সরকারের সঙ্গে চলছে আদানির টানাপড়েন
ভারতের বেসরকারি কোম্পানি আদানি পাওয়ার থেকে বিদ্যুৎ আমদানির যে চুক্তি করেছে বিগত আওয়ামী লীগ সরকার, সেই চুক্তি একপেশে বিবেচনায় তা বাতিলের পথ খুঁজছে বাংলাদেশ। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর একটি জাতীয় কমিটি গঠন করে দেওয়া হয়েছে বিগত সরকারের সময়ে বিদ্যুৎ খাতের নানা চুক্তি পর্যালোচনা করে প্রতিবেদন দিতে। সেই কমিটির অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনও বলছে, আদানিসহ বিভিন্ন কোম্পানির সঙ্গে করা চুক্তিতে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে। বিশেষ করে আদানির সঙ্গে চুক্তির ফলে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, হবে। আরও তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে আগামী জানুয়ারির মধ্যে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেবে এ কমিটি। সব মিলিয়ে এক ধরনের টানাপড়েন চলছে সরকার ও আদানির মধ্যে।
আইনজ্ঞরা বলছেন, এসব চুক্তি বাতিল করা খুব সহজ বিষয় নয়। চুক্তি বাতিলের ক্ষেত্রে সব কিছু বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। অন্যথা হিতে বিপরীত হতে পারে।
এদিকে, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর আদানি পাওয়ার তাদের উৎপাদিত বিদ্যুৎ ভারতের অভ্যন্তরেও বিক্রি করা যাবে মর্মে আইনের পরিবর্তন করে নিয়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশকে তাদের পাওনা যথাসময়ে পরিশোধ না করলে বিদ্যুৎ বন্ধ করে দেওয়ার হুশিয়ারিও দিয়েছে কয়েক দফায়। এসবের মধ্যেও অন্তর্বর্তী সরকার আদানির পাওনা পরিশোধ করে আসছে; তাদের সরবরাহকৃত বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করছে।
বাংলাদেশের সঙ্গে আদানির চুক্তির স্বার্থবিরোধী নানা তথ্য-উপাত্ত নিয়ে যখন বিশ্লেষণ চলছে, তখন বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে (পিডিবি) চিঠি দিয়েছে আদানি। চিঠিতে বলা হয়েছে, নভেম্বরের ১০ তারিখের মধ্যে সব বকেয়া পরিশোধ না হলে ১১ নভেম্বর থেকে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হবে। গত ৩১ অক্টোবর আদানির পাওয়ার থেকে পিডিবি চেয়ারম্যান প্রকৌশলী রেজাউল করিমের কাছে
আরও পড়ুন:
রাজধানীতে কিশোরীসহ ২ জনের মরদেহ উদ্ধার
পাঠানো ওই চিঠিতে আদানি পাওয়ারের ভাইস চেয়ারম্যান অবিনাশ অনুরাগ অভিযোগ করেন, বিপিডিবি ৪৯৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বকেয়া পরিশোধে ব্যর্থ হয়েছে। এর মধ্যে ২৬২ মিলিয়ন ডলারকে পিডিবি নিজেই ‘বিরোধহীন পাওনা’ হিসেবে স্বীকার করেছে। চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, ২০১৭ সালের ৫ নভেম্বর স্বাক্ষরিত বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তির (পাওয়ার পারচেজ এগ্রিমেন্ট বা পিপিএ) ১৩.২ ধারায় বলা আছেÑ বকেয়া পরিশোধে ব্যর্থ হলে সরবরাহ স্থগিতের অধিকার রাখে কোম্পানি। ১০ নভেম্বরের মধ্যে সব বকেয়া নিষ্পত্তি না হলে আমরা ১১ নভেম্বর থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করতে বাধ্য হব। আদানির চিঠিতে স্পষ্ট করে সতর্কবার্তা দেওয়া হয়।
আদানির এমন সতর্কবার্তার মধ্যেই পিডিবি আদানিকে পাওনা টাকা পরিশোধ শুরু করেছে। পিডিবি সূত্রে জানা যায়, আদানি বিদ্যুৎ বন্ধ করে দিতে পারে এমন শঙ্কায় বকেয়ার আংশিক অর্থ পরিশোধ করেছে পিডিবি। ফলে আদানি পাওয়ার বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ অব্যাহত রেখেছে। বিদ্যুৎ সরবরাহ সচল রাখতে আদানি পাওয়ারের বেঁধে দেওয়া সময়সীমার মধ্যে (১০ নভেম্বর) পিডিবি ৩০ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করেছে। আপাতত ১০০ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করা হবে, এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে পিডিবি। চিঠিতে ৪৯৫ মিলিয়ন ডলার বকেয়া পরিশোধের দাবি করেছিল আদানি।
আদানি তাদের সর্বশেষ চিঠিতে জানিয়েছে, সরবরাহ বন্ধ থাকলেও পিপিএ অনুযায়ী ‘নির্ভরযোগ্য উৎপাদন সক্ষমতা’ ধরে সক্ষমতা চার্জ পাওয়ার অধিকার রাখে আদানি। অর্থাৎ বিদ্যুৎ সরবরাহ না থাকলেও ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ বাংলাদেশকে নির্দিষ্ট অর্থ পরিশোধ করতে হবে। এর আগে ২৭ সেপ্টেম্বর গৌতম আদানি প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে পাঠানো চিঠিতে অভিযোগ করেন, বিপিডিবি বারবার প্রতিশ্রুতি দিয়েও বকেয়া মেটায়নি। সেপ্টেম্বরের মধ্যে সব পাওনা নিষ্পত্তির প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু কিছুই হয়নি, উল্লেখ করেন গৌতম আদানি।
আরও পড়ুন:
নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে এলডিপি?
চুক্তিসংশ্লিষ্ট বিরোধ নিয়ে আপাতত মধ্যস্থতা প্রক্রিয়ায় যেতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে পিডিবি। তারা বলছে, বিষয়টি বাংলাদেশের আদালতে বিচারাধীন এবং অনিয়মের অভিযোগ তদন্তাধীন থাকায় এখন সমঝোতা প্রক্রিয়া শুরু করা সময় ও অর্থের অপচয় হবে। ফলে আদানি-পিডিবি সম্পর্কের চলমান টানাপড়েন এখন দুই দেশের বিদ্যুৎবাণিজ্যে নতুন অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে।
প্রসঙ্গত, অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় এসে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মঈনুল ইসলাম চৌধুরীকে আহ্বায়ক করে উচ্চপর্যায়ের একটি কমিটি গঠন করে। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেনÑ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) উপ-উপাচার্য আবদুল হাসিব চৌধুরী, বহুজাতিক অডিট ফার্ম কেপিএমজি বাংলাদেশের প্রাক্তন চিফ অপারেটিং অফিসার আলী আশরাফ, বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন, ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের ফ্যাকাল্টি অব ল’ অ্যান্ড সোশ্যাল সায়েন্সের অধ্যাপক মোশতাক হোসেন খান, বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্টের সিনিয়র অ্যাডভোকেট ড. শাহদীন মালিক।
গত বছরের সেপ্টেম্বরে এ কমিটি গঠন করা হয়। এক বছর পর চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে অন্তর্বর্তী রিপোর্ট জমা দিয়েছে কমিটি। পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট আগামী জানুয়ারির মধ্যে জমা দেওয়া হবে বলে কমিটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। অন্তর্বর্তী রিপোর্ট গ্রহণকালে বিদ্যুৎ উপদেষ্টা ড. ফাওজুল কবির বলেন, আদানির চুক্তিতে যদি কোনো অনিয়ম পাওয়া যায়, তা হলে চুক্তি বাতিল করতে দ্বিধা করবেন না। তিনি বলেন, প্রতিটি চুক্তিতেই স্বীকারোক্তি থাকে যে, এই চুক্তিতে কোনো দুর্নীতির আশ্রয় নেওয়া হয়নি। কিন্তু এটা যদি ভঙ্গ করা হয় তাহলে চুক্তি বাতিল করা যায়।
এ বিষয়ে আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, চুক্তি শুধু বাতিল করার যথেষ্ট তথ্য প্রমাণ রয়েছে। আমরা এখানে বাতিল করলাম, কিন্তু তারা আন্তর্জাতিক আদালতে যেতে পারে। সেখানে ৫ বিলিয়ন ডলার দাবি করতে পারে। তাই বুঝেশুনে চুক্তি বাতিলের দিকে যেতে হবে। আন্তর্জাতিক আদালত চুক্তি বাতিল না করলে এখন যে ক্ষতি হচ্ছে, তার চেয়ে দশগুণ-বিশগুণ বেশি গচ্চা যেতে পারে। তিনি বলেন, ৩০ শতাংশ জেতার সম্ভাবনা থাকলে আমরা আদালতে যাব না। যদি দেখি, আইনগতভাবে ৮০ শতাংশ জেতার সম্ভাবনা রয়েছে, তা হলে অবশ্যই পরামর্শ দেব সরকারকে। তবে আগেই সব তথ্য প্রকাশ করলে অনেক ক্ষতি হতে পারে।