গাছের পাতা থেকে তৈরি হচ্ছে তেল

খন্দকার রাকিবুল ইসলাম, রংপুর
১২ নভেম্বর ২০২৫, ০৮:৫৭
শেয়ার :
গাছের পাতা থেকে তৈরি হচ্ছে তেল

রংপুরের পীরগাছায় গাছের পাতা থেকে তৈরি হচ্ছে তেল। অস্ট্রেলিয়ান ‘টি ট্রি’ পাতার এ তেল ও হাইড্রোসল ওয়াটার বিশ্বব্যাপী স্কিন কেয়ার, চুলপড়া, খুশকি, ব্রন, ফাঙ্গাস ও স্ক্যাল্পজনিত বিভিন্ন সমস্যার সমাধানে প্রসাধনী ও ওষুধ শিল্পে ব্যবহৃত হয়। এই বিস্ময়কর কাজটি করে দেখিয়েছেন তরুণ উদ্যোক্তা ও প্রকৌশলী আসাদুজ্জামান আরিফ। তাঁর উৎপাদিত তেল স্থানীয় বাজার ছাড়িয়ে এরই মধ্যে রপ্তানি হচ্ছে থাইল্যান্ড ও তাইওয়ানে।

তাইওয়ানের একটি বহুজাতিক কোম্পানিতে ৫ বছর চাকরির অভিজ্ঞতা রয়েছে আরিফের। সেই কোম্পানির মালিকের পরামর্শে কয়েক বছর আগে কাউনিয়া উপজেলার সন্তান আরিফ রংপুরের পীরগাছা উপজেলার ইটাকুমারী ইউনিয়নের শ্রীকান্ত গ্রামে এক একর জমি লিজ নিয়ে শুরু করেন অস্ট্রেলিয়ান ‘টি ট্রি’ গাছের চাষ। এ বছর সেই গাছের পাতা থেকে বিশেষ মেশিনের সাহায্যে অ্যাসেনশিয়াল অয়েল ও হাইড্রোসল উৎপাদন শুরু করেন। চলতি বছর প্রকল্প থেকে ৩০ লাখ টাকা আয়ের লক্ষ্য তাঁর।

তবে শুরুটা সহজ ছিল না। নানা জটিলতার কারণে বিদেশ থেকে চারা আনতে ব্যর্থ হন তিনি। পরবর্তীতে আন্তর্জাতিক ই-কমার্স সাইট থেকে অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স ও নেদারল্যান্ডস থেকে অল্প কিছু বীজ সংগ্রহ করেন। তবে বীজ থেকে চারা উৎপাদন তাঁর জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। স্থানীয় কৃষি বিভাগ ও বাংলাদেশ কৃষি ইনস্টিটিউটের সহায়তায় ৩ বছরের প্রচেষ্টায় সফলভাবে ৪০টি চারা উৎপাদন করতে সক্ষম হন। সেই চারাগুলোর কাটিং থেকেই এখন এক একর জমিতে ২ হাজারের বেশি ‘টি ট্রি’ গাছ দাঁড়িয়ে আছে।

গাছ বড় হওয়ার পর পাতা থেকে কীভাবে তেল উৎপাদন করবেন, সে নিয়েও পড়েন আরেক বিপাকে। চীন থেকে একটি ছোট ডিস্টিলেশন মেশিন এনে তা বিশ্লেষণ করে স্থানীয়ভাবে ৫০০ লিটার ধারণক্ষমতার একটি বড় মেশিন তৈরি করেন। বর্তমানে সেই মেশিনে সফলভাবে তেল ও হাইড্রোসল উৎপাদন করে দেশ-বিদেশে বিক্রি করছেন তিনি। এতে কর্মসংস্থান হয়েছে স্থানীয় ১০ থেকে ১২ জন মানুষের।

প্রথমে শ্রমিকরা গাছ থেকে পাতা সংগ্রহ করে সেগুলো ড্রামের পানিতে ধুয়ে স্টিলের চৌবাচ্চায় তোলেন। পরে সেই পাতাগুলো ৪ থেকে ৫ ঘণ্টা জাল দিয়ে স্টিম ডিস্টিলেশন পদ্ধতিতে বের করা হয় তেল ও হাইড্রোসল। বর্তমানে প্রতিদিন তিন ব্যাচে ৫০ কেজি করে পাতা প্রক্রিয়াজাত করে দেড় লিটার অ্যাসেনশিয়াল অয়েল উৎপাদন করছেন তাঁরা। শ্রমিকরা জানান, এখানে কাজ পেয়ে তাঁদের সংসার এখন অনেক ভালো চলছে।

পীরগাছা সরকারি কলেজের বাংলা বিভাগের প্রধান মো. এজাজুল ইসলাম বলেন, ‘আমি জানতাম গাছের পাতা শুধু ঝরে যায়। তা দিয়ে তেল হয়Ñ এ কথা শুনে সত্যিই অবাক হয়েছি। আমি নিজেও এ তেল ব্যবহার করে উপকৃত হয়েছি। দেশে আরিফের মতো আরও উদ্যোক্তা তৈরি হোক, কর্মসংস্থান বাড়ুকÑ এটাই প্রত্যাশা।’

আরিফ জানান, ‘টি ট্রি’ তেল ও হাইড্রোসলের আন্তর্জাতিক বাজার খুবই বড়। থাইল্যান্ড ও তাইওয়ানের পাশাপাশি এ বছর চীনেও নমুনা পাঠানো হয়েছে। তিনি বলেন, ‘সরকার যদি রপ্তানিপ্রক্রিয়া সহজ করে, তাহলে বৈদেশিক মুদ্রা আয় ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে বড় ভূমিকা রাখা সম্ভব।’

পীরগাছা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘টি ট্রি’ গাছ তিন বছর পর ফলন দেয় এবং একবার লাগালে ২০ থেকে ৩০ বছর পর্যন্ত টিকে থাকে। নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি করতে কাটিং উৎপাদনের কাজ করা হচ্ছে। এ তেলে কোনো ক্ষতিকর উপাদান আছে কি না, তাও পরীক্ষা করা হচ্ছে। শুরু থেকেই আরিফকে সহযোগিতা করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, রংপুরের মাটি এই গাছের জন্য উপযোগী। নতুন কেউ এমন উদ্যোগ নিলে কৃষি বিভাগ সব ধরনের সহায়তা করবে।