ডেঙ্গু: জলবায়ু পরিবর্তন ও নীতিগত ব্যর্থতার ফল

কবিরুল বাশার
১৪ নভেম্বর ২০২৫, ০৭:৩৭
শেয়ার :
ডেঙ্গু: জলবায়ু পরিবর্তন ও নীতিগত ব্যর্থতার ফল

ব্রাজিলের বেলেমে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক ৩০তম সম্মেলন (কপ৩০, ১০-২১ নভেম্বর ২০২৫) বিশ্বসম্প্রদায়কে আবারও কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন কেবল গ্লেসিয়ার গলন, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি বা কৃষিজ উৎপাদন হ্রাসের মতো পরিবেশগত সমস্যা নয়, এটি এখন মানবস্বাস্থ্যের জন্য এক বৈশ্বিক সংকটে রূপ নিয়েছে। এই সম্মেলনে বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের স্বাস্থ্যগত প্রভাব, বিশেষ করে ভেক্টরবাহিত রোগ, যেমন- ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া, চিকুনগুনিয়া ও জিকা ভাইরাসের বিস্তার। ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা, অনিয়মিত বৃষ্টিপাত এবং আর্দ্রতার পরিবর্তন এই রোগগুলোর সংক্রমণ পরিধি ও মৌসুমি ধরন আমূল বদলে দিচ্ছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ইতোমধ্যে সতর্ক করেছে যে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও আফ্রিকার শহরাঞ্চলগুলোতে এডিস ইজিপ্টি ও এডিস অ্যালবোপিকটাস মশার প্রজনন ও টিকে থাকার হার দ্রুত বাড়ছে। এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ এখন একটি আদর্শ কেস স্টাডি; একসময় জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকা ডেঙ্গু সংক্রমণ এখন জানুয়ারি পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে।

ঢাকা, চট্টগ্রাম, গাজীপুর বা নারায়ণগঞ্জের মতো ঘনবসতিপূর্ণ নগর এলাকায় অনিয়ন্ত্রিত নগরায়ণ, নির্মাণ বর্জ্য এবং সঠিক পানি নিষ্কাশনব্যবস্থার অভাব জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবকে আরও তীব্র করছে। ফলে বাংলাদেশে ডেঙ্গু এখন আর কেবল বর্ষাকালের রোগ নয়, এটি রূপ নিয়েছে বছরব্যাপী জনস্বাস্থ্য দুর্যোগে, যেখানে প্রতিটি মৌসুমই নতুন সংক্রমণের ঝুঁকি বহন করছে।

এই বাস্তবতা কপ৩০-এর আলোচনায় একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা যোগ করছে। যে দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের মূল কারণ নয়, তারাই এর স্বাস্থ্যগত পরিণতির সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী। বাংলাদেশে ডেঙ্গুর বিস্তার এখন শুধু একটি স্বাস্থ্য সংকট নয়, বরং এটি জলবায়ু ন্যায়বিচারের প্রশ্নও।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সর্বশেষ তথ্য (১২ নভেম্বর ২০২৫) অনুযায়ী, চলতি বছরে দেশে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ৮১ হাজার ৭৭৩ জন এবং মৃত্যু হয়েছে ৩২৩ জনের। আক্রান্তদের মধ্যে পুরুষ ৬২.৪% এবং নারী ৩৭.৬%। মৃত্যুর হারেও পুরুষ ৫৩.৩% ও নারী ৪৬.৭%। সবচেয়ে বেশি সংক্রমণ ঘটছে ১৬-২৫ বছর বয়সী তরুণদের মধ্যে, যারা কর্মজীবী ও শিক্ষার্থী নগরবাসী। সর্বাধিক মৃত্যু ঘটেছে ঢাকা বিভাগে, যা অতিরিক্ত জনঘনত্ব, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, দুর্বল স্যানিটেশন ব্যবস্থা ও অকার্যকর মশা নিয়ন্ত্রণের সম্মিলিত ফল।

ডেঙ্গুর বিস্তার জলবায়ু উপাদানের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশের আবহাওয়ার ধরন বদলে গেছে, বর্ষাকাল দীর্ঘায়িত হয়েছে এবং অক্টোবর-নভেম্বর পর্যন্ত বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকে। এডিস মশা এই বৃষ্টিপাতের সুবিধা নিয়ে প্রজননচক্র চালিয়ে যায়।

অক্টোবরের শেষের দিকের বৃষ্টিতে ফুলের টব, ছাদের বালতি, পানির মিটার বা নির্মাণাধীন ভবনের জলাধারে জমে থাকা পরিষ্কার পানি মশার ডিম থেকে লার্ভা বিকাশের সুযোগ তৈরি করে। নভেম্বর মাসেও গড় তাপমাত্রা প্রায় ২০ক্কসে, যা মশার বেঁচে থাকা ও ভাইরাসের বীঃৎরহংরপ রহপঁনধঃরড়হ ঢ়বৎরড়ফ অর্থাৎ মশার শরীরে ভাইরাস পরিপূর্ণভাবে বিকাশের জন্য সবচেয়ে অনুকূল।

ফলে বাংলাদেশের নগরাঞ্চলে এখন ংবধংড়হধষ ংঢ়রষষড়াবৎ বভভবপঃ দেখা যাচ্ছে, বর্ষা শেষে ও শীতের শুরুতেও ডেঙ্গুর সংক্রমণ অব্যাহত থাকে। জলবায়ু পরিবর্তনের এই প্রভাবই কপ৩০-এর অন্যতম আলোচ্য বিষয় : ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা ও অনিয়মিত বৃষ্টিপাত বিশ্বজুড়ে ভেক্টরবাহিত রোগের ভৌগোলিক বিস্তার বাড়িয়ে দিচ্ছে।

বাংলাদেশে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের অন্যতম প্রতিবন্ধকতা হলো প্রশাসনিক কাঠামোর দুর্বলতা। বেশির ভাগ সিটি করপোরেশন ও পৌরসভা এখনও মৌসুমি ভিত্তিতে কার্যক্রম চালায়। লার্ভা সার্ভিলেন্স ও উৎস হ্রাস কার্যক্রম সীমিত। অনেক ক্ষেত্রে ফগিং মেশিনে অকার্যকর কীটনাশক ব্যবহৃত হয় অথবা ভুল সময়ে স্প্রে করা হয়, ফলে প্রকৃত এডিস জনসংখ্যা অপরিবর্তিত থাকে। কীটতত্ত্ববিদ ও প্রশিক্ষিত ভেক্টর বিশেষজ্ঞের ঘাটতি, ডোজ নির্ধারণে ত্রুটি এবং তথ্যভিত্তিক পরিকল্পনার অভাব প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে আরও দুর্বল করেছে। ফলে অনেক এলাকায় অবশিষ্ট প্রজনন অব্যাহত থাকে, অর্থাৎ অভিযান শেষ হলেও মশার প্রজনন বন্ধ হয় না।

গবেষণায় দেখা গেছে, ৭০-৮০% প্রজনন স্থানই আবাসিক ভবনের ভেতরে বা চারপাশে, কিন্তু নাগরিকদের অনেকেই এখনও মনে করেন মশা নিয়ন্ত্রণ সরকারের দায়িত্ব। অথচ প্রতিটি পরিবারের উচিত সপ্তাহে অন্তত এক দিন জমে থাকা পানি পরিষ্কার করা, কারণ এডিস মশার জীবনচক্র মাত্র ৫-৭ দিন।

ডেঙ্গু প্রতিরোধে একক কোনো ব্যবস্থা কার্যকর নয়; বরং প্রয়োজন সমন্বিত ভেক্টর ম্যানেজমেন্ট। এটি একটি বহুমাত্রিক কৌশল, যেখানে বিজ্ঞান, প্রশাসন, পরিবেশ, এবং সমাজ একসঙ্গে কাজ করে। আইভিএম -এর মূল দর্শন হলো প্রমাণভিত্তিক সিদ্ধান্ত, বহু-খাতভিত্তিক সমন্বয় এবং জনসম্পৃক্ত অংশগ্রহণ।

বাংলাদেশের শহরগুলোতে কার্যকর আইভিএম বাস্তবায়নের জন্য প্রতিটি সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও উপজেলা পর্যায়ে নিয়মিত লার্ভা ও অ্যাডাল্ট মশা পর্যবেক্ষণ ও নজরদারি চালু করতে হবে। এই সার্ভিলেন্সের তথ্য থেকে প্রতিটি ওয়ার্ডে হটস্পট ম্যাপিং তৈরি করা গেলে কোন এলাকায় মশার ঘনত্ব বেশি, কোন মৌসুমে ঝুঁঁকি বাড়ে তা সহজে নির্ধারণ করা সম্ভব হবে। সে অনুযায়ী টার্গেটেড সোর্স রিডাকশন, ইনডোর রেসিডুয়াল স্প্রে বা বায়োলজিক্যাল কন্ট্রোল কার্যক্রম পরিকল্পনা করা যেতে পারে।

আইভিএম-এর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো প্রাতিষ্ঠানিক সমন্বয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, স্থানীয় সরকার, পরিবেশ অধিদপ্তর, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও গণমাধ্যম- সব সংস্থার মধ্যে তথ্য ও কার্যক্রমের সমন্বয় নিশ্চিত করতে হবে। কপ৩০-এর আলোচনায় যেমন এক স্বাস্থ্য পদ্ধতি এবং সম্প্রদায়ের জলবায়ু স্থিতিস্থাপকতার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে, তেমনি বাংলাদেশের ডেঙ্গু প্রতিরোধেও প্রয়োজন সম্প্রদায়-ভিত্তিক ভেক্টর নিয়ন্ত্রণ।

স্কুল, কলেজ, মসজিদ, মন্দির, গির্জা, ক্লাব এবং সমাজসেবা সংগঠনগুলোকে আইভিএম-এর কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করা হলে এটি শুধু প্রশাসনিক নয়, বরং সামাজিক আন্দোলন হিসেবে গড়ে উঠতে পারে।

নগর পরিকল্পনার মধ্যেও আইভিএম সংহত করতে হবে। প্রতিটি নতুন ভবন বা নির্মাণ প্রকল্পে পানি নিষ্কাশন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও ভেক্টর প্রতিরোধ ব্যবস্থা বাধ্যতামূলক করা উচিত। বিল্ডিং কোডে মশা প্রতিরোধ নির্দেশিকা অন্তর্ভুক্ত হলে তা দীর্ঘ মেয়াদে এডিস মশার প্রজননক্ষেত্র হ্রাস করবে। আইভিএম-এর কার্যকারিতা কেবল প্রশাসনিক তৎপরতার ওপর নয়, বরং জনগণের আচরণগত পরিবর্তন-এর ওপরও নির্ভরশীল। নাগরিকদের নিয়মিতভাবে বাড়ির ভেতরে ও বাইরে পানি জমে থাকা স্থান পরিদর্শন, ফুলের টব বা ছাদে থাকা বালতি পরিষ্কার, পুরনো টায়ার বা বোতল ফেলে দেওয়া এসব সহজ অভ্যাসই মশার জীবনচক্র ভেঙে দিতে পারে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশিকা অনুযায়ী, সফল আইভিএম কর্মসূচির জন্য তিনটি শর্ত অপরিহার্য :

সঠিক তথ্য ও লার্ভা সূচক ( বিআই, সিআই, এইচএই)-এর নির্ভুল বিশ্লেষণ, নিয়মিত মনিটরিং ও মূল্যায়ন (এমঅ্যান্ডই), জনসম্পৃক্ততা ও আন্তঃখাত সহযোগিতা। যদি বাংলাদেশ এই তিনটি উপাদান শক্তভাবে প্রয়োগ করতে পারে, তাহলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম এক মৌসুমি উদ্যোগ থেকে রূপ নিতে পারে এক বছরব্যাপী টেকসই জনস্বাস্থ্য কর্মসূচিতে। কপ৩০-এর অভিযোজন এবং স্থিতিস্থাপকতা নীতিমালা যেমন জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় স্থানীয় জনগণের ক্ষমতায়নকে গুরুত্ব দেয়, তেমনি বাংলাদেশের ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণেও জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণই হতে পারে সাফল্যের মূল চাবিকাঠি।

ডিজিটাল বাংলাদেশের যুগে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণেও প্রযুক্তি গুরুত্বপূর্ণ। জিআইএস-ভিত্তিক ডেঙ্গু মনিটরিং প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে নাগরিকদের মোবাইল অ্যাপ বা ওয়েবসাইটের মাধ্যমে ঝুঁকিপূর্ণ স্থান বা রোগীর তথ্য জানানোর সুযোগ দিতে হবে। এতে দ্রুত প্রতিক্রিয়া ও এলাকাভিত্তিক পরিকল্পনা সম্ভব হবে।

সমন্বিত কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নীতি কার্যকর করে নির্মাণস্থল, ড্রেনেজ ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা উন্নত করতে হবে। নতুন ভবন নির্মাণের সময় বিল্ডিং কোডে মশা প্রতিরোধ নির্দেশিকা অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।

জেনেটিক, ভাইরোলজিক্যাল ও ইকোলজিক্যাল গবেষণা ছাড়া ডেঙ্গুর টেকসই সমাধান সম্ভব নয়। বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের যৌথ উদ্যোগে এডিস মশার জেনেটিক বৈচিত্র্য, ভাইরাসের সেরোটাইপ পরিবর্তন এবং কীটনাশক প্রতিরোধক্ষমতা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা প্রয়োজন।

হাসপাতাল পর্যায়েও প্রস্তুতি জরুরি। প্রতিটি জেলা ও উপজেলা হাসপাতালে ডেঙ্গু কর্নার, পর্যাপ্ত বেড ও প্রশিক্ষিত চিকিৎসক থাকা আবশ্যক। একই সঙ্গে তরল ব্যবস্থাপনা নির্দেশিকা অনুসরণ বাধ্যতামূলক করতে হবে, যাতে চিকিৎসা বিভ্রান্তি এড়ানো যায়।

সবশেষে, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণকে এককালীন প্রকল্প নয়, বরং জাতীয় জনস্বাস্থ্যনীতির স্থায়ী অংশ হিসেবে নিতে হবে। বাজেটে আলাদা বরাদ্দ, জবাবদিহি কাঠামো এবং দীর্ঘমেয়াদি ডেঙ্গুমুক্ত শহর কর্মপরিকল্পনা (২০২৬-২০৩০) চালু করতে হবে।

ডেঙ্গু আজ বাংলাদেশের জলবায়ু-স্বাস্থ্য সংকটের প্রতীক। কপ৩০ আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়- যদি জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা করতে হয়, তবে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে বিজ্ঞাননির্ভর, সমন্বিত ও নাগরিকভিত্তিক পদক্ষেপই একমাত্র পথ।

অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার : পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

মতামত লেখকের নিজস্ব