যে হুমায়ূন আহমেদ আমাদের
বাঙালিজীবনে নিজের বলতে যা কিছু আছে, তার মধ্যে অন্যতম বড় সম্পদ হুমায়ূন আহমেদ। কেন হুমায়ূন আহমেদ বড় সম্পদ, তা যদি বুঝিয়ে বলতে হয়, তাহলে এমন লেখা আরও শখানেক লিখতে হবে। সহজ কথায় যদি বলতে হয় তাহলে বলা যায়, আমি-আপনি যা বলতে চেয়েছি বা চাই, সেটা হুমায়ূন আহমেদ বলে গেছেন। আমার-আপনার যে আনন্দ, বেদনা, যন্ত্রণার গল্প- সেসব হুমায়ূন আহমেদ লিখে গেছেন।
প্রযুক্তির চরম উৎকর্ষের এই সময়ে আজ আমরা যে কোনো ঘটনা ক্যামেরা অথবা ফোনের ক্যামেরায় বন্দি করে রাখতে পারি। ধরে রাখা মুহূর্তের সেসব গল্প আজ থেকে পঁচিশ, পঞ্চাশ বছর পর হয়তো উপভোগও করতে পারব। কিন্তু বাঙালির জীবনে আশি, নব্বই দশকের যে আনন্দ-বেদনার গল্প, যা কোনো ক্যামেরায় বন্দি নেই, কোনো মেমোরিচিপে জমা নেই, তা পাওয়ার উপায় কী? দ্বিধাহীনভাবে বলা যায়, সেসব পাওয়ার একমাত্র উপায় হুমায়ূন আহমেদের বই। হুমায়ূন আহমেদের লেখা। তার নির্মোহ বর্ণনায় সেই সময়ের পুরো বাঙালি সমাজই লিপিবদ্ধ আছে। সবচেয়ে বেশি আছে মধ্যবিত্ত সমাজ। যে সমাজ তিনি তার চোখে নিবিড়ভাবে দেখেছেন। যে সমাজের ভেতরে নিজেকে রেখেও ব্যবচ্ছেদ করে গেছেন আমৃত্য। হুমায়ূন আহমেদ তার দেখা এসব রচনা কীভাবে আমাদের পড়িয়েছেন? তার অনন্য বর্ণনাশৈলী দিয়ে। এত সাবলীল এবং ঝরঝরে বর্ণনাশৈলী তা নিয়ে বলার কিছু নেই। যে কারণে হুমায়ূন এই জাতিকে আটকে রেখে গেছেন তিন যুগেরও বেশি সময়। যে কোনো ঘটনার বর্ণনা পাঠককে বুঁদ করে রাখতে পারে চুম্বকের মতো। নিজের অস্বাভাবিক গল্প, ইতিহাসও তিনি লিখেছেন দ্বিধাহীনভাবে।
যেমন শৈশবের বিব্রতকর ঘটনার উল্লেখ করি, যা তিনি বর্ণনা করেছেন দারুণ বিচিত্রতায়। ‘স্কুলের প্রথম দিন নিয়ে তিনি লিখেন, আমার প্রথম স্কুলে যাওয়া উপলক্ষে একটা নতুন খাকি প্যান্ট কিনে দেওয়া হলো। সেই প্যান্টের কোনো জিপার নেই, সারাক্ষণ হাঁ হয়ে থাকে। অবশ্য তা নিয়ে খুব একটা উদ্বিগ্ন হলাম না। নতুন প্যান্ট পরছি, এই আনন্দেই আমি আত্মহারা। মেজো চাচা আমাকে কিশোরীমোহন পাঠশালায় ভর্তি করিয়ে দিয়ে এলেন এবং হেডমাস্টার সাহেবকে বললেন, চোখে চোখে রাখতে হবে। বড়ই দুষ্ট। আমি অতি সুবোধ বালকের মতো ক্লাসে গিয়ে বসলাম। মেঝেতে পাটি পাতা। সেই পাটির ওপর বসে পড়াশোনা। মেয়েরা বসে প্রথমদিকে, পেছনে ছেলেরা। আমি খানিকক্ষণ বিচার-বিবেচনা করে সবচেয়ে রূপবতী বালিকার পাশে ঠেলেঠুলে জায়গা করে বসে পড়লাম। রূপবতী বালিকা অত্যন্ত হৃদয়হীন ভঙ্গিতে সিলেটি ভাষায় বলল, এই তোর প্যান্টের ভেতরের সবকিছু দেখা যায়। ক্লাসের সব ক’টা ছেলেমেয়ে একসঙ্গে হেসে উঠল। সবচেয়ে উচ্চস্বরে যে ছেলেটি হেসেছে, তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম। হাতের কনুইয়ের প্রবল আঘাতে রক্তারক্তি ঘটে গেল। দেখা গেল ছেলেটির সামনের একটি দাঁত ভেঙে গেছে। হেডমাস্টার সাহেব আমাকে কান ধরে সারাক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার নির্দেশ দিলেন। ছাত্রছাত্রীদের উপদেশ দিলেন, এ মহাগুণ্ডা, তোমরা সাবধানে থাকবে। খুব সাবধান। পুলিশের ছেলে গুণ্ডা হওয়াই স্বাভাবিক। ক্লাস ওয়ান বারোটার মধ্যে ছুটি হয়ে যায়। এ দুই ঘণ্টা আমি কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকলাম। আমার সময়টা যে খুব খারাপ কাটল তা নয়। স্কুলের পাশেই আনসার ট্রেনিং ক্যাম্প। তাদের ট্রেনিং দেওয়া হচ্ছে। লেফট রাইট। লেফট রাইট। দেখতে বড়ই ভালো লাগছে। মনে মনে ঠিক করে ফেললাম বড় হয়ে আনসার হবো।’
হুমায়ূন আহমেদের লেখায় আরেক বড় গুণ উপমা। তিনি তার উপমায় ততটা সাহিত্যের আশ্রয় নেন না, যতটা নেন তথ্য এবং হিউমারের। তার উপমা যেন চোখে ভাসা কোনো দৃশ্য। তিনি অযাচিত কিছু লিখতে পারেন না। যেহেতু তার লেখার বিষয়-আশয় আমাদের চারপাশ, তার সহজাত বৈশিষ্ট্য আমাদের জীবনঘনিষ্ঠ উপকরণ।
তিনি যখন মানুষকে ব্যাখ্যা করেন, এভাবেই বলেন, ‘প্রত্যেক মানুষ একেকটা বইয়ের মতো। কেউ সহজ, কেউ কঠিন, আবার কারও হরফই বোঝা যায় না। কিছু বই পড়তে গেলে প্রথমে ভাষা বুঝতে হয়, আর কিছু বইয়ের পৃষ্ঠা একেবারে শূন্য- নীরব, রহস্যময়। আমার বইটা কেমন? হয়তো সহজ ভাষায় লেখা, কিন্তু সত্যিই কি সহজ? কারণ সরলতার মাঝেও লুকিয়ে থাকে অসীম জটিলতা।’
আরও পড়ুন:
তাপমাত্রা যখন সর্বনিম্ন!
তিনি যখন প্রেম-ঘৃণার অমোঘ চিত্রকে ফোটাতে চান। লিখেন, ‘ভালোবাসা আর ঘৃণা আসলে একই মুদ্রার দুই পিঠ। প্রেমিক-প্রেমিকার সামনে সেই মুদ্রা ঘুরতে থাকে। যাদের প্রেম যত গভীর, তাদের মুদ্রার ঘূর্ণন তত বেশি। একসময় মুদ্রা থেমে যায়- কখনও ভালোবাসা লেখা পিঠ ওপরে থাকে, কখনও ঘৃণা। তাই প্রেমের মুদ্রাকে সব সময় ঘুরতে দিতে হয়, ঘূর্ণন থামানো যাবে না।’
হুমায়ূন আহমেদ তার সৃজনশীলতাকে ছড়িয়ে দিতে পেরেছেন, তিনি যখন ভিজ্যুয়াল মাধ্যমেও সওয়ার হোন। খুবই পিচ্ছিল এই পথে তিনি হেঁটে গেছেন দারুণ সতর্কতায় এবং তিনি তার ম্যাজিক দেখিয়ে প্রমাণ দিয়েছেন, যেখানে হাত দেন, সেখানে সোনা ফলে। নির্মাণ করেছেন অসংখ্য নাটক। সিনেমা। তবে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ছিল নাটকে। বাংলা নাটকের খোলনলচে পাল্টে দিয়েছিলেন তিনি। ‘কোথাও কেউ নেই’ নাটকে হুমায়ূন আহমেদ যা দেখিয়েছেন তা দুনিয়ার কোথাও সেই উদাহরণ তৈরি হয়নি। নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্রকে এত মানুষের কাছের করে নিয়ে গেছেন যে তার ফাঁসির রায়ে ক্ষোভে ফেটে পড়েছিল পুরো দেশ। সেই ফাঁসি ঠেকাতে দেশের আপামর জনতা থেকে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ব্যক্তিও অনুরোধ করেছিলেন। দেয়াল লিখন, মিছিল কী হয়নি? ফাঁসির দিন পত্রিকায় বড় শিরোনাম হয়েছে, আজ বাকের ভাইয়ের ফাঁসি কোথাও কেউ থাকছে না। হুমায়ূন আহমেদ যে আমাদের ছিলেন, এসবের চেয়ে বড় আর কী প্রমাণ প্রয়োজন?
এমনি করে আমাদের হুমায়ূনকে পাওয়া যায় তার বইয়ের উৎসর্গপত্রে। সেখানে তিনি অনন্য। আমাদের মানুষ। আমাদের চিন্তার প্রতিফলন ছিল তার প্রতিটি উৎসর্গের বাক্যে বাক্যে।
‘দিঘির জলে কার ছায়া’ বইয়ের উৎসর্গপত্রে হুমায়ূন আহমেদ তার মৃত কন্যা লীলাবতীর জন্য যা লিখেছেন, তা এ দেশের সন্তানহারা পিতাদের সামগ্রিক হাহাকারের প্রতিফলন যেন।
আরও পড়ুন:
হুমায়ূন আহমেদের স্মৃতিতে ডা. এজাজের বই
তিনি লিখেছেন, ‘কন্যা লীলাবতীকে। এই উপন্যাসের নায়িকা লীলা। আমার মেয়ে লীলাবতীর নামে নাম। লীলাবতী কোনোদিন বড় হবে না। আমি কল্পনায় তাকে বড় করেছি। চেষ্টা করেছি ভালোবাসায় মাখামাখি একটি জীবন তাকে দিতে। মা লীলাবতী : নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে, রয়েছ নয়নে নয়নে।’
আবার বয়সের বড়- এ পার্থক্য থাকার কারণে তিনি যখন তার ছেলে নিষাদকে উৎসর্গপত্র লিখেন, তা হয়ে যায় অকপট ও কালের সাক্ষী। তিনি লিখেন, ‘তুমি যখন বাবার লেখা এই ভ্রমণকাহিনি পড়তে শুরু করবে, তখন আমি হয়তো বা অন্য এক ভ্রমণে বের হয়েছি। অদ্ভুত সেই ভ্রমণের অভিজ্ঞতা কাউকেই জানাতে পারব না। আফসোস!’
লেখক হুমায়ূন আহমেদের আরেকটা গুণে বিস্মিত হই, তিনি লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকেও বাঙালির জীবনকে দেখে গেছেন। অবিকল লিখে গেছেন। তার কনিষ্ঠ ভাই আহসান হাবীবকে একদিন ওপার বাংলা থেকে সমরেশ মজুমদার ফোন দিলেন। বললেন, হুমায়ূনকে তো পাচ্ছি না। কীভাবে পাওয়া যাবে। তার লিলুয়া বাতাস বইটি ভালো লেগেছে। জানাতাম।
আহসান হাবীব তখন বলেছিলেন, ভাইকে আমরাও পাই না। ওনার খোঁজখবর জানি পত্রিকা মারফত। সেই মানুষ বাঙালিজীবনকে কীভাবে দেখেছেন, কোথা থেকে সেই অভিজ্ঞতা নিয়েছেন, তা এক অপার বিস্ময়।
আরও পড়ুন:
দি নিউ স্কুল ঢাকায় অনুষ্ঠিত ‘পিঠা পার্বণ’
ব্যক্তি হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে আমার বেশ ক’বার দেখা হয়েছে। প্রথম দেখা তার বাসায়, ১৯৯৯ সালে। লেখালেখিতে আগ্রহী নতুন এক কিশোর আমি সরাসরি হুমায়ূন আহমেদের বাসায় গিয়ে কয়েকবার ফিরে এসে একবার পেয়েছিলাম। বুক অবধি লুঙ্গি প্যাঁচিয়ে এসে জানতে চাইলেন, আমার কাছে এসেছ? তখনও বোঝা হয়নি এই হুমায়ূন আহমেদের কাছে আমাদের বারবার যেতে হবে। কারণ তার চেয়ে আপন এই মধ্যবিত্ত বাঙালির আর কেউ নেই। হবেও না। া