল্পগুলো গতি পায়। কপ-৩০ মঞ্চে বাংলাদেশের দাবি স্পষ্ট, অর্থায়নের বণ্টনে বৈষম্য দূর করতে হবে। বর্তমানে বৈশ্বিক জলবায়ু তহবিলের বড় অংশ নির্গমন হ্রাসের দিকে যাচ্ছে, অথচ অভিযোজন বা ক্ষয়ক্ষতিপূরণের প্রকল্পগুলো বঞ্চিত। বাংলাদেশের মতে, ন্যায্য অর্থায়ন ও প্রযুক্তি স্থানান্তর ছাড়া বৈশ্বিক প্রতিশ্রুতি পূরণ অসম্ভব। চতুর্থ দিনের আলোচনায় আরও একটি বার্তা জোরালোভাবে উঠে এসেছেÑ বন ও প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্র শুধু পরিবেশ নয়, এটি মানুষের পরিচয়, সংস্কৃতি ও অস্তিত্বের অংশ। অ্যামাজনের আদিবাসী নেতারা বলছেন, ‘আমরা বন রক্ষা করি, তাই তোমরা বাঁচো।’ তাঁদের এই বার্তা যেন বাংলাদেশসহ বিশ্বজুড়ে নাজুক দেশগুলোর কণ্ঠস্বর।
সম্মেলনে সিদ্ধান্ত নয়, এখন বাস্তবায়নই প্রধান যুদ্ধক্ষেত্র। উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থায়ন ও অংশগ্রহণ এখনও বড় চ্যালেঞ্জ। তথ্যের সত্যতা এখন সিদ্ধান্তের পূর্বশর্তে পরিণত হয়েছে। এবং আদিবাসী ও স্থানীয় জনগণের ভূমিকা, শতাংশের ভেতর হলেও, আলোচনার কেন্দ্রে এসেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, কপ-৩০ এখন এক মোড়ে দাঁড়িয়েÑ যেখানে প্রতিশ্রুতির চেয়ে বাস্তব পদক্ষেপ বেশি জরুরি। জলবায়ু তহবিল, বন সংরক্ষণ, তথ্যের সত্যতা এবং অভিযোজনমূলক উন্নয়নÑ এই চারটি স্তম্ভই আগামী দশকের নীতি নির্ধারণ করবে।
বাংলাদেশের দৃষ্টিকোণ থেকে এই শিক্ষা আরও গভীর। কারণ বাংলাদেশ ইতোমধ্যে উপকূলীয় ভাঙন, ঘূর্ণিঝড়, লবণাক্ততা ও নদী-বন্যার বিরুদ্ধে লড়ছে। রেসিলিয়েন্সের পাশাপাশি এখন দরকার সমতা ও টেকসই অর্থায়ন। বেলেমে বাংলাদেশের সীমিত উপস্থিতি হয়তো কিছুটা হতাশা তৈরি করেছে, কিন্তু বার্তা একটাইÑ আমরা বাদ পড়তে চাই না, আমরা নেতৃত্ব দিতে চাই।
স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার আমাদের সময়কে বলেন, বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনের বেলেম অধ্যায় তাই নতুন এক চেতনার সূচনাÑ যেখানে গাছ, মানুষ ও রাষ্ট্রের মধ্যে লড়াই শুধু অস্তিত্বের নয়, ভবিষ্যতেরও। কপ ৩০-এর আলোচনায় এটাই আজকের মূল বার্তা : সময় এসেছে প্রতিশ্রুতিকে কাজে পরিণত করার, নইলে বাঁচবে না পৃথিবীর এই সবুজ ফুসফুস।