জোহরান মামদানি জয়ী, নেপথ্যে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত জারার ভূমিকা
নিউইয়র্ক সিটির রাজনৈতিক প্রথা ভেঙে যখন জোহরান মামদানি সাবেক গভর্নর অ্যান্ড্রু কুমোকে ডেমোক্র্যাটিক প্রাইমারিতে পরাজিত করে মেয়র নির্বাচনে বিজয়ী হলেন, শিরোনামগুলো তাকে এক ‘প্রপঞ্চ’ বলেছিল। ৩৪ বছর বয়সী এই ক্যারিশম্যাটিক, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পারদর্শী এবং অকুতোভয় প্রগতিশীল নেতা হয়ে উঠলেন এক নতুন রাজনৈতিক প্রজন্মের মুখ।
কিন্তু তার নিখুঁতভাবে সাজানো বার্তা এবং ডিজিটাল প্রভাবের আড়ালে ছিলেন এক কৌশলী মস্তিষ্ক—জারা রহিম। যিনি বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত আমেরিকান, এবং যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ। গত এক দশক ধরে রাজনীতি, সংস্কৃতি ও প্রভাবের সংযোগস্থলে কাজ করে আসছেন। আমেরিকান বিজনেস ম্যাগাজিন ফরচুনের প্রতিবেদনে ওঠে এসেছে তার নেপথ্যের গল্প।
ছায়ার কৌশলী
জারা রহিম আলো চান না—তিনি আলো গড়ে তোলেন। গত ফেব্রুয়ারিতে সিনিয়র অ্যাডভাইজার হিসেবে মামদানির দলে যোগ দেওয়ার পর থেকেই তিনি নীরবে গড়ে তুলেছেন আধুনিক নিউইয়র্কের অন্যতম সফল তৃণমূলভিত্তিক প্রচারণা।
মামদানিকে দেওয়া তার প্রথম পরামর্শই হয়ে ওঠে পুরো প্রচারণার নীতি। দ্য নিউইয়র্ক টাইমস-এ নবনির্বাচিত এক উপদেষ্টা বলেন, ‘জারা রহিম টিমকে বলেছিলেন, রাজনৈতিক কৌশলবিদদের কল্পিত নিউইয়র্ককে ভুলে যান—বাস্তব নিউইয়র্ক সিটিকে কেন্দ্র করে প্রচারণা চালান।’
এই সহজ অথচ মৌলিক ধারণাই পুরো খেলা পাল্টে দেয়। শহরের ক্ষমতার করিডোরে নয়, প্রচারণার কেন্দ্রবিন্দু হয় মেট্রোর যাত্রী, খাবার সরবরাহকারী, ট্যাক্সিচালক, মসজিদগামী, আর পথের বিক্রেতারা—যারা শহরটিকে সচল রাখে, কিন্তু নেতৃত্বের আলোতে প্রায়ই অদৃশ্য থাকে।
নির্বাচনের দিন ঘনিয়ে আসার আগেই প্রায় ৯০,০০০ স্বেচ্ছাসেবক আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিলেন। এটি তখন আর শুধু প্রচারণা ছিল না—ছিল এক নাগরিক জাগরণ।
নিউইয়র্কের নবনির্বাচিত মেয়র জোহরান মামদানির সঙ্গে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত জারা রহিম। ছবি: এক্স
দক্ষিণ ফ্লোরিডা থেকে শুরু
জারা রহিমের নিউইয়র্ক রাজনীতির যাত্রা শুরু হয় হাজার মাইল দক্ষিণে। বাংলাদেশি অভিবাসী দম্পতির সন্তান হিসেবে দক্ষিণ ফ্লোরিডায় বেড়ে ওঠা জারা প্রথম ডিজিটাল গল্প বলার শক্তি উপলব্ধি করেন বারাক ওবামার ২০১২ সালের পুনর্নির্বাচনী প্রচারণায়।
ফ্লোরিডার ডিজিটাল কনটেন্ট ডিরেক্টর হিসেবে তিনি শিখেছিলেন কীভাবে টুইট ও ভিডিওকে ভোটে রূপান্তরিত করা যায়। সেই শিক্ষা ছিল স্থায়ী—গল্প বলাই ছিল কৌশল।
এরপর তিনি যোগ দেন হোয়াইট হাউসের অফিস অফ ডিজিটাল স্ট্র্যাটেজিতে, ওবামা প্রশাসনের জাতীয় বার্তা গঠনে ভূমিকা রাখেন। তারপর উবারে কাজ করেন, যখন সংস্থাটি রাইড-শেয়ারিং আইন নিয়ে প্রথম বড় লড়াইয়ে নামছে।
২৫ বছরের মধ্যেই জারা রহিম কাজ করছিলেন হিলারি ক্লিনটনের ২০১৬ সালের প্রচারণায়—নীতি ও জনগণের হৃদয়ের সংযোগ ঘটানোর দক্ষতায় আরও শাণ পান। তারপর এক সাহসী বাঁকে প্রবেশ করেন ফ্যাশন জগতে—ভোগ (Vogue)-এর কমিউনিকেশনস ডিরেক্টর হিসেবে।
এটি ছিল অপ্রচলিত পথ, কিন্তু গভীর তাৎপর্যময়। এক সাক্ষাৎকারে রহিম বলেন, ‘রাজনীতি আর সংস্কৃতি আলাদা নয়। মানুষ ক্ষমতাকে যেভাবে দেখে—কে তা পায়, কে পাওয়ার যোগ্য—সবই গল্প বলার অংশ।’
ডিজিটাল ফিসফিসানি
মামদানি যখন মেয়র পদে প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দেন, জারা রহিম সেখানে দেখলেন পরিচিত এক চ্যালেঞ্জ; রাজনীতিকে আবার বাস্তব করে তোলা।
তার কৌশল ছিল ডিজিটাল ও মানবিক দিকের মেলবন্ধন। টিকটক আর ইনস্টাগ্রাম ছিল না কোনো প্রচারণার কৌশলগত কসরত—ছিল মাঠপর্যায়ের সংগঠনের সম্প্রসারণ। জারা ব্যাখ্যা করেন, ‘আমরা ইভেন্টের মধ্যেই ভিডিও করতাম। এক মুহূর্তে জোহরান হাউজিং নীতি নিয়ে কথা বলছে, পরের মুহূর্তে হিন্দি বা স্প্যানিশে শ্রমজীবী পরিবারের সঙ্গে কথা বলছে।’
এগুলো সাজানো ফটোসেশন ছিল না—ছিল সম্পর্ক তৈরি করার মুহূর্ত। জারা বলেন, ‘এরা ছিলেন বাংলাদেশি কাকারা, পশ্চিম আফ্রিকার আন্টিরা—যারা জীবনে কখনো মেয়র প্রাইমারিতে ভোট দেননি। তারা প্রথমবার অনুভব করলেন, কেউ তাদের পাড়া-মহল্লাকে গুরুত্ব দিচ্ছে।’
ফলাফল ছিল অসাধারণ, ভিডিওগুলো অনলাইনে কোটি ভিউ পায়, কিন্তু প্রকৃত জয় ঘটে অফলাইনে—১৬ লাখ দরজায় কড়া, ২ লাখ ৪৭ হাজার ভোটারের সঙ্গে সরাসরি কথোপকথন।
আরও পড়ুন:
রোগীর পেটে জীবন্ত মাছি!
ছবি: ইনষ্টাগ্রাম থেকে নেওয়া
ঝড়ের মধ্যে শান্ত কণ্ঠ
যখন অ্যান্ড্রু কুমোর তার প্রচারণায় ইসলামবিদ্বেষী মন্তব্য করে বসেন, তখন জারার প্রতিক্রিয়া ছিল দ্রুত ও স্পষ্ট। সিএনএনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘‘তিনি মুসলিমদের কাছে পৌঁছানোর একমাত্র উপায় ভেবেছেন এই বলে, ‘ওই খারাপ মুসলমানকে দেখুন।’ এটি এক হতাশজনক কৌশল—যে মানুষের মুসলিমদের কাছে বলার কিছুই নেই।’’
উক্তিটি ভাইরাল হয়—রাগের কারণে নয়, তার স্বচ্ছতার কারণে। এটি মামদানির প্রচারণার নৈতিক অবস্থানকে পুনঃসংজ্ঞায়িত করে, তাও সংযম হারানো ছাড়াই।
এক সিনিয়র প্রচারণা সহকারী বলেন, ‘তিনি এক বাক্যে পুরো বিশৃঙ্খলা কেটে ফেলতে পারেন। যখন কক্ষে উত্তেজনা বেড়ে যায়, জারা তখন সবচেয়ে শান্ত—এবং আশ্চর্যজনকভাবে সবচেয়ে তীক্ষ্ণ।’
শুধু প্রচারণা নয়, এক আন্দোলন
জারা একা ছিলেন না। তিনি মায়া হান্ডা, তাস্চা ভ্যান আওকেন, ও ফায়জা আলির মতো সংগঠকদের সঙ্গে মিলে গড়ে তুলেছিলেন সেই স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী, যা মামদানিকে জয় এনে দেয়।
এই প্রচারণা হয়ে উঠেছিল নতুন ধরনের রাজনীতির নকশা—যার শিকড় কমিউনিটিতে, যার ভাষা অন্তর্ভুক্তিমূলক ও আন্তরিক। জারার ভাষায়, ‘আমরা মানুষের শক্তি শুষে নিচ্ছিলাম না; আমরা সংযোগের এক সংস্কৃতি গড়ে তুলছিলাম।’
আরও পড়ুন:
২৫ জিম্মিকে মুক্তি দিল হামাস
জারা রহিম। ছবি: ইনষ্টাগ্রাম
প্রচারণা থেকে সিটি হল পর্যন্ত
মামদানি ৪ নভেম্বর বিজয়ী হওয়ার পর প্রথম কাজই ছিল এক সর্ব-নারী ট্রানজিশন টিম গঠন করা—যার অংশ জারাও। তার সঙ্গে রয়েছেন লিনা খান, মারিয়া টরেস-স্প্রিংগার, গ্রেস বোনিলা ও মেলানি হার্টজগ।
২০২৬ সালের ১ জানুয়ারি যখন মামদানি নিউইয়র্কের মেয়র হিসেবে শপথ নেবেন, তিনি ইতিহাস গড়বেন—শহরের প্রথম মুসলিম মেয়র, প্রথম দক্ষিণ এশীয় মেয়র, এবং এক শতাব্দীরও বেশি সময়ের মধ্যে সবচেয়ে কমবয়সী নেতা হিসেবে।
কিন্তু জারার কাছে আসল গল্পটা পদ বা উপাধির নয়। এটি আমেরিকায় ক্ষমতাকে গড়ে তোলে—আর কীভাবে গড়ে তোলে—তার নতুন সংজ্ঞা লেখার গল্প।
আমাদের সময়/আরডি