খুনোখুনি অস্ত্র গুলি আগুন রাজধানীতে অস্থিরতা

সাজ্জাদ মাহমুদ খান
১১ নভেম্বর ২০২৫, ০৩:২২
শেয়ার :
খুনোখুনি অস্ত্র গুলি আগুন রাজধানীতে অস্থিরতা

চট্টগ্রামে নির্বাচনী গণসংযোগকালে গত বুধবার বিএনপি মনোনীত সংসদ সদস্য প্রার্থী এরশাদ উল্লাহ গুলিবিদ্ধ হন। আর সন্ত্রাসীদের ছোড়া গুলিতে নিহত হন চট্টগ্রামের তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী সরোয়ার হোসেন বাবলা। এ ঘটনার রেশ না কাটতেই গতকাল সোমবার সকালে ঢাকার রাস্তায় ফিল্মি স্টাইলে খুন করা হয় তারিক সাইফ মামুনকে। এ হত্যাকাণ্ডে আন্ডারওয়ার্ল্ডের সংযোগ দেখছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। লুটের পর উদ্ধার না হওয়া হাজারের বেশি অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র ও চোরাই পথে আসা অবৈধ অস্ত্র এসব হত্যাকাণ্ডে ব্যবহার হচ্ছে। কাকরাইলের চার্চের গেটসহ সম্প্রতি অন্তত ৭টি স্থানে ককটেল হামলা এবং নাশকতামূলক অগ্নিসংযোগ করা হয়। আগামীকাল ১৩ নভেম্বর কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের ‘ঢাকা লকডাউন’ কর্মসূচি ঘিরে ককটেল নিক্ষেপ ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটছে। গত কয়েক দিনের হত্যাকাণ্ড-সহিংসতায় জনমনে আতঙ্ক শুরু হয়েছে। প্রশাসনে দেখা দিয়েছে উদ্বেগ। এতে রাজনীতিতে হঠাৎ করেই উত্তেজনা তৈরি হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস্) এসএন মো. নজরুল ইসলাম আমাদের সময়কে বলেন, কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে। আমরা ককটেল নিক্ষেপকারীসহ অপরাধীদের শনাক্ত করে গ্রেপ্তার করছি। নগরবাসীকে আতঙ্কিত না হওয়ার অনুরোধ করছি। যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় পুলিশ সর্বোচ্চ সতর্কতায় আছে।

এদিকে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরেও দেশে বিভিন্ন ধরনের নাশকতার আশঙ্কা করেছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক কর্মকর্তা। নির্বাচন কমিশনও বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জানিয়েছে। সংসদ নির্বাচনের ৪২ হাজার ভোটকেন্দ্রের মধ্যে ২৮ হাজার ৬৬৩টি ঝুঁঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বলছেন, আন্ডারওয়ার্ল্ডের নিয়ন্ত্রণ ও নির্বাচনে নিজ দলের প্রার্থীদের প্রভাব বিস্তারের জন্য অস্ত্রের ব্যবহার শুরু হয়েছে। দলীয় কোন্দলেও অস্ত্রের ব্যবহার করা হচ্ছে। চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্য বিস্তারের জন্য খুনোখুনি এবং আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে। এ ছাড়া নির্বাচন বানচাল করতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ওপর হামলা ছাড়াও নানা অন্তর্ঘাতমূলক ঘটনা ঘটতে পারে।

গত তিন দিনে রাজধানীর কাকরাইলে চার্চসহ অন্তত সাতটি স্থানে ককটেল নিক্ষেপ ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। এর মধ্যে রাজধানীর মোহাম্মদপুর, মিরপুর ও ধানমন্ডির দুই জায়গায় গতকাল সকালে সাতটি ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। সব জায়গাতেই মোটরসাইকেলে হেলমেট পরে আসা ব্যক্তিরা ককটেল ছোড়েন। সকাল সাতটার দিকে মোহাম্মদপুরে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার এবং কবি ও চিন্তক ফরহাদ মজহারের খাদ্যপণ্যের প্রতিষ্ঠান প্রবর্তনার সামনের সড়কে ও সীমানার ভেতরে দুটি ককটেল বিস্ফোরণ করা হয়। মিরপুরে ভোর পৌনে চারটার দিকে গ্রামীণ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের সামনে একটি ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। সকালে ধানমন্ডি ২৭ নম্বরের মাইডাস সেন্টারের সামনে দুটি এবং ৯/এ সড়কে ইবনে সিনা হাসপাতালের সামনে দুটি ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি। তবে ধারাবাহিক ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনায় মানুষের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে।

ধানমন্ডি জোনের সহকারী কমিশনার (এসি) শাহ মোস্তফা তারিকুজ্জামান বলেন, মোটরসাইকেলে

করে এসে এসব বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, ভয় দেখানোর জন্যই এই ককটেল ছোড়া হয়েছে। আলামত ও সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে।

পুলিশ বলছে, কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের ১৩ নভেম্বর ‘ঢাকা লকডাউন’ কর্মসূচি ঘিরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। ইতোমধ্যে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে মাঠপর্যায়ে নিরাপত্তা জোরদারের বিষয়ে কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। গতকাল থেকে রাজধানীসহ সারাদেশে বাড়ানো হচ্ছে পুলিশের টহল, চেকপোস্ট ও গোয়েন্দা নজরদারি। একই সঙ্গে সাইবার ইউনিটও সক্রিয় থাকবে, যাতে সামাজিক মাধ্যমে গুজব বা উসকানিমূলক পোস্ট শনাক্ত করে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া যায়। রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের চলাচল, যোগাযোগ ও সামাজিক মাধ্যমে প্রচারিত বার্তাগুলো পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে।

স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের কর্মসূচি ঘিরে কোনো শঙ্কা নেই। সেনাসদস্যদের মাঠ থেকে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে না।

পুলিশ সদর দপ্তরের একজন কর্মকর্তা বলেন, পতিত আওয়ামী লীগ নানাভাবে দেশে নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলা চালানোর প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। সামাজিক মাধ্যমে ঢাকা লকডাউন কর্মসূচির নামে গুজব ছড়ানো হচ্ছে। এসব অপতৎপরতা দেখে জেলা পর্যায় থেকে নেতাকর্মীরা যাতে ঢাকায় আসতে না পারে, এ ব্যাপারে প্রতিটি জেলার পুলিশকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।

পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, গতকাল থেকে সড়কের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে চেকপোস্ট বসানো হয়েছে। সন্দেহজনক ব্যক্তিদের আটক করা হবে। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বেআইনি কর্মকাণ্ড চালানোর উদ্দেশ্যে ঢাকায় এসে অবস্থান নিতে পারে। এটা ঠেকাতে বিভিন্ন মেস, হোস্টেল ও আবাসিক হোটেলে অভিযান চালানো হবে। নজরদারি থাকবে ঝটিকা মিছিলের দিকেও।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ তৌহিদুল হক বলেন, গণ-অভ্যুত্থানের পরেও রাষ্ট্র ও সমাজ আইনের শাসনের পথে হাঁটতে চায় এমন ব্যবস্থা আমরা দেখছি না। যৌথ বাহিনীর জোরালো সাঁড়াশি অভিযান নেই। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উদ্যম কমে যাওয়ার পাশাপাশি রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে প্রতিরোধও তৈরি হচ্ছে না। ফলে অপরাধ বেড়েই চলছে। বিচার নিশ্চিত না করা গেলে এ রকম হবে। প্রকাশ্যে দিবালোকে এ ধরনের হত্যাকাণ্ড ও বোমা বিস্ফোরণে একটা ভয়ের পরিবেশ তৈরি হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, একটা সমাজে যত বেশি অবৈধ অস্ত্র থাকবে, তত বেশি অপরাধের ঝুঁকি থাকবে। বিশেষ করে নির্বাচনী সংঘাত-সহিংসতা, চাঁদাবাজি, আধিপত্য বিস্তারে আমাদের দেশে অবৈধ অস্ত্র বেশি ব্যবহার হয়। নির্বাচনের আগে অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার বন্ধে জোরালো বিশেষ অভিযান প্রয়োজন।

পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, শেখ হাসিনা সরকারের বিদায়ের পর ব্যাপক হামলা, অনাস্থা আর আন্দোলনের সময় বিতর্কিত ভূমিকার জন্য পুলিশ চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো জোরালো ভূমিকা রাখতে পারছে না বলেই অপরাধী চক্রগুলো সুযোগ নিচ্ছে। আবার নতুন করে বিরূপ পরিস্থিতিতে পড়ার ভয়েও অনেক ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে গড়িমসি করছেন অনেক পুলিশ সদস্য। এসব কারণে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয়ে জনমনে উদ্বেগ তৈরি করছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, নির্বাচনের আগেই প্রাণঘাতী অস্ত্র রাইফেল, মর্টার শেল, পিস্তল, গুলি ও ভয়ংকর বিস্ফোরক চোরাচালানের মাধ্যমে সীমান্তপথে দেশে আসছে। পাচার করে আনা কিছু অস্ত্র জব্দ হলেও এর কয়েক গুণ বেশি ঢুকে যাচ্ছে দেশের অভ্যন্তরে। কক্সবাজার, সাতক্ষীরা, চুয়াডাঙ্গা ও কুমিল্লা সীমান্তে বিজিবি সম্প্রতি বেশ কয়েকটি অস্ত্রের চালান আটক করেছে। সীমান্তপথে অস্ত্র ঢুকে রাজধানী ও বড় শহরগুলোতে ছড়িয়ে পড়ছে রাজনৈতিক ও অপরাধচক্রের হাতে।

বিজিবির হিসাব বলছে, চলতি বছরের প্রথম নয় মাসে পাচারের সময় দেশের সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে মোট ১ হাজার ২২৫টি অস্ত্র-গুলি ও ম্যাগাজিন জব্দ করা হয়। এর মধ্যে গত মে মাস থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পাঁচ মাসেই জব্দ করা হয় ১ হাজার ১২৮টি। নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে অস্ত্র চোলাচালান বাড়ছে। এ সময় জব্দ হওয়া অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে দুটি এসএমজি, তিনটি মর্টার শেল, ১১টি রিভলবার, ১৯টি পিস্তল ও পাঁচটি শটগান।

থানা লুটের অস্ত্রের নিরাপত্তা ঝুঁকি : পুলিশ সদর দপ্তর জানায়, ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানের সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মোট ৫ হাজার ৭৫৬টি অস্ত্র লুট হয়েছে। লুট হওয়া অস্ত্রের মধ্যে উদ্ধার করা হয়েছে ৪ হাজার ৪১৩টি। এখনও বাকি আছে ১ হাজার ৩৪৩টি অস্ত্র। পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) এএইচএম শাহাদাত হোসাইন বলেছেন, পুলিশের খোয়া যাওয়া অস্ত্রের মধ্যে ৭৫ শতাংশের বেশি উদ্ধার হয়েছে। বাকি অস্ত্রগুলো উদ্ধারে গোয়েন্দা কার্যক্রম এবং অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, লুট হওয়া অস্ত্র অপরাধীদের হাতে চলে গেছে। অপরাধ সংঘটনের পর জব্দ করা অস্ত্রের ব্যারেল ও সিরিয়াল নম্বর মিলিয়ে দেখা গেছে, বেশ কিছু অস্ত্র পুলিশ ও অন্যান্য বাহিনীর জব্দ তালিকা থেকে হারিয়ে গিয়েছিল।

পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, লুট হওয়া আগ্নেয়াস্ত্র-গোলাবারুদ জেল পলাতক আসামি, দাগি সন্ত্রাসী, উগ্রপন্থি, চরমপন্থি, কিশোর গ্যাংয়ের হাতে চলে যাওয়ার আগামীর নির্বাচনে বিষয়টি ভয় ও আতঙ্কের বিষয় হয়ে দাঁড়াতে পারে।