বন্ধুর বাসায় ৬২ লাখ টাকা রাখেন কর কর্মকর্তা

আসাদুর রহমান
১০ নভেম্বর ২০২৫, ১০:১৭
শেয়ার :
বন্ধুর বাসায় ৬২ লাখ টাকা রাখেন কর কর্মকর্তা

মোসা. তানজিনা সাথী। ৩৬ বিসিএসের কর্মকর্তা। চাকরিতে যোগ দেন ২০১৮ সালে। মাত্র ৫ বছরে ‘অস্বাভাবিক’ সম্পদশালী বনে যাওয়ায় দুদকের নজরদারিতে আছেন তিনি। ২০২৩ সাল থেকে তার বিরুদ্ধে তদন্ত করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। যদিও অজানা কারণে তদন্তে গতি নেই। উপরন্তু তদন্তকালীনই তিনি পদোন্নতি বাগিয়ে নিয়েছেন। তথ্যমতে, বিশেষ তদবিরে তার পদোন্নতি হয়েছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, উপ কর-কমিশনার তানজিনা সাথী কোনো ধরনের চুক্তি বা প্রমাণ ছাড়াই তার এক বন্ধুর বাসায় ৬২ লাখ টাকা রেখেছেন। এ ছাড়া তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির নানা তথ্য খুঁজে পেয়েছে দুদক। ৬২ লাখ টাকার বিষয়ে তানজিনা ও তার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর মুঠোফোনে কথোপকথনের একটি অডিও আমাদের সময়ের হাতে এসেছে। তা হুবহু তুলে ধরা হলো-

তানজিনা : আমার কি তোমার টাকা নিয়ে চিন্তা আছে? তাহলে আমি তোমার বাসায় আমার টাকা দিয়ে আসতাম না। যদি নেওয়ারই চিন্তা করতাম।

বন্ধু : আমার টাকা নিয়ে তোমার চিন্তা আছে- এইটা যদি আমি ভেবে থাকি তাহলে খুবই কষ্ট পাব। আমি জানি তোমরা ২/৪/৫ লাখ, ১০/২০ লাখ টাকা নিয়ে যে তোমার মাথাব্যথা নেই। এই কথাটি আমি জানি কি জানি না? তোমার যদি আমার প্রতি অবিশ্বাস থাকত তাহলে ৬১/৬২ লাখ টাকা আমার বাসায় রেখে গেছ কিনা, বলো। রেখে গেছ?

তানজিনা : হুম।

বন্ধু : আমি যদি পরের দিন বলতাম আমার কাছে এক টাকাও রাখোনি। আমি তোমাকে এক টাকাও দিব না। তুমি কি কোনো ক্লেইম (দাবি) করতে পারতা?

তানজিনা : না।

বন্ধু : সেটা যেভাবে রেখে গেছ, আমি কি সেইভাবে রেখে দিইনি। আমি কি সেটা নিয়ে কোনো মাথাব্যথা করছি?

প্রশ্ন উঠেছে, এই টাকার উৎস কি? কোনো ধরনের ডকুমেন্ট বা চুক্তি-প্রমাণ ছাড়াই কেন বন্ধুর বাসায় এত টাকা রেখেছেন এই কর কর্মকর্তা?

অভিযোগের তদন্ত চলাকালীন তানজিনার পদোন্নতির বিষয়টি নিয়ে কথা হয় ট্রান্সপারেন্সি ইন্টান্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামানের সঙ্গে। তিনি আমাদের সময়কে বলেন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর নৈতিক দায়িত্ব, তাকে সাময়িকভাবে অব্যাহতি দেওয়া। তা না করে তাকে পদোন্নতি দেওয়া দুঃখজনক। আইনগতভাবে হয়তো বাধ্যবাধকতা না থাকলেও নৈতিকভাবে এ পদক্ষেপ নেওয়া উচিত ছিল। এনবিআরের মতো প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব আছেÑ যেন তারা এ ধরনের কর্মকর্তাকে পদে বহাল না রাখে। তা না হলে দুর্নীতিকে সুরক্ষা দেওয়া হয়, আর সৎ মানুষদের হয়রানি করা হয়।

জানা গেছে, তানজিনা চাকরি নেওয়ার পরেই কোটিপতি বনে যান তার বাবা-মা। জানা গেছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে তানজিনার কর্মস্থলে (কর অঞ্চল-৯, ঢাকা) বাবা মো. মোশারফ হোসেন মল্লিকের নামে প্রায় ৫ কোটি টাকার সম্পদ দেখিয়ে ট্যাক্স ফাইল খোলা হয়। গৃহস্থ বৃদ্ধ বাবার নামে প্রথমবার খোলা ট্যাক্স ফাইলে বিপুল পরিমাণ সম্পদ দেখানোয় তৎকালীন ঢাকার কর অঞ্চলের কর্মকর্তারা ফাইলটি নিষ্পত্তির জন্য নিজ জেলা বরিশালে পাঠিয়ে দেন। বিপুল সম্পদ এবং আয়ের উৎস সন্দেহজনক হওয়ায় বরিশালের তৎকালীন কর্মকর্তারা বিষয়টি তদন্তে চার সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করেন।

একইভাবে তার অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষিকা মা মিসেস রানী বিলকিসের নামে ৩ কোটি ১১ লাখ ৭৮ হাজার ৯৬৪ টাকার ট্যাক্স ফাইল খোলা হয়। সেখানে তিনি ৩৮০ ভরি স্বর্ণের মালিক বলে উল্লেখ করেন। এ ছাড়া তার মায়ের নামে রূপগঞ্জে বাংলাদেশ পুলিশ অফিসার্স হাউজিং সোসাইটিতে সাড়ে ১৭ কাঠার একটি প্লট নেন, যার মূল্য প্রায় দুই কোটি টাকা। এই প্লট নিতে সহায়তা করেন পুলিশ কর্মকর্তা, যিনি তানজিনার সাবেক ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তানজিনা নিজেও তার ফাইলে ২ কোটি ৯৬ লাখ ১ হাজার ৫৯২ টাকার সম্পদ দেখিয়েছেন। তিনজনের সম্পদের পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ১১ কোটি টাকা। প্রশ্ন উঠেছেÑ তার বাবা-মা যদি এত সম্পদের মালিক হয়ে থাকেন তাহলে আগে কেন কর দেননি।

দুদক সূত্র জানিয়েছে, ২০২৩ সালে তানজিনার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু হয়। তার বিরুদ্ধে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগসহ প্রায় দুই কোটি টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদের তথ্য পেয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তা। তানজিনার বাবা-মায়েরও অবৈধ সম্পদের প্রাথমিক তথ্য মিলেছে। এ বিষয়ে সম্পদের ডিক্লারেশন ও মামলার প্রস্তুতি নিলেও অজ্ঞাত কারণে তা থমকে আছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, শরীয়তপুরের জনৈক দেলোয়ার হোসেন তানজিনার শেয়ার মার্কেটের ব্যবসাসহ সব কিছু দেখভাল করেন। সবার কাছে দেলোয়ারকে আত্মীয় পরিচয় দেন এই কর কর্মকর্তা, যদিও তাদের মাঝে আত্মীয়তার সম্পর্ক নেই বলে জানা গেছে। এ ছাড়া তথ্য গোপন করে চাকরি নেন তানজিনা। বাংলাদেশ কর্র্ম কমিশন (পিএসসি) প্রজ্ঞাপনে তার স্থায়ী ঠিকানা- বরগুনা। জাতীয় পরিচয়পত্রে স্থায়ী ঠিকানা- বরিশাল। তার পরিবারের সবার স্থায়ী ঠিকানাও বরিশাল। বিষয়টি জানাজানি হলে চলতি বছরের জানুয়ারিতে স্থায়ী ঠিকানা পরিবর্তন করে বরিশালের ঠিকানা যুক্ত করেন তানজিনা। এতে প্রশ্ন ওঠে- একজনের কীভাবে দুটি স্থায়ী ঠিকানা হয়।

সূত্র জানিয়েছে, বিগত সরকারের প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের সাবেক পরিচালকের স্ত্রী পিএসসির সাবেক সদস্য আনোয়ারা বেগমের বোর্ডে ভাইবা দিয়ে চাকরি পান তানজিনা সাথী। যিনি (আনোয়ারা) সম্প্রতি আটক হয়েছিলেন। তিনি তানজিনার সেই ‘কথিত ভাই’ এর মামি।

২০২৪ সালে টাঙ্গাইলে থাকাকালীন তানাজিনা নিজ সার্কেলের পাশাপাশি আরও দুটি সার্কেলের অতিরিক্ত দায়িত্বে ছিলেন। বর্তমানে আছেন ময়মনসিংহের শিল্পাঞ্চল খ্যাত ভালুকা সার্কেলের দায়িত্বে। দুর্নীতি তদন্ত চলমান থাকাকালেও সবসময়ই ভালো জায়গায় পদায়ন হচ্ছেন। পাশাপাশি এই দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাকে বিশেষ তদবিরে রক্ষা করতে যেসব অদৃশ্য শক্তি কাজ করেছে, যথাযথ তদন্তে তাদের চিহ্নিত করা সম্ভব। নয়তো জন্ম নিতে পারে আরেক ছাগলকাণ্ডের মতিউরের।

জানা গেছে, তানজিনার এক নিকটাত্মীয় সচিবালয়ের বড় কর্তা। এ ছাড়া তার ‘কথিত ভাই’ সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তা। যিনি আওয়ামী আমলে রাতের ভোটের কারিগর ছিলেন। তাদের সম্মিলিত তদবিরে দুদকের তদন্ত থমকে আছে। উপরন্তু দুর্নীতির তদন্ত চলাকালীন ছাড়পত্র নিয়ে পদোন্নতি বাগিয়ে নিয়েছেন।

দুদক সূত্রে জানা গেছে, প্রাথমিক অনুসন্ধানে অবৈধ সম্পদ অর্জনের তথ্য পাওয়া গেলে এসব সম্পদের ডিক্লারেশন চাওয়া হয় এবং পরে মামলা করা হয়। কিন্তু তানজিনার প্রায় ২ কোটি টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদের তথ্য পাওয়া গেলেও এর ডিক্লারেশন চাওয়া হয়নি। আবার ডিক্লারেশন চাওয়া ছাড়াই মামলা হতে পারে, যাতে আসামি সুবিধা পায়। সেই মামলার প্রক্রিয়াও অজানা কারণে থমকে আছে।

এ বিষয়ে উপপরিচালক (জনসংযোগ) মো. আকতারুল ইসলাম বলেন, অনুসন্ধান কার্যক্রম শেষ পর্যায়ে রয়েছে। কিছু দিনের মধ্যেই কমিশনে প্রতিবেদন দাখিল করবেন অনুসন্ধান কর্মকর্তা। দেরি হওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, এই অনুসন্ধানের সংশ্লিষ্ট তথ্য-উপাত্ত পেতে সময় বেশি লেগেছে, তারপর সেগুলো যাচাই-বাছাই করতে হয়েছে।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তানজিনা সাথী আমাদের সময়কে বলেন, অবৈধ সম্পদ অর্জন, তথ্য গোপন করে চাকরি নেওয়াসহ অভিযোগগুলো সত্য নয়। আর চাকরির ক্ষেত্রে ভিন্ন জেলা উল্লেখ করা কোনো সমস্যা নয়। এ ছাড়া পারিবারিকভাবে তার বাবা সম্পদশালী বলেও জানান তিনি।