৩৮ আগ্নেয়াস্ত্র ও লাখো গুলি গায়েব

গোলাম সাত্তার রনি
১১ নভেম্বর ২০২৫, ১০:২১
শেয়ার :
৩৮ আগ্নেয়াস্ত্র ও লাখো গুলি গায়েব

হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অগ্নিকাণ্ডের পর ভল্ট ভেঙে একটি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের ৩৮টি আগ্নেয়াস্ত্র ও এক লাখ গুলি চুরি হয়েছে। স্ট্রং ভল্টে থাকা ২০৮ নম্বর কার্টনে আগ্নেয়াস্ত্রভর্তি ২১টি বক্সের ৭টির হদিস নেই। কম দামি অস্ত্রের কার্টনে হাত না দিয়ে চোরচক্র দামি আগ্নেয়াস্ত্র লুটে নিয়েছে। আগ্নেয়াস্ত্র চুরির ঘটনায় বিমানবন্দর থানায় তিনটি জিডি করা হয়েছে। তবে বিমান মন্ত্রণালয় তাদের তদন্ত প্রতিবেদনে মাত্র সাতটি আগ্নেয়াস্ত্র চুরির ঘটনা উল্লেখ করেছে। তারা প্রতিবেদনে চুরি প্রতিরোধে একগুচ্ছ সুপারিশ দিয়েছে।

এম/এস. গানমাক্স দেশের অস্ত্র-গুলি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান। গত ১৮ অক্টোবর বিমানবন্দরের অগ্নিকাণ্ডের সময় তাদের বিপুল পরিমাণ অস্ত্র-গুলি কার্গো হাউসের স্ট্রং ভল্টে জমা ছিল। আগুন তাদের আগ্নেয়াস্ত্র পোড়াতে না পারলেও চোরচক্রের হাত থেকে রক্ষা পাননি। গতকাল সন্ধ্যায় প্রতিষ্ঠানটির মালিক ফয়সাল কবির জানান, তাদের চারটি কনসাইনমেন্ট বিমানবন্দরের স্ট্রংরুমে সংরক্ষিত ছিল। এর মধ্যে একটি কনসাইনমেন্টে থাকা ৫০টি পিস্তল থানার হেফাজতে তালিকাভুক্ত রয়েছে। যেগুলো কম দামি অস্ত্র। তবে বাকি তিনটি কনসাইনমেন্ট স্টোরেজ থেকে আর পাওয়া যাচ্ছে না। এগুলোর মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি ১৬টি পিস্তল, তুরস্ক থেকে আসা ২০ হাজার রাউন্ড গুলি, ভারত ও জার্মানির তৈরি ২২টি এয়ার রাইফেল এবং প্রায় ১ লাখ এয়ারগান বুলেট।

ফয়সাল কবির বলেন, আমরা বৈধ অনুমোদন নিয়ে ২০২৩-২৪ সালে পণ্যগুলো আমদানি করেছি। কাস্টমস ও স্টোরেজ কর্তৃপক্ষের কাছে বারবার জানতে চেয়েও অনুপস্থিত কনসাইনমেন্টগুলোর অবস্থান সম্পর্কে কোনো সুস্পষ্ট তথ্য পাইনি। বাধ্য হয়ে জিডি করেছি।

এয়ারপোর্ট থানার একজন কর্মকর্তা বলেন, অস্ত্র ও গোলাবারুদ অনুপস্থিতির বিষয়ে জিডি হয়েছে। বিষয়টি তদন্ত করা হচ্ছে। তদন্তের পর কী সংখ্যক অস্ত্র চুরি হয়েছে সেটি নিশ্চিত হওয়া যাবে। সেই সঙ্গে অস্ত্র চুরির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তারেরও চেষ্টা করছে পুলিশ।

অস্ত্র ও গুলির চুরির পর বিমান মন্ত্রণালয় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। সেই কমিটি তদন্ত শেষ করেছে। তদন্ত কমিটির একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, তারা সাতটি আগ্নেয়াস্ত্র খোয়া যাওয়ার প্রমাণ পেয়েছেন। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের নিরাপত্তার চরম দায়িত্ব অবহেলার বিষয়টিও তদন্তে উঠে আসে। প্রতিবেদনে চুরি প্রতিরোধে একগুচ্ছ সুপারিশ দিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে-কার্গো হাউস এলাকায় সার্বক্ষণিক সিসি ক্যামেরার ব্যবস্থা করা, নিরাপত্তা আরও জোরদার করা। দীর্ঘ সময় পণ্য ফেলে রাখার বিষয়টি সুরাহা করতে কাস্টমস আইন অনুযায়ী ২১ দিনের বেশি সময় পণ্য থাকলে সেগুলোর বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়।

এ ব্যাপারে ঢাকা কাস্টম হাউসের যুগ্ম কমিশনার কামরুল হাসান বলেন, মালামালের হেফাজতকারী বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। চুরির দায় আমাদের না। আমরা শুধু শুল্ক আদায় করি। আমদানিকৃত প্রতিষ্ঠানের যেসব অস্ত্র এখনও আছে, কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করে সেই অস্ত্র শুল্ক আদায় শেষে আমরা ছেড়ে দেব।

চুরির পর পুলিশের জব্দ তালিকা থেকে জানা যায়, কার্গো হাউসের স্ট্রং রুমে দুর্ধর্ষ চুরির পর ভাঙা ভল্টে পাওয়া গেছে ৮০টি অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র, বিপুলসংখ্যক ম্যাগাজিন ও কার্টিজ। চুরির পর এসব আগ্নেয়াস্ত্র ও গুলিসহ মালামাল পুলিশ হেফাজতে রাখা হয়েছে। ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের সিসি ক্যামেরা পুড়ে যাওয়া ও বিদ্যুৎ বন্ধের সুযোগ নিয়ে স্ট্রং রুমের তালা কেটে লুটপাট চালায় অপরাধী চক্র।

জানা গেছে, গত ২৮ অক্টোবর সকালে চুরির ঘটনা জানাজানি হয়। পরে ঢাকার পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন সংস্থা ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে পুরো এলাকা নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে ফেলা হয়। পরের দিন ২৯ অক্টোবর ভাঙা স্ট্রং রুমের সামনে পাঁচ সাক্ষীর উপস্থিতিতে মালামালের তালিকা করা হয়। বিমানবন্দর থানা পুলিশের জব্দ তালিকায় দেখা যায়, ভাঙা স্ট্রং রুম থেকে পুলিশ হেফাজতে নেওয়া হয় ৬৭টি অত্যাধুনিক পিস্তল, ১২টি শটগান, একটি এসল্ট রাইফেল, পিস্তলের ১৩৮টি খালি ম্যাগাজিন, ৯ মিমি ব্ল্যাংক কার্টিজ ৯৯১ পিস, শটগান ও রাইফেলের খালি ম্যাগাজিন জব্দ করা হয়েছে। জব্দ তালিকা থেকে জানা যায়, বিমানবন্দরের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পরও সুরক্ষিত স্ট্রং রুম প্রায় অক্ষতই ছিল। অধিকাংশ আগ্নেয়াস্ত্রের তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি। কয়েকটি আগ্নেয়াস্ত্রের প্লাস্টিক বাট, ব্যারেলের নিচের স্প্রিং ও ম্যাগাজিন কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিমানবন্দরের মতো সুরক্ষিত এলাকা থেকে এত বিপুলসংখ্যক অস্ত্র কারো একার পক্ষে সরানো সম্ভব নয়। চোররা অস্ত্রের বিষয়টি ভালোভাবেই জানেন। তাই কম দামি অস্ত্র রেখে বেশি দামি অস্ত্র চুরি করেছে। বিমানবন্দর থেকে অস্ত্র সরাতে চোরদের সহযোগিতা করেছে একাধিক চক্র।