রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিক্রিয়া

নিজস্ব প্রতিবেদক
১৪ নভেম্বর ২০২৫, ০৭:৪৪
শেয়ার :
রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিক্রিয়া

জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে রাজনৈতিক উত্তাপের মধ্যে জাতির উদ্দেশে গতকাল বৃহস্পতিবার দেওয়া ভাষণে সব পক্ষের মতামতকে আমলে নিয়ে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তাঁর ভাষণের পর বর্তমানে সক্রিয় রাজনৈতিক দলগুলো মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। কোনো দল বলছে, গত ১৭ অক্টোবর যে জুলাই সনদ স্বাক্ষরিত হয়েছে, তা লঙ্ঘন করেছেন প্রধান উপদেষ্টা। আবার কোনো দল বলছে, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন যে সুপারিশ দিয়েছিল সেখান থেকে সরে গেছেন প্রধান উপদেষ্টা। কিছু দল প্রধান উপদেষ্টার ভাষণকে স্বাগত জানিয়ে বলছে, এটি রাজনৈতিক অঙ্গনের অচলায়তন দূর করার বার্তা। 

গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আমরা সব বিষয় বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনই গণভোটের আয়োজন করা হবে। এতে সংস্কারের লক্ষ্য কোনোভাবে বাধাগ্রস্ত হবে না।

একই দিন গণভোট ও সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেওয়ায় প্রধান উপদেষ্টাকে ধন্যবাদ জানিয়েছে বিএনপি। গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে স্থায়ী কমিটির টানা তিন ঘণ্টা বৈঠকের পর দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে এ কথা জানান। তিনি বলেন, আজ জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঘোষণা পূনর্ব্যক্ত করায় এবং সংসদ নির্বাচনের দিনই গণভোটের ঘোষণা দেওয়ায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বিএনপির স্থায়ী কমিটির সভায় তাকে (প্রধান উপদেষ্টা) ধন্যবাদ জানানো হয়। 

গত ১৭ অক্টোবর ঐকমত্যের ভিত্তিতে স্বাক্ষরিত জুলাই জাতীয় সনদের ওপর জনগণের সম্মতি গ্রহনের জন্য গণভোট অনুষ্ঠানের এবং যথা শিগগিরই জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের জন্য সরকার ও নির্বাচন কমিশনের প্রতি আহ্বান জানানো হয় ব্রিফিংয়ে।

রাত ৭টায় গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠক হয়। লন্ডন থেকে তারেক রহমান ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে সভাপতিত্ব করেন। সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সালাহ উদ্দিন আহমেদ, সেলিমা রহমান, হাফিজ উদ্দিন আহমেদ ও এজেডএম জাহিদ হোসেন উপস্থিত ছিলেন।

এর আগে, প্রধান উপদেষ্টার ভাষণের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, প্রধান উপদেষ্টা যে জুলাই জাতীয় সনদে স্বাক্ষর করেছেন, এই ভাষণের মাধ্যমে তিনি তা লঙ্ঘন করেছেন। তিনি রাজনৈতিক দলসমূহ স্বাক্ষরিত জুলাই সনদকে মূল দলিল হিসেবে ধরে নিয়েছেন। অথচ সে মূল দলিল থেকে বহু দূরে সরে গিয়েছেন। 

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের আমাদের সময়কে বলেন, গণভোট একই দিন করার ঘোষণা দিয়ে বিএনপির পক্ষে রায় দেওয়া হয়েছে। যে চারটি প্রশ্ন রাখা হয়েছে, এটা স্বাক্ষরিত জুলাই সনদের মূল স্পিরিট থেকে সরে গেছে। আমরা আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া কালকে জানাব।  

অন্যদিকে জামায়াতের পক্ষ থেকে দলটির সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার এক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে খুবই পরিষ্কার করে বলতে চাই যে, প্রধান উপদেষ্টার একই দিনে গণভোট এবং জাতীয় নির্বাচনের ঘোষণায় জনগণের আকাক্সক্ষা পূরণ হয়নি। তিনি আরও বলেন, জনগণের যে অভিপ্রায় ছিল জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি এবং জাতীয় নির্বাচনের আগে কি কি বিষয়ে সংস্কার হলো, নতুন প্রস্তাবিত জুলাই সনদ ভিত্তিতে সংবিধানের কি কি সংশোধনী প্রস্তাব যাচ্ছে, যে ৪৮টি প্রস্তাবে আমরা সর্বসম্মত হয়েছি, সাংবিধানিক সংস্কারসহ অন্যান্য সংস্কারÑ এগুলো জাতীয় নির্বাচনের পূর্বে জাতিকে জানাতে হবে। ভোটাররা জানবেন, তার উপরে মাইন্ডসেট হবে, তারও পরে এর ওপর হ্যাঁ-না মতামত দেবে।

অন্যদিকে বিএনপির মিত্র ১২ দলীয় জোটের নেতারা প্রধান উপদেষ্টার ভাষণকে স্বাগত জানিয়েছেন। জোটের নেতাদের যৌথ স্বাক্ষরিত বিবৃতিতে তাঁরা বলেন, সংসদ নির্বাচনের দিন গণভোট আয়োজন করা হবে বলে যে ঘোষণা সরকারপ্রধান দিয়েছেন, তা অত্যন্ত সময়োপযোগী ও বাস্তবধর্মী পদক্ষেপ। দেশের সাধারণ জনগণ প্রধান উপদেষ্টার এ ঘোষণায় উৎফুল্ল হয়েছেন। এর মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে গণভোট এবং জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে যে সংশয় দেখা দিয়েছিল তা কেটে গেছে। আমরা বিশ্বাস করি, দেশের সব রাজনৈতিক দল প্রধান উপদেষ্টার এই ঘোষণার পর আর কোনো নতুন দাবি উত্থাপন না করে পুরোপুরি নির্বাচনী কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত হবেন। তাঁরা বলেন, জাতীয় নির্বাচনের পাশাপাশি একই দিন গণভোট করার সিদ্ধান্ত একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। 

বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন ১২ দলীয় জোটপ্রধান ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান মোস্তফা জালাল হায়দার, জোটের মুখপাত্র ও বাংলাদেশ এলডিপির চেয়ারম্যান শাহাদাত হোসেন সেলিম, ১২ দলীয় জোটের সমন্বয়ক ও বাংলাদেশ জাতীয় দলের চেয়ারম্যান সৈয়দ এহসানুল হুদা প্রমুখ।

বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক এক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে সংকট উত্তরণের প্রচেষ্টা থাকলেও তা গুরুতর সাংবিধানিক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। সংসদ নির্বাচনের দিন গণভোট অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত ইতিবাচক হলেও গণভোটের লক্ষ্য অর্জিত হবে কিনা সন্দেহ রয়েছে। তিনি বলেন, আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচনের দিন গণভোট অনুষ্ঠানের পদক্ষেপকে স্বাগত জানালেও অন্তর্বর্তী সরকার সংবিধান সংশোধন নিয়ে কোনো সাংবিধানিক আদেশ দিতে পারে কি না, এ নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। তিনি বলেন, বস্তুতঃ রাষ্ট্রপতির নামে এ ধরনের আদেশ অন্তর্বর্তী সরকারের ম্যান্ডেট ও এখতিয়ারের বাইরে। এ ছাড়া যে চারটি ভাগে ভাগ করে গণভোটের বিষয়াবলি উল্লেখ করা হয়েছে, কেবল একটি উত্তরে হ্যাঁ বা না বলা যথেষ্ট জটিল প্রক্রিয়া। 

অন্যদিকে মতভিন্নতা সত্ত্বেও প্রধান উপদেষ্টার সিদ্ধান্ত ও ভাষণকে স্বাগত জানিয়েছে এবি পার্টি। এক বিবৃতিতে এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু ও সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ বলেন, আমরা জাতির বৃহত্তর স্বার্থে প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যকে মেনে নেওয়ার পক্ষে। আমাদের যার যা মত থাকুক না কেন, সরকার বা ড. মুহাম্মদ ইউনূস যেহেতু সবদিক বিবেচনা করে একইদিনে গণভোট ও জাতীয় নির্বাচন, উচ্চকক্ষে সংখ্যানুপাতিক ভোটের হিসেবে আসন নির্ধারণ এবং গণভোটে একমত ও ভিন্নমতকে অন্তর্ভুক্ত করে ব?্যালট তৈরিসহ চূড়ান্ত কিছু নির্দেশনা দিয়েছেন। আমরা মনে করি, এটা এখন একটি অপেক্ষাকৃত গ্রহণযোগ্য সমাধান। সার্বিক বিচারে এ ঘোষণাকে আমরা ইতিবাচক হিসেবে দেখি।

এদিকে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস প্রধান উপদেষ্টার ভাষণের প্রতিক্রিয়ায় বলেছে, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের স্বীকৃতি ঝুঁকিতে ফেলেছে সরকার। সংগঠনটির আমির আল্লামা মামুনুল হক বলেন, জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট একসঙ্গে করার ঘোষণা দিয়ে এবং একই প্রশ্নের মধ্যে আলাদা আলাদা চারটি অংশ রেখে গণভোটকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলা হয়েছে। এর মাধ্যমে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সাংবিধানিক স্বীকৃতিও ঝুঁকিতে পড়েছে।

তিনি বলেন, দলীয় প্রতীকে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে গণভোট একত্রে অনুষ্ঠিত হলে জনগণের মনোযোগ বিভ্রান্ত হবে। গণভোটের গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলো মানুষ যথাযথভাবে বুঝে মতপ্রকাশ করতে পারবে না। এতে গণভোটের স্বচ্ছতা ও গ্রহণযোগ্যতা বিঘ্নিত হবে। বিবৃতিতে তিনি আরও বলেন, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা সরকার যদি জুলাই সনদের বাস্তবায়ন ও স্বতন্ত্র গণভোটের গণদাবি পূরণ না করে তবে সেটি হবে আমাদের জন্য হতাশাজনক এবং জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের আদর্শ ও স্বীকৃতিকে ঝুঁকিতে ফেলার দুঃখজনক পদক্ষেপ।

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম বলেন, একই দিনে গণভোট ও জাতীয় নির্বাচন জাতির সঙ্গে তামাশার শামিল। জুলাই অভ্যুত্থান-পরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে এমন ঘোষণা দেশবাসীর প্রত্যাশা ছিল না।

জুলাই সনদ নিয়ে গণভোটের আয়োজন অপ্রয়োজনীয় বলে মন্তব্য করেছে সনদে সই না করা বাম দলগুলো। তারা বলছে, এই যে রাষ্ট্রপতি স্বাক্ষর করলেন, আদেশটা জারি করলেন, এটা কোন ক্ষমতাবলে? এই অধিকার তার নাই।

বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশীদ ফিরোজ বলেন, বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী এ ধরনের কোনো আদেশ জারি করা যাবে না। অধ্যাদেশ জারি করতে পারে। এটা বিদ্যমান সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

সিপিবির সাবেক সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, এখন গণভোট অপ্রয়োজনীয়। প্রয়োজনে গণভোট হবে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর। উচ্চকক্ষ হবে গরিবের হাতি পোষা। অপ্রয়োজনীয়।

গণভোট ও জাতীয় নির্বাচন জাতির সঙ্গে তামাশার শামিল মন্তব্য করেছেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম পীর সাহেব চরমোনাই। তিনি বলেন, একইদিনে গণভোট ও জাতীয় নির্বাচন জাতির সঙ্গে তামাশাামিল। জুলাই অভ্যুত্থান পরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে এমন ঘোষণা দেশবাসীর প্রত্যাশা ছিল না।