কৃত্রিম টাইটানিয়াম হৃৎপিণ্ডে সফলতা

আজহারুল ইসলাম অভি
১৩ নভেম্বর ২০২৫, ০৭:১১
শেয়ার :
কৃত্রিম টাইটানিয়াম হৃৎপিণ্ডে সফলতা

হৃদরোগের চিকিৎসায় এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন হলো। গুরুতর হৃদযন্ত্রের জটিলতায় ভোগা এক অস্ট্রেলীয় ব্যক্তি সম্পূর্ণ কৃত্রিম টাইটানিয়াম হৃৎপিণ্ড (BiVACOR Total Artificial Heart) নিয়ে টানা ১০৫ দিন বেঁচে থাকার এক ঐতিহাসিক বিশ্বরেকর্ড স্থাপন করেছেন। এই বিরল সাফল্যের পর ২০২৫ সালের মার্চ মাসে সফলভাবে তার হৃৎপিণ্ড প্রতিস্থাপন করা হয়। ৪০ বছর বয়সী এই রোগীই ছিলেন প্রথম ব্যক্তি, যিনি এই অত্যাধুনিক ডিভাইসটি নিয়ে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পান। হৃৎপিণ্ড প্রতিস্থাপনের জন্য অপেক্ষারত রোগীদের মধ্যে এই ডিভাইস নিয়ে ১০৫ দিন বেঁচে থাকা একটি বিশ্বের প্রথম ঘটনা। ইন্টারনেট থেকে তথ্য নিয়ে বিস্তারিত জানাচ্ছেন আজহারুল ইসলাম অভি।

প্রযুক্তির হৃৎস্পন্দন : হৃদযন্ত্রের চূড়ান্ত ব্যর্থতায় ভোগা রোগীদের জন্য একটি প্রাকৃতিক হৃৎপিণ্ড প্রতিস্থাপনই সাধারণত শেষ ভরসা। কিন্তু দাতার অভাবে সেই প্রতীক্ষার অবসান ঘটানো প্রায়ই অসম্ভব হয়। ঠিক এই সংকটময় মুহূর্তেই অস্ট্রেলীয় বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে এলো এক যুগান্তকারী সমাধানÑ বিভাকর (BiVACOR) টোটাল আর্টিফিশিয়াল হার্ট (TAH)। সম্পূর্ণ টাইটানিয়াম দিয়ে তৈরি এই কৃত্রিম হৃৎপিণ্ডটি কেবল একটি জীবন রক্ষাকারী যন্ত্র নয়, এটি আধুনিক প্রযুক্তির এক বিস্ময়কর সৃষ্টি।

ডিভাইসটির উদ্ভাবন : বিভাকর (BiVACOR) টোটাল আর্টিফিশিয়াল হার্টের ধারণা এবং বাস্তবায়নের পেছনে রয়েছেন অস্ট্রেলিয়ান বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার ড. ড্যানিয়েল টিমস (Dr. Daniel Timms)। গত দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে তিনি এবং তার দল এই ডিভাইসটি নিয়ে গবেষণা করেছেন। এই ডিভাইসের নকশা তৈরি হয়েছে মূলত দুটি প্রধান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য। প্রথমত, একটি কার্যকর রক্ত পাম্প তৈরি করা যা দীর্ঘস্থায়ী হবে; এবং দ্বিতীয়ত, হৃৎপিণ্ডের বাম ও ডানদিকের পাম্পিংয়ের মধ্যে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভারসাম্য বজায় রাখা। এই ডিভাইসের মূল গঠন উপাদান হলো টাইটানিয়াম, যা মানবদেহের সঙ্গে অত্যন্ত সুসহনীয় এবং মজবুত। এটি হৃৎপিণ্ডের উভয় প্রকোষ্ঠের (বাম ও ডান নিলয়) প্রতিস্থাপক হিসেবে কাজ করে, ফলে এটি সম্পূর্ণ হৃৎপিণ্ডকে প্রতিস্থাপন করে।

অপারেশন এবং অভিনব কর্মপদ্ধতি : বিভাকর (BiVACOR) TAH-এর সবচেয়ে বড় সাফল্য লুকিয়ে আছে এর ম্যাগনেটিক লেভিটেশন নামক অভিনব প্রযুক্তিতে। প্রচলিত কৃত্রিম হৃৎপিণ্ডগুলোতে পাম্প করার জন্য যান্ত্রিক ভাল্ব বা বিয়ারিং ব্যবহার করা হয়, যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ক্ষয়প্রাপ্ত হয় এবং রক্তকণিকাগুলোর ক্ষতি করে। কিন্তু বিভাকর সেই সমস্যাগুলো কাটিয়ে উঠেছে।

বিভাকরে একটি একক চলনশীল অংশ বা রোটর থাকে। এই রোটরটি শক্তিশালী চুম্বকের সাহায্যে চেম্বারের মধ্যে শূন্যে ভাসমান অবস্থায় উচ্চগতিতে ঘুরতে থাকে। যেহেতু এটি কোনো কিছু স্পর্শ করে না, তাই যন্ত্রাংশের যান্ত্রিক ক্ষয় হওয়ার ঝুঁকি প্রায় শূন্য। এটি রক্তের ওপর কম চাপ সৃষ্টি করে, যা রক্ত জমাট বাঁধার সম্ভাবনাকে উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে দেয়, যা দীর্ঘমেয়াদি ব্যবহারের জন্য অপরিহার্য।

এই রোটরের উভয়দিকে পাম্পিং ব্লেড বা ভেইনস রয়েছে। এটি একই সঙ্গে হৃৎপিণ্ডের বাম নিলয় (যা শরীরে অক্সিজেনযুক্ত রক্ত পাম্প করে) এবং ডান নিলয় (যা ফুসফুসে অনাক্সিজেনযুক্ত রক্ত পাম্প করে) এর কাজ করে। ডিভাইসের সেন্সর এবং সফ্টওয়্যার ক্রমাগত রোগীর শরীরের চাহিদা (যেমন শারীরিক কার্যকলাপের মাত্রা) পর্যবেক্ষণ করে এবং বাম ও ডানদিকের রক্ত প্রবাহের ভারসাম্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে বজায় রাখে। এটিই বিভাকর ((BiVACOR))-কে অন্যান্য টোটাল আর্টিফিশিয়াল হার্ট থেকে আলাদা করে তুলেছে।

অস্ট্রেলিয়ার ঐতিহাসিক সাফল্য : এই অত্যাধুনিক ডিভাইসের প্রথম সফল মানবদেহে ব্যবহার সম্পন্ন হয় অস্ট্রেলিয়ার সিডনির সেন্ট ভিনসেন্টস হসপিটালে (St VincentÕs Hospital, Sydney)। একজন ৪০ বছর বয়সী ব্যক্তি, যিনি গুরুতর হৃদযন্ত্রের ব্যর্থতায় ভুগছিলেন, তার ওপর এই অস্ত্রোপচার করা হয়। কার্ডিওথোরাসিক সার্জন পল জানজ (Paul Jansz)-এর নেতৃত্বে ৬ ঘণ্টার এই অপারেশনটি একটি ঐতিহাসিক মাইলফলক তৈরি করে। এই অস্ট্রেলীয় রোগীটি কৃত্রিম বিভাকর (BiVACOR) হৃৎপিণ্ড নিয়ে ১০৫ দিন পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন। এটি ছিল একটি দাতা হৃৎপিণ্ড প্রতিস্থাপনের জন্য অপেক্ষারত রোগীর কৃত্রিম হৃৎপিণ্ড নিয়ে বেঁচে থাকার বিশ্বরেকর্ড। এই সময়ের মধ্যে তিনি কেবল বিছানায় শুয়ে ছিলেন না, বরং তিনি হাসপাতাল থেকে ছাড়া পান এবং অপেক্ষাকৃত স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে সক্ষম হন। তার এই জীবন সংগ্রাম প্রমাণ করে যে, বিভাকর (BiVACOR) TAH একটি কার্যকর ‘ব্রিজ-টু-ট্রান্সপ্ল্যান্ট’ সমাধান। এই সফলতার পর রোগীর শরীরে সফলভাবে একটি দাতা হৃৎপিণ্ড প্রতিস্থাপন করা হয়।