নিউইয়র্ক শহরে সাহসী স্বপ্নের তরুণ
নিউইয়র্কের ইতিহাসে এক নতুন দিগন্ত! লন্ডনের পর এবার বিশ্বের আরেক ক্ষমতাধর মহানগর নিউইয়র্ক সিটি পেল প্রথম মুসলিম মেয়র, জোহরান মামদানিকে। উগান্ডা ও ভারতীয় বংশোদ্ভূত এই প্রগতিশীল নেতা তার ঐতিহাসিক জয়ের মাধ্যমে শুধু রেকর্ডই গড়লেন না, বরং তিনি প্রমাণ করলেন যে মুসলিমফোবিয়া ও কট্টরপন্থি বিদ্বেষকে দৃঢ়ভাবে মোকাবিলা করে কীভাবে সর্বোচ্চ রাজনৈতিক আসনে আরোহণ করা যায়। তার এই বিজয় বিশ্বজুড়ে সংখ্যালঘু ও অভিবাসী জনগোষ্ঠীর জন্য এক বিশাল অনুপ্রেরণা। বিস্তারিত জানাচ্ছেন শামস বিশ্বাস
প্রাথমিক অবস্থা
নিউইয়র্ক সিটি- বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কেন্দ্র- সর্বদাই পরিবর্তন ও অগ্রগতির প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়ে এসেছে। এই শহরের মেয়র পদটি শুধু যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় রাজনীতিতেই নয়, আন্তর্জাতিক মঞ্চেও গভীর প্রভাব ফেলে। এই পটভূমিতে, নভেম্বর ২০২৫ সালের মেয়র নির্বাচনটি নিউইয়র্কের ইতিহাসে এক নতুন, যুগান্তকারী অধ্যায় রচনা করেছে। এই নির্বাচনে জয়ী হয়ে জোহরান মামদানি (Zohran Mamdani) কেবল ডেমোক্রেটিক পার্টির একজন উঠতি তারকা হিসেবেই পরিচিত হননি, বরং তিনি এই মহানগরের প্রথম মুসলিম মেয়র হিসেবে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। মামদানির এই জয় এমন এক সময়ে ঘটেছে যখন নিউইয়র্ক সিটি আবাসন সংকট, অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং জলবায়ু পরিবর্তনের মতো জটিল চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে। একজন প্রগতিশীল সমাজতান্ত্রিক নেতা হিসেবে, মামদানির রাজনৈতিক আদর্শ প্রতিষ্ঠিত দলীয় ব্যবস্থার গতানুগতিক ধারার বিপরীতে গিয়ে তৃণমূলের মানুষের দাবিকে সামনে এনেছে।
জীবন ও বহুমুখী পটভূমি
জোহরান মামদানির ঐতিহাসিক বিজয় বুঝতে হলে তার ব্যক্তিগত জীবন ও সাংস্কৃতিক পটভূমি জানা অপরিহার্য। মামদানির জন্ম মূলত উগান্ডায়। তার বাবা মাহমুদ মামদানি, একজন প্রখ্যাত উগান্ডান-ভারতীয় শিক্ষাবিদ এবং মা মীরা নায়ার, একজন আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত ভারতীয়-আমেরিকান চলচ্চিত্র নির্মাতা। তার বাবা ঘানার বিপ্লবী নেতা কোয়ামে এনক্রুমাহর নামে তার মধ্য নাম ‘কোয়ামে’ রেখেছিলেন। শৈশবের একটি বড় অংশ উগান্ডা, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ভারতে কাটানোর পর সাত বছর বয়সে তিনি নিউ ইয়র্ক সিটিতে স্থায়ী হন। ব্রংকস হাই স্কুল অব সায়েন্স থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের পর মেইন রাজ্যের বোডোইন কলেজ থেকে তিনি আফ্রিকানা স্টাডিজে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। সেখানে তিনি স্টুডেন্টস ফর জাস্টিস ইন প্যালেস্টাইন সংগঠনের কলেজ শাখা প্রতিষ্ঠা করেন। এটি সাধারণত সংক্ষেপে এসজেপি নামে পরিচিত এবং এটি উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনি মানবাধিকার এবং ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংঘাতের বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য কাজ করা একটি ছাত্রসংগঠন।
নীতির ভিত্তি
শ্রেণি ও বর্ণ বৈষম্যের প্রত্যক্ষদর্শী : পাবলিক ডিফেন্ডার হিসেবে তার মক্কেলরা প্রায়শই ছিল নিম্ন আয়ের এবং কৃষ্ণাঙ্গ ও হিস্পানিক সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ। তিনি প্রত্যক্ষ করেন যে কীভাবে দারিদ্র্য এবং ফৌজদারি বিচারব্যবস্থার মধ্যে একটি চক্র কাজ করে। মামদানি উপলব্ধি করেন, পুলিশি নজরদারি এবং কঠোর আইনি প্রক্রিয়াগুলো ধনী বা শ্বেতাঙ্গদের তুলনায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ওপর অনেক বেশি কঠোরভাবে প্রয়োগ করা হয়।
নীতিতে প্রভাব : এই অভিজ্ঞতা থেকে তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতে শুরু করেন যে কেবল ব্যক্তিগতভাবে মামলা লড়ে নয়, বরং কাঠামোগত পরিবর্তনের মাধ্যমেই সত্যিকারের ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা সম্ভব। তার নির্বাচনী এজেন্ডার মূল স্তম্ভগুলো, যেমন- পুলিশিং সংস্কার এবং বাজেট কমানো- সরাসরি এই অভিজ্ঞতার ফল। তার মতে, বিচারব্যবস্থা অপরাধীদের শাস্তি দেওয়ার চেয়েও বেশি করে দারিদ্র্যকে শাস্তি দেয়। এই উপলব্ধিই তাকে সরকারি দায়িত্ব নিতে অনুপ্রাণিত করে।
রাজনৈতিক উত্থান
পেশাগত অভিজ্ঞতা তাকে রাজনীতিতে আসতে অনুপ্রাণিত করে এবং তিনি ডেমোক্রেটিক সোশ্যালিস্টস অব আমেরিকায় (ডিএসএ) যোগ দেন। মামদানির রাজনৈতিক কর্মজীবনের সবচেয়ে বড় টার্নিং পয়েন্ট ছিল ২০২০ সালের নির্বাচন, যখন তিনি কুইন্সের ৩৬তম জেলা থেকে নিউ ইয়র্ক স্টেট অ্যাসেম্বলির আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। তিনি সেখানে চারবারের নির্বাচিত ডেমোক্র্যাট আরাভেলা সিমোটাসকে পরাজিত করে চমকে দেন। এই বিজয় প্রমাণ করে যে, ভোটাররা প্রথাগত দলীয় আনুগত্যের চেয়ে অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার ও সামাজিক সংস্কারের মতো কঠিন এজেন্ডাকে সমর্থন করতে প্রস্তুত। স্টেট অ্যাসেম্বলিতে যোগদানের পর মামদানি দ্রুত ডিএসএ এবং অন্যান্য প্রগতিশীল জোটের একজন মূল নেতা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। তিনি ভাড়াটেদের অধিকার রক্ষা, উচ্চাভিলাষী জলবায়ু পরিবর্তনবিরোধী আইন এবং পুলিশ ও কারাগার সংস্কারে মনোযোগ দেন। মেয়র নির্বাচনে তার প্রার্থিতা নিউইয়র্কের বিপুলসংখ্যক মুসলিম, দক্ষিণ এশীয় এবং আফ্রিকান বংশোদ্ভূত জনগোষ্ঠীর জন্য এক ধরনের ক্ষমতায়নের প্রতীক ছিল।
মেয়র অভিযান
জোহরান মামদানির ২০২৫ সালের মেয়র নির্বাচনী অভিযান ছিল নিউইয়র্কের আধুনিক রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি স্বতন্ত্র এবং উদ্দীপক অধ্যায়। তার প্রচারণা মূলত তৃণমূল আন্দোলন (গ্রাসরুটস মুভমেন্ট), প্রগতিশীল আদর্শ এবং অর্থনৈতিক ন্যায়বিচারের ওপর ভিত্তি করে পরিচালিত হয়েছিল।
অপ্রত্যাশিত জয়
মামদানির রাজনৈতিক যাত্রার শুরু হয়েছিল কুইন্স-এর ৩৬তম জেলা (অ্যাস্টোরিয়া ও লং আইল্যান্ড সিটি) থেকে স্টেট অ্যাসেম্বলিতে জয়লাভের মাধ্যমে। এই জয় ছিল বিশেষভাবে অপ্রত্যাশিত, কারণ ঐতিহাসিকভাবে এই অঞ্চলটি ছিল প্রথাগত মধ্যপন্থি ডেমোক্রেটিক নেতৃত্বের শক্ত ঘাঁটি।
জনবিন্যাসগত জটিলতা : অ্যাস্টোরিয়া হলো নিউইয়র্কের একটি শ্রমিক শ্রেণির এবং জাতিগতভাবে অত্যন্ত বৈচিত্র্যময় এলাকা, যেখানে গ্রিক, ইতালীয়, আইরিশ এবং নতুন অভিবাসী মুসলিম ও দক্ষিণ এশীয় জনগোষ্ঠীর মিশ্রণ রয়েছে। এই এলাকায় ভাড়াটে এবং ছোট বাড়ির মালিকদের মধ্যে অর্থনৈতিক স্বার্থের দ্বন্দ্বও বিদ্যমান।
প্রথাগত রাজনীতির প্রভাব : এর আগে এখানে প্রতিষ্ঠিত ডেমোক্র্যাটরা, যেমন- চারবারের নির্বাচিত আরাভেলা সিমোটাস, স্থিতিশীলতা এবং মধ্যপন্থি নীতির কারণে শক্তিশালী ছিলেন। মামদানি যখন প্রকাশ্যে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র এবং ‘পুলিশের বাজেট হ্রাস’-এর মতো কট্টর বামপন্থি এজেন্ডা নিয়ে আসেন, তখন মনে করা হয়েছিল যে তার এই অবস্থান রক্ষণশীল বা মধ্যপন্থি ভোটারদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করবে।
বিজয়ের কারণ : মামদানি তার ব্যক্তিগত পরিচয় (অভিবাসী পটভূমি) ব্যবহার করে তরুণ, ভাড়াটে এবং নতুন অভিবাসী জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সরাসরি সংযোগ স্থাপন করতে সক্ষম হন। তার আবাসন ন্যায়বিচার এবং ভাড়া নিয়ন্ত্রণ-এর এজেন্ডা তরুণ এবং অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া ভোটারদের ব্যাপক সমর্থন লাভ করে, যা প্রথাগত ডেমোক্রেটিক মেশিনকে পরাস্ত করে। এই জয় নিউইয়র্কের রাজনীতিতে তৃণমূল প্রগতিবাদের উত্থানের স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয়।
আরও পড়ুন:
রোগীর পেটে জীবন্ত মাছি!
তৃণমূলের অর্থায়ন
মামদানির প্রচারণা প্রমাণ করে যে, নিউইয়র্ক সিটির মতো ব্যয়বহুল রাজনৈতিক বাজারেও ছোট আকারের অনুদান এবং জনগণের উদ্দীপনা একত্রিত হয়ে শক্তিশালী আর্থিক শক্তিকে পরাস্ত করতে পারে। এটি তার ‘জনগণের জন্য রাজনীতি’ এজেন্ডার একটি শক্তিশালী বাস্তবের রূপ দেয়।
ট্রাম্পের সঙ্গে সংঘাত
একজন প্রগতিশীল সমাজতন্ত্রী হিসেবে মামদানির আদর্শিক অবস্থান তাকে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সরাসরি আক্রমণের মুখে ফেলে। ট্রাম্প বারবার মামদানিকে ‘উন্মাদ কমিউনিস্ট’ এবং ‘বিপর্যয়ের অপেক্ষায়’ থাকা ব্যক্তি হিসেবে আখ্যায়িত করে নিউইয়র্ক সিটিতে ফেডারেল তহবিল বন্ধ করার হুমকি দেন।
ফিলিস্তিনের পক্ষে অবস্থান
মামদানির জীবনের সবচেয়ে বড় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আলোচিত বিতর্কটি হলো ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত নিয়ে তার কঠোর সমালোচনা। তিনি একজন ফিলিস্তিনপন্থি নেতা এবং ইসরায়েলের একজন কঠোর সমালোচক। তিনি বিতর্কিত স্লোগান ‘ফ্রম দ্য রিভার টু দ্য সি’ ব্যবহার করেছেন এবং ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু নিউ ইয়র্ক শহরে পা রাখলে তাকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে গ্রেপ্তার করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এই অবস্থান তাকে ইহুদি সংগঠনের পক্ষ থেকে তীব্র সমালোচনার সম্মুখীন করেছে, যা তার মেয়াদের শুরুতেই এক গভীর রাজনৈতিক বিভাজন সৃষ্টি করেছে।
নিউইয়র্কের ভবিষ্যৎ
মেয়র হিসেবে মামদানির প্রশাসন নিউইয়র্ক সিটির জন্য কেবল একটি নতুন প্রশাসন নয়, বরং এক নতুন নীতিগত দিকনির্দেশনার সূচনা করবে। তার এজেন্ডাগুলো শহরের কাঠামোগত বৈষম্য দূর করতে চায়।
ভাড়া নিয়ন্ত্রণ ও আবাসন কর্মসূচি : তার প্রধান মনোযোগ হলো আবাসনকে একটি মৌলিক অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। তিনি ভাড়ার ওপর হিমায়িত অবস্থা বজায় রাখা (Rent Freeze) এবং নতুন, সাশ্রয়ী মূল্যের সামাজিক আবাসন ইউনিট (সোশ্যাল হাউজিং ইউনিটস) নির্মাণকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। তার লক্ষ্য, রিয়েল এস্টেট ডেভেলপারদের লাভের চেয়ে জনস্বার্থকে ওপরে স্থান দেওয়া।
ফ্রি বাস সার্ভিস পাইলট প্রোগ্রাম সম্প্রসারণ : স্টেট অ্যাসেম্বলিতে থাকাকালীন তিনি যে ‘ভাড়াহীন বাস পাইলট’ প্রোগ্রাম শুরু করেছিলেন, মেয়র হিসেবে তিনি সেটির দ্রুত ও ব্যাপক সম্প্রসারণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এটি পরিবেশগত ন্যায়বিচার এবং শ্রমজীবী মানুষের যাতায়াত খরচ কমানোর একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
বাজেট পুনর্বিন্যাস : পুলিশের বাজেট কমিয়ে সেই অর্থ জনস্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং সামাজিক পরিষেবা খাতে স্থানান্তরিত করার তার মূল এজেন্ডাটি অত্যন্ত বিতর্কিত। এই পদক্ষেপটি প্রমাণ করে যে তিনি কেবল সামান্য সংস্কার নয়, বরং অপরাধের মূল কারণ, যেমন- দারিদ্র্য ও গৃহহীনতা- মোকাবিলায় বিশ্বাসী।
চ্যালেঞ্জের প্রাচীর
গভর্নর হোচুলের আদর্শিক সংঘাত : নিউইয়র্কের গভর্নর ক্যাথি হোচুল একজন মধ্যপন্থি ডেমোক্র্যাট। তিনি প্রকাশ্যেই মামদানির উচ্চাভিলাষী এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য প্রস্তাবিত ধনী ও করপোরেশনের উপর ট্যাক্স বৃদ্ধির বিরোধিতা করেছেন। গভর্নরের এই বাধা মামদানির গুরুত্বপূর্ণ নীতিগুলো (যেমন- এমটিএ সংস্কার ও স্বাস্থ্যসেবা তহবিল) বাস্তবায়নে তহবিল সংগ্রহকে কঠিন করে তুলবে।
করপোরেট স্বার্থের সঙ্গে যুদ্ধ : রিয়েল এস্টেট লবি, পুলিশ ইউনিয়ন এবং ওয়াল স্ট্রিটের করপোরেট গোষ্ঠীগুলো মামদানির নীতির বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তুলবে। কার্যকরভাবে শাসন পরিচালনা করতে হলে তাকে এই শক্তিশালী স্বার্থসংশ্লিষ্টদের সঙ্গে একটি জটিল ‘শান্তিপূর্ণ অবস্থান’ তৈরি করতে হবে, যা তার আদর্শের জন্য একটি কঠিন পরীক্ষা।
নেতানিয়াহুর গ্রেপ্তারের প্রতিশ্রুতি : গাজা ইস্যুতে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে নিউ ইয়র্ক শহরে পা রাখলে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে গ্রেপ্তারের প্রতিশ্রুতি দেওয়ার বিষয়টি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিউইয়র্কের সিটি হলের জন্য এক বড় কূটনৈতিক ও আইনি চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করতে পারে।
ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে গোপনীয়তা
আরও পড়ুন:
২৫ জিম্মিকে মুক্তি দিল হামাস
নীতিই প্রধান, ব্যক্তি নয় : একজন গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রী হিসেবে মামদানি বিশ্বাস করেন যে, তার রাজনীতি তার ব্যক্তিগত জীবন বা পারিবারিক গ্ল্যামারের ওপর নির্ভর করবে না। তার এই গোপনীয়তা নিশ্চিত করে যে, সংবাদমাধ্যম ও জনগণের আলোচনা তার নীতিগত প্রস্তাবগুলোর ওপর ফোকাস থাকুক, ব্যক্তিগত সম্পর্কের ওপর নয়।
অতিরিক্ত স্ক্রুটিনি এড়ানো : একজন মুসলিম, অভিবাসী এবং বামপন্থি নেতা হিসেবে, ব্যক্তিগত জীবনের কোনো বিতর্ক বা স্ক্যান্ডাল তাকে সহজেই রাজনৈতিক আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু করে তুলতে পারত। এই গোপনীয়তা বজায় রেখে তিনি সেই অতিরিক্ত যাচাই-বাছাই (স্ক্রুটিনি) এবং ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিক বিতর্কের ঝুঁকি এড়িয়েছেন।
রাজনৈতিক বার্তা : তার এই কৌশলটি নতুন প্রজন্মের রাজনীতির সংস্কৃতিকে প্রতিফলিত করে, যেখানে একজন নেতা প্রমাণ করতে চান যে, তার কাজের মূল্যায়ন তার নীতির ভিত্তিতে হওয়া উচিত, তার পারিবারিক সম্পর্কের ভিত্তিতে নয়- যা জনজীবন ও ব্যক্তিগত জীবনের মধ্যে একটি স্পষ্ট সীমানা টেনে দেয়।
বাংলাদেশিদের মামদানি
মুসলিম পরিচয়ের উত্থান : বিশ্বের অন্যতম ক্ষমতাধর মহানগরীর প্রথম মুসলিম মেয়র হওয়াটা বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম সমাজের জন্য এক গভীর গর্বের বিষয়। প্রথম মুসলিম হিসেবে নিউইয়র্কের মেয়র অফিসের দায়িত্ব নেওয়াটা মুসলিম উম্মাহর উত্থানের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত, যা বৈশ্বিক রাজনীতিতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সক্ষমতাকে তুলে ধরে।
মোদি এবং কট্টর হিন্দুত্ববাদের প্রতি সমালোচনা : মামদানির জনপ্রিয়তার সবচেয়ে বড় কারণ হলো ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং তার সরকারের কট্টর হিন্দুত্ববাদী নীতির প্রতি তার স্পষ্ট এবং কঠোর সমালোচনা। এই অবস্থান তাকে বাংলাদেশের প্রগতিশীল এবং মানবাধিকারের প্রতি সংবেদনশীল পাঠকদের কাছে একজন বিবেকের কণ্ঠস্বর হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে।
যত এজেন্ডা
মেয়র হিসেবে মামদানির প্রশাসন নিউইয়র্ক সিটির জন্য কেবল একটি নতুন প্রশাসন নয়, বরং এক নতুন নীতিগত দিকনির্দেশনার সূচনা করবে। তার প্রশাসন শুরু থেকেই কাঠামোগত পরিবর্তন আনার লক্ষ্যে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
প্রথম ১০০ দিন
ফ্রি বাস পাইলট প্রোগ্রাম সম্প্রসারণ : তিনি দ্রুত নিউইয়র্কের ট্রানজিট কর্তৃপক্ষ এমটিএ-এর সঙ্গে সমন্বয় করে আরও বেশিসংখ্যক রুটে বিনামূল্যে বাস পরিষেবা চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
ভাড়া নিয়ন্ত্রণ শক্তিশালীকরণ : সিটি হলে প্রথম পদক্ষেপগুলোর মধ্যে থাকবে জরুরি নির্বাহী আদেশ জারি করে ভাড়ার ওপর হিমায়িত অবস্থা (রেন্ট ফ্রিজ) কার্যকর করার উদ্যোগ নেওয়া, বিশেষ করে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকা ভাড়াটেদের জন্য।
শহরের মালিকানাধীন মুদি দোকান : খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে তিনি প্রতিটি বরোতে অন্তত একটি করে শহরের মালিকানাধীন মুদি দোকান (মিউনিসিপ্যাল গ্রোসারি স্টোর) চালু করার পাইলট প্রকল্পের কাজ শুরু করবেন, যাতে সাধারণ মানুষ ন্যায্যমূল্যে খাবার পেতে পারে।
এনওয়াইপিডি’র বাজেট পর্যালোচনা : তিনি এনওয়াইপিডি (নিউ ইয়র্ক পুলিশ ডিপার্টমেন্ট)-এর বাজেট এবং সম্পদের বরাদ্দ নিয়ে একটি জরুরি ও সম্পূর্ণ পর্যালোচনা শুরু করবেন, যার ফলস্বরূপ কিছু তহবিল সামাজিক পরিষেবা ও মানসিক স্বাস্থ্য খাতে স্থানান্তর করার পথ প্রশস্ত হবে।
ভারতের প্রতিক্রিয়া
মোদি সমর্থকদের উদ্বেগ : মামদানির মায়ের সূত্রে দক্ষিণ এশীয় শিকড় থাকা সত্ত্বেও তার জয় মোদি সমর্থক এবং কট্টর হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে গভীর উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। এর প্রধান কারণ হলো :
স্পষ্ট সমালোচনা : মামদানি প্রকাশ্যেই মোদি সরকারের নীতি ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের সমালোচনা করেছেন এবং অযোধ্যার বাবরী মসজিদের জায়গায় মন্দির নির্মাণের প্রতিবাদে বিক্ষোভে অংশ নিয়েছিলেন।
আরও পড়ুন:
২৫ জিম্মিকে মুক্তি দিল হামাস
মিথ্যা প্রচারণা : নির্বাচনের সময় কট্টরপন্থি কিছু গণমাধ্যম তাকে ‘ভারতবিরোধী’, ‘জিহাদি মুসলিম’ এবং ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন থেকে অর্থ সহায়তাপ্রাপ্ত’ হিসেবে চিহ্নিত করে ব্যাপক অপপ্রচার চালিয়েছিল।
আন্তর্জাতিক মঞ্চে প্রভাব : একজন দক্ষিণ এশীয় বংশোদ্ভূত মুসলিম নেতা যখন নিউইয়র্কের মতো বৈশ্বিক শহরের নেতৃত্বে থাকেন এবং প্রকাশ্যে ভারতের অভ্যন্তরীণ নীতির সমালোচনা করেন, তখন এটি আন্তর্জাতিক মহলে মোদি সরকারের ভাবমূর্তির ওপর চাপ সৃষ্টি করে। তার জয় কট্টর হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির এক ধরনের নীতিগত পরাজয় হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।
গভর্নরের সঙ্গে আদর্শিক সংঘাত
মামদানিকে তার এই উচ্চাকাক্সক্ষী এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য সবচেয়ে বড় যে চ্যালেঞ্জটির মুখোমুখি হতে হবে, তা হলো নিউ ইয়র্ক স্টেটের গভর্নর ক্যাথি হোচুলের (যিনি ডেমোক্র্যাট) বিরোধিতা।
হোচুল ইতোমধ্যে ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, তিনি মামদানির উচ্চাকাক্সক্ষী এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় কর বৃদ্ধির বিরোধিতা করবেন।
প্রগতিশীলদের ব্লুপ্রিন্ট
বামপন্থি এজেন্ডার বৈধতা : তার সাফল্য প্রমাণ করে যে, গণতান্ত্রিক সমাজতান্ত্রিক নীতি, যেমন- ধনীদের ওপর কর বসানো, সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা ও আবাসন কর্মসূচি- কেবল একাডেমিক ধারণা নয়, বরং বাস্তবসম্মত এবং জনপ্রিয় নির্বাচনী এজেন্ডা হতে পারে। এই বিজয় অন্যান্য আমেরিকান শহরের প্রগতিশীল প্রার্থীদের সাহস জোগাবে।
ঐতিহাসিক নেতা : প্রথম মুসলিম মেয়র হওয়াটা মুসলিম আমেরিকানদের এবং নতুন প্রজন্মের অভিবাসীদের জন্য ক্ষমতায়নের এক শক্তিশালী প্রতীক। তার এই উত্থান বহুত্ববাদী আমেরিকান সমাজের প্রতিচ্ছবিকে আরও উজ্জ্বল করে।
উত্তরাধিকার : যদি মামদানি তার এজেন্ডাগুলো সফলভাবে বাস্তবায়ন করতে পারেন, তবে তার এই নীতিগুলো অন্যান্য আমেরিকান শহরের জন্য একটি নীতিগত ব্লুপ্রিন্ট হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে।
তাৎপর্যপূর্ণ ক্যারিয়ার
ক্ষমতায়নের প্রতীক : প্রথম মুসলিম মেয়র হিসেবে তার জয় সংখ্যালঘু ও অভিবাসী জনগোষ্ঠীর জন্য ক্ষমতায়নের এক শক্তিশালী প্রতীক। তিনি প্রমাণ করেছেন যে তার পরিচয় কোনোভাবেই রাজনৈতিক সফলতার পথে বাধা নয়।
যোগ্য অন্যান্য পদ : একজন স্বাভাবিকীকৃত নাগরিক হিসেবে তিনি নিউইয়র্কের মেয়র ছাড়াও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্য যেকোনো উচ্চপদে অধিষ্ঠিত হতে পারেন। যেমন- গভর্নর, মার্কিন সিনেটর অথবা ক্যাবিনেট মন্ত্রী। সুতরাং, জোহরান মামদানি নিঃসন্দেহে মুসলিম আমেরিকানদের জন্য একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা এবং রাজনৈতিক মডেল হিসেবে থাকবেন, কিন্তু সাংবিধানিক শর্তের কারণে হোয়াইট হাউসে তার প্রবেশাধিকার নেই।